নভেরা হোসেনের রোজনামচা ‘মায়া মদমিদমখিলং’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০২০

৩ মার্চ
কিছুদিন ধরে কানের ভেতর সারাক্ষণ খুটখুট শব্দ হচ্ছে। ভেতরের ইঞ্জিনের শব্দ বাইরে চলে আসছে কেন, বুঝি না। কোনো কুয়োর ভেতর টু শব্দ করলে যেমন প্রতিধ্বনি হয় টু-উ-উ-উ-উ-উ, তেমন শব্দটা। সারাক্ষণ দুকান চাপা দিয়ে থাকি। ক্রমাগত বাড়তে থাকে টু শব্দ। না, অসহ্য যন্ত্রণা। রাস্তায় বেরোলে গাড়ির শব্দের সাথে কানের ভেতরের শব্দ মিলে ভো সাউন্ড তৈরি করে।

ফার্মগেটে ইএনটি স্পেশালিস্টের কাছে গেলাম। কানে বিভিন্ন মাত্রার কম্পনাঙ্ক মেপে দেখল। একেক গ্রেডের শব্দ মাথার মধ্যে দিয়ে ঢুকে সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় নার্ভে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। তবে হিয়ারিং টেস্টের রেজাল্ট নরমাল এলো।

২৭ জুন
আজ একটা বিশেষ দিন। আজ আমার আর সেঁওতির তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। সেঁওতির সাথে বিয়ের তিন বছর হয়ে গেল, এটা অতিরিক্ত। এতদিনেও আমার সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক হলো না। খুব কম দেখা হয়। কোর্ট ম্যারেজ করেছি না যেন খুনের আসামি। ওদের বাসায় গেলে দরজা খুলতে চায় না। খুব হৈ চৈ করলে ড্রইং রুমে বসতে দেয়। বাজখাঁই গলার মা-টা চোখমুখে চরম বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

সেঁওতির কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, বাসায় নাই। অথচ আমি জানি, ও বেডরুমে আছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেঁওতি এমন একটা মেয়ে যার অস্তিত্বের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আমি। হলে থাকতে ওর সাথে প্রতিদিন দেখা হতো। এ মেয়ে মারাত্মক ধরনের। ওকে যদি এভাবে ঘরে আটকে রাখে তাহলে নিশ্চিত সেঁওতি একদিন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে।

সেঁওতি কি সত্যি সেদিন পড়েছিল রাস্তায়? অনেক কাক একসঙ্গে উড়ে গিয়েছিল মাথার ওপর দিয়ে। মাঝ রাস্তায় থকথকে একখণ্ড মাংসপিণ্ড। ছড়ানো-ছিটানো রক্তের ছোপ। না, এ সত্যি নয়, আমার কল্পনা। সেঁওতি নয়, ও ছিল নাসরিন। নাসরিন লাফিয়ে পড়েছিল পাঁচতলার ছাদ থেকে। ক্যারাটে জানতো, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিল। কালো ছিপছিপে মেয়েটি, চোখগুলো খুব তীক্ষ্ণ, উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত। তবু কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতা।

অথচ আমার সাথে দেখা হলে খুব প্রগলভ হয়ে উঠতো। বলতো, তুমি এমন একটা ছেলে যার জন্য পৃথিবীও তার পায়ের চাকা বদলে নিতে পারে।

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫
রেজাল্ট বেরিয়েছে শুনলাম। গোল্লায় যাক। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি দিয়ে ভাত হয়তো জুটবে। কিন্তু ভাত রিকশা চালালেও জুটবে, বিড়ি বান্ধলেও জুটবে। তবে সব ভাতের স্বাদ হয়তো এক নয়। যেমন সব মানুষের মন আলাদা। বুঝি না আমাকে কেন বারবার মনোজগতে নিয়ে যাওয়া হয়। সমস্যাটা কী? লোকজনের আর কাজ-কাম নাই? ধরে ধরে সবাইকে পাগলা গারদে ভরে রাখছে। আমার তো মনে হয় ফুকোর থিওরি সঠিক। দেয়ালের কোন পাশে কে আছে তা কে বলতে পারে! মানে তা বলার অধিকার কে কাকে দিয়েছে? স্বাভাবিকতার সীমা কোথায় শেষ আর অস্বাভাবিকতার সীমা কোথায় শুরু, কে বলতে পারে?

২৮ ডিসেম্বর
লাস্ট ডেজ্ অফ পম্পেই। দিন শেষ হয়ে আসছে। আলো নিভে আসছে। টাইম মেশিনে চড়ে একদম পৃথিবীর শেষ দিনে পৌঁছে গেছি যেন। প্রকাণ্ড সূর্য মাথার খুব কাছাকাছি। এইচজি ওয়েলস, টাইম মেশিন। না এ-তো সায়েন্স। পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে ঘোরাটা ধীরে ধীরে কমে আসবে। এত আস্তে ঘুরবে পৃথিবী যে রাত পেরিয়ে দিন শুরু হতে কয়েক লক্ষ বছর লেগে যাবে। আবার ম্যামথ্দের যুগ শুরু হবে, হিম যুগ। বড় বড় সব প্রাণী কিন্তু গায়ে শক্তি নাই। ঘুম আসছে গভীর ঘুম।

বেলাল একবার হিপ্নটাইজ্ করেছিল। একটা চেনঅলা ক্রশ মুখের ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে আধ-ঘুম, আধ-জাগরণ দশা। চলে গেলাম সাব্কন্শাস্ স্টেজে। কথা বলছি, বেলালের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি কিন্তু হাত-পা অসাড়। কোনো শক্তি নেই, ভরশূন্য অনুভূতি, গ্রাভিটেশনহীন।