
নভেরা হোসেনের রোজনামচা ‘মায়া মদমিদমখিলং’
পর্ব ২
প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২০
১৯ এপ্রিল
এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মানথ্। উনিশ সংখ্যাটা বরাবরই বেশ জটিল লাগত। মৌলিক সংখ্যাগুলোর মধ্যে উনিশ সংখ্যাটি অনেক ভাবিয়েছে গণিতবিদদের, আমি ঠিক সেজন্য এ তারিখটি নিয়ে ভাবতাম না। এ অন্য বিষয়। বাবার অন্তর্ধান দিবস। শৈশব থেকেই দেখে আসছি, এ দিনে বাড়িতে মিলাদ, কোরআন তেলওয়াত। কণা ফুপু আসত রংপুর থেকে। সারাদিন বাড়িতে ফকির খাওয়ানো, দান-খয়রাত এসব চলত। দাদির কাছে শুনেছি, রেডিও পাকিস্তান থেকে যে কয়জন অফিসারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা অনেকেই ফিরে এসেছে। কিন্তু বাবাকে ধরে নেয় রাস্তা থেকে। নিখোঁজ হওয়ার দিনটিতে সন্ধ্যায় কী করে যেন বাবা রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের সামনে পড়ে যায়। সঙ্গে আইডি কার্ড ছিল না। বাসার সবাই বহুরাত পর্যন্ত বাবার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু ভোররাতের দিকে খবর আসে, লালবাগ মোড় থেকে যাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছিল তারা কেউ আর বেঁচে নেই। তাদের ডেডবডি কামরাঙ্গি চরের দিকে পাওয়া যাচ্ছে। একজনের বাসা থেকে চাক্ষুষ ডেডবডি দেখার খবরও পৌঁছে যায় বাসায়। মা কখনো বিশ্বাস করতে পারেনি, বাবা ফিরে আসবে না। সে সবসময় বাবার জন্য অপেক্ষা করত, এখন পর্যন্ত করে। মার এই ওয়েটিং ফর গোডো থিমটা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। উই টু আর ওয়েটিং ফর গোডো, ওয়েটিং ফর নাথিং। হ্যাঁ এই অপেক্ষা, এ গোডোর জন্য অধীর ব্যাকুলতা, নাথিং এর জন্য দিন গোনা হয়তো আমার ব্যক্তিত্বকে শূন্যবাদী করে তুলেছিল। জানতাম, পিতা ফিরে আসবে পুত্রের কাছে। স্বপ্ন, স্বপ্ন, তা হয়ে গেছে দুঃস্বপ্ন। বিধ্বস্ত ওয়ারিশ শহরে লোকজন সব পালাচ্ছে, চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ছে, শীতে কুঁকড়ে যাওয়া বৃদ্ধ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভারি লটবহর। ছোট গ্রাহাম নগ্ন পায়ে এলোমেলো ঘুরছে, গেটোর ভেতরে এঁটো গন্ধ, লাশ পচা গন্ধ। গ্রাহাম তার বাবাকে খুঁজছে। নাতাশা তার বাবাকে খুঁজছে। জাফর পানাহি, আনন্দ, রোকেয়া... সবাই তাদের বাবাকে খুঁজছে... ফাস্ট ফরওয়ার্ড... সেভেনটি ওয়ান, সেভেনটি টু, এইট্টি টু, নাইনটি, নাইনটি টু...। না, মাথাতো সদরঘাট হয়ে গেল। জট খুলি কী করে?
মাথার ভিতর
স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- ভালোবাসা নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে নাকি পাবেনা আহ্লাদ...
জীবনানন্দ দাশ এমন সব সময়ে এসে উপস্থিত হয়। ইচ্ছে করে আবার তাকে ট্রামের নিচে ফেলে দিয়ে আসি। এবার সুইসাইড নয় শর্ট স্টোরি অ্যাবাউট কিলিং।
মে ডে ১৯৯৩
ইভা ব্রাউন, ইভা ব্রাউন মাথার ভেতর ঘুরছে। ব্রেডের স্বাদও কেমন তিতকুটে। ময়দার বদলে শুনেছি ভুসি দিয়ে ব্রেড তৈরি হচ্ছে, পচা ডিমের গন্ধ, উৎকট। সকালের নাস্তাটা মাটি হয়ে গেল। রুমমেট তপনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। স্ট্যুপিড্ গাইস সব। কিন্তু ওরা আমাকে নির্বোধ বলে। কোত্থেকে যে এত সাহস পায়? তপনের শরীর থেকে শোল মাছের গন্ধ আসছে এবং ওর শরীরের নিচের অংশ মাছের মতো লাগছে। অদ্ভুত ব্যাপার কোমরের নিচ থেকে পুরোটা আঁশ দিয়ে গাঁথা। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! ভুল দেখছি না তো? এরকম সব সিনেমায় দেখা যায়। মানুষের পূর্ব-পুরুষ জল থেকে ডাঙায় এসেছে আবার জলে ফিরে যাবে। এতো হিন্দু মাইথলজিতেও আছে। চুরাশি লক্ষ যোনি পথ ঘুরে পরমাত্মায় মিশে যাওয়া। এখন কোন্ স্তরে আছি, কে জানে? আরও কয় লক্ষ বছর ঘুরতে হবে কে জানে? হু নোজ? গড নোজ? নাউ হু ইজ দ্য গড দেন্? হা।
এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা চায় ত্বরায় কর এই ভবে।
মন কিছু চায় না। এই কিছু চায় না যে সেটা চায় বটে। হা... হা... হা...
২৫ অগাস্ট
অগাস্টাস দ্য গ্রেট এম্পার্রা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। মেয়েটির কথা মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে ছোট মুক্তোর মতো, রেশম কোমল মেয়েটি। কে তুমি কালো রাতে এসেছো আলো হাতে বালিকা? ফোঁটা ফোঁটা স্যালাইন হয়ে ঝরে পড়ছি ওর-ই শরীরে। না এ তৃষ্ণা জলের না। মনটা খুব অস্থির লাগছে, হাসপাতালের মেয়েটি, কেবিন নম্বর ১২০। কার কন্যা এটি, কার জানি না। কিন্তু নিজের আত্মজার মতো লেগেছিল হাসপাতালের চকিত দর্শনে। কেমন হয় সে অনুভূতি? অনেক অনুভূতি বাস্তবে এক্সপিরিয়েন্স্ না করেই অনুভব করা যায়। অনেকটা তেমন। ভবিষ্যৎ বা সম্ভাব্য অনুভূতি বর্তমানে অনুভব করা বা যা কখনোই ঘটবে না এমন। কোনোদিন যাইনি নবগ্রাম, কোনোদিন! অজানা কারণে মন ইদানীং উচাটন হয়ে ওঠে। পোয়েটিক হয়ে যাচ্ছি না তো? হা হরতন হো ক্যুইট।
৭ জানুয়ারি ১৯৯৪
তিনদিন ধরে কানাঅলার মতো ঘুরছি। সাথে জুয়েল, আদিত্য, নবী। নবীর গানের দরাজ গলা কিন্তু তাল, লয় কম। তাই গেয়ে আসর জমায়। আর ওদের সাথে থাকতে হলে একই জলে পা না ডুবিয়ে উপায় নেই। জলে না ডুবেও উপায় নাই। আর নিজের যে ইচ্ছা নাই তাও নয়। লালবাগের খান সাহেবের আস্তানা! আজিমপুর এতিমখানা ছাড়িয়ে সোজা চলে গিয়ে ডানে মোড় নিতে হল। কিছুটা যাওয়ার পর বামে সরু গলি। কালো থকথকে ময়লা দিয়ে ড্রেনগুলো পূর্ণ। কিছু ময়লা গলির ওপরেও রাখা। এসব ডিঙিয়ে কাঠের দরজায় নক্ করতেই বেশ তাগড়া এক ছেলে এসে দরজা খুলে দিল। খান সাহেবকা কাস্টমার? মাথা নাড়তেই ছেলেটি আমাদের চার-পাঁচটা ঘরের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেল আখড়ায়। ঘরটিতে সাদা রংয়ের বেতের চেয়ার পাতা, মাঝে গোল টেবিল, কেমন একটা বোটকা গন্ধ। প্রথমে গা গুলিয়ে এলো, তবে কিছুক্ষণ যেতেই সহনীয় হয়ে গেল গন্ধটা। খান সাহেব নিজে এলেন আমাদের সাথে কথা বলতে। উঁচু, লম্বা, ধবধবে সাদা, মুখে লাল চাপ দাড়ি, শরীর থেকে বেশ একটা সুগন্ধ আসছিল জর্দার সম্ভবত। রোগা পটকা এক ছেলে সবুজ রঙের কাচের বোতলে করে দেশি দিয়ে গেল।
জুয়েল সাথে করে কমলা নিয়ে এসেছিল তাই চিপে দিল খানিকটা। খান সাহেব বহুৎ আচ্ছা লোক, ওনার চোখের সুর্মাটাও ভালো লাগল। ফেরার পথে হল ঝক্কি। উঠতে পারছিলাম না। পা যেন একেবারে গেঁথে দিয়েছে কেউ মেঝের সাথে। উঠতে পারি না। সবাই মহা খাপ্পা, ওরা নিজেরাই কিছুটা বেসামাল তার ওপরে এই বিপত্তি, শেষে দুজনে মিলে ঘাড়ে করে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে এল। তারপর কিছু মনে নেই। মাঝরাতে রুমের মেঝেতে নিজেকে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে গেলাম। এরা কি আজকাল মিথাইল এর বদলে ইথাইল অ্যালকোহল দিচ্ছে নাকি? সারা শরীর ব্যথা। মুখে বিস্বাদ। পাশের বিছানায় সেঁওতি শুয়ে আছে। ওর চোখে-মুখে রক্তের মতো কী যেন লেগে আছে। মেঝে থেকে উঠে ওর পাশে বসলাম। সেঁওতি পাশ ফিরে শুলো। ঠোঁট স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠল মেয়েটি। খুব কাছে থাকতে ইচ্ছে করে ওর কিন্তু কাছে গেলেই তীব্র বিকর্ষণ। না, আজ সেঁওতিকে ভীষণ আদর করলাম। প্রায় পিষে ফেলার দশা। মাঝে মাঝে ওকে হাত-পা বেঁধে আদর করতে ইচ্ছে করে। রক্তিম হয়ে উঠল আমার হারানো দেসদিমনা। এ কী এ-তো সেঁওতি নয়, পথে দেখা সে মেয়েটি। না, সে-ও না। কেউ না। কেউ-ই নেই ঘরে। ফাঁকা ঘরে ফ্যানের খটখট শব্দ বেজে চলেছে শুধু। চলবে