নাসরিন জয়া হকের কলাম ‘ধর্ম, রাষ্ট্র ও নাগরিক অধিকার’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০২, ২০২০

অধিকার ও দায়িত্ববোধের সরাসরি সম্পর্ক আছে। ইয়োরোপে সামাজিক বাঁক-বদলগুলোর লক্ষ্য ছিল, ব্যক্তির অধিকার বাড়ানো এবং সামাজিক মূল প্রণোদনা। এখনো তাই।

ধর্মিও প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির অধিকার খর্ব করতে পারবে না, শাস্তি দিতে পারবে না, এটাই সেকুলারিজমের মূলভিত্তি। তৃতীয় বিশ্বের অনেক মৌলবাদী ও তাদের সমর্থকেরা সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার মিথ্যা অর্থ প্রচার করছে যে, এটা সব ধর্মকে অস্বীকার করা। তা মোটেই নয়। ধর্মের নামে, ধর্মীয় পদবিযুক্ত লোক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির কোনো চয়েসে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, কিন্তু ব্যক্তির এসবে যাবার প্রতি কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি।

কমিউনিজম, সোভিয়েত রিপাবলিকে তা করা হয়েছিল। তার সাথে গণতন্ত্রের চড়াদাগে পার্থক্য আছে। যেসব ব্যবস্থায় শাস্তি, ভয়, নজরদারি, অবদমন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেসব ব্যবস্থা থেকে জনতা বিভিন্ন আন্দোলন করে সরে এসেছে এবং সে আন্দোলনগুলোর চলিষ্ণুতা বজায় আছে শিল্প ধারায় এবং রাজনীতিতে।

অনেক সময় জনতার অর্জিত অধিকার সামরিক বাহিনী খর্ব করেছে। স্পেনে, গ্রিসে তা ঘটেছে। স্পেনে ফ্রাঙ্কোর সামরিক স্বৈরশাসনের দোসর ছিল চার্চ ও রাজতন্ত্র। এখন অনেক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে না, কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজশ বজায় রাখছে, ইংল্যান্ড এরকম একটা দেশ।

ফ্রান্সে বিপ্লবের কিছুকাল পর সেনাপতি নেপোলিয়ন ক্ষমতায় আসীন হয় এবং নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে, তবে চার্চকে ব্যক্তির ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আর ফেরত দেয় নাই। পরে জনতা নেপোলিয়নের বংশধরদের সরিয়ে দেয়। লিবার্টে, ফ্রেটারনিটে, ইগালিটে আন্দোলনে ভল্টেয়ার থেকে হুগো, জুলস ভার্ন অংশগ্রহণ করেছে, সে প্রণোদনা ব্যাবহারিকভাবে এখনো ফ্রান্সের ভিত্তি।

স্পেনের ফ্রাঙ্কোর মতো আফ্রিকা, লাতিন এমেরিকা, এশিয়ার সামরিক শাসকেরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক আপাত আধুনিক বুদ্ধিজীবী সামরিক শাসকদের ধর্মের মাধ্যমে জননেতা হবার কৌশলকে গণতত্ত্ব দিয়ে সহায়তা করেছে, যার একটা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মবিরোধীতা বলে মিথ্যা প্রচারণা। সেকুলার রাষ্ট্র বলছে, তুমি তোমার ধর্ম নিয়ে থাকতে চাইলে থাকো, না থাকতে চাইলে না থাকো, কিন্তু রাষ্ট্রের কাজে মাথা গলাতে পারবে না, অন্য ব্যক্তির চয়েসেও বাধা দিতে পারবে না।

এখানে সমকালীন ইসরায়েলের প্রসঙ্গ আসতে পারে। দেশটি ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, আমাদের যেভাবে বোঝানো হয় যে এটি ইহুদীবাদ ভিত্তিক দেশ, তা সত্য নয়। আরব বিশ্বের বৈরিতার মুখে ছোট এ দেশটি ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, শুধু আমেরিকার সহায়তায় তাও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। ইসরায়েলের মতো ব্যাপক মার্কিন আর্থিক, সামরিক সহায়তা পেয়ে এসেছে মিশর ও পাকিস্তান। ইসরায়েল আজকে যে জায়গাতে তা সম্ভব হয়েছে কারণ, রাষ্ট্রটি অনেক বেশি ভাবে তার নাগরিকদের ব্যক্তিক গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনদের সে নাগরিকত্ব দেয় নাই, সেটার দায়িত্ব রাষ্ট্র হিশেবে ইসরায়েল নিতে চায় নাই। আবার জর্ডান, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, ইরাক যারা যুক্তভাবে ফিলিস্তিনদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের নিজেদের অধিবাসীদের অধিকার ও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রতি আচরণও দৃষ্টান্তযোগ্য নয়।

যেসব রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলে আছে দমনমূলক ও শাস্তিমূলক নিতি, জনতা তা একসময়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। অশোকের প্রতাপ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বুদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার হয়েছিল ভারতে, কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায় একসময় বৌদ্ধধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে। বুদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের সহায়তায় ভিন্নমতের লোকজনের ওপর অনির্বচনীয় নিপীড়ন চালিয়েছিল। ফলে পুরনো বৈদিক হিন্দু ধর্ম আবার ফিরে আসে এবং নতুন ইসলামও প্রসারিত হয়। রোমানদের বৈষম্যমূলক নাগরিকতা, সাম্যবাদের নামে সোভিয়েতদের দমননীতি সবই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আগে রাজতন্ত্রের সাথে মিলে ধর্ম ব্যক্তির অধিকার খর্ব করতো, এখন ধর্ম তা করছে জাতীয়তাবাদের সাথে মিলে।

অনেক সময় আমরা বলি, সব ধর্মের মূলে শান্তি। কিন্তু প্রয়োগে তা দেখা যায় না। ব্যক্তির মৃত্যুভয়কে পুঁজি করে আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাগুলো আসে ব্যক্তির সান্ত্বনা হিশেবে। দেখা যায়, এসব সান্ত্বনা আমাদের সবার দরকার। কিন্তু একটা সময় সান্ত্বনা শাস্তির খড়গে রূপান্তরিত হয়, সেই একই ভয়কে পুঁজি করে। ব্যক্তি বিভিন্ন সমষ্টিক আন্দোলন করে বলেছে, ভাই আমার সান্ত্বনা দরকার, কিন্তু খবরদারিটা দরকার নাই। আবার ব্যক্তি রাষ্ট্রকে তার ওপর বিভিন্ন স্তরে খবরদারি করতে দিচ্ছে, এটা করতে দিচ্ছে অধিকারগত চুক্তির বিনিময়ে। বাইরে থেকে এসে যারা ইয়োরোপে রেসিডেন্ট হিশেবে আছে তারাও একই নাগরিক অধিকার ভোগ করছে। আন্দোলনগুলো ঘটছে অধিকারগত দরকষাকষির জায়গা থেকে।

এবার বাংলাদেশের দিকে তাকানো যাক। ১৯৪৭ এ ধর্মের নামে পাকিস্তানে যোগ দান যে কী বড় ভুল ছিল, তা পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন বুঝেছিল অনেক আগে, চড়াদাগে মাশুল দিয়ে ১৯৭১ এ সেখান থেকে বেরুতে হয়েছে। বাংলাদেশের ১৯৭২ এর সংবিধান বাঙালির ব্যক্তি হিশেবে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের চুক্তি, যার ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ করবে, ব্যক্তি সে অধিকার সুরক্ষার বিনিময়ে রাষ্ট্রকে সহায়তা করবে।

স্বাধীনতার অল্প পরেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিশেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে ভয় পেয়ে গেল, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যে মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্নতা নয় তা বুঝাতে বাংলাদেশের পাসপোর্টে লেখা হলো, ইসরায়েল ও তাইওয়ানে ভ্রমণ নিষেধ। এ ঘোষণার সাথে সাথে বাংলাদেশিদের ওপর প্রথম বিধিনিষেধ আরোপিত হলো, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান হয়ে গেল কস্মেটিক্স এবং প্রকারান্তরে চিনা পররাষ্ট্রনীতিকে সহায়তা করা হলো। এ বিধিনিষেধে মৌলবাদী ও পাকিস্তানপন্থীদের কাছে য্যানো ক্ষমা চাওয়া হলো, প্রকারান্তরে প্রতীকীভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর একটা ভয় জারি করা হলো, তাদের অধিকার খর্বের পথ প্রশস্ত হলো।

রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নাগরিকদের অধিকার খর্ব করবার জন্য যে পরিমাণ আইন তৈরি করেছে, অধিকার সুরক্ষার জন্য সেরকম আইন বাড়াচ্ছে না। শাস্তি ও ভীতির ভিত্তিতে একটা শাসন ব্যবস্থা চালাতে চাচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় ভীতির ভেতর থেকে অভ্যস্থ সেই কয়েক হাজার বছর ধরে, তারা অনেকে রাষ্ট্রীয় ভীতিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে। এর ফলে সেবামূলক সব প্রতিষ্ঠান, তা পুলিশ হোক আর চিকিৎসক হোক, লোকজনের আচরণ হয়ে পড়েছে ভীতি নির্ভর ও অনুনয়মূলক। এটা বাংলাদেশিদের দৈহিক আচরণেও প্রভাব ফেলেছে।

আমাদের আশপাশে যেসব হতবাক করে দেবার মতো নৃশংসতা, সহিংসতা ঘটছে, তাও ঘটছে ভীতি ও অপরাধবোধ থেকে তৈরি হওয়া দায়িত্বহীনতা থেকে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দায়িত্বহীনতা দেখাচ্ছে একভাবে, আর নিম্নবিত্ত দেখাচ্ছে আরেকভাবে, সব বিত্তের লোকই জানছে যে শাসক তার কথা শুনছে না। একজন কিশোর-কিশোরী দায়িত্বহীন হতে হতে এরকম ফাঁপা জায়গাতে চলে আসছে যে, যে কেউ যা কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, আর তা মাথায় নিয়ে এ ওকে পুড়িয়ে মারছে, চাপাটি চালাচ্ছে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা যদি ভেবে বসে থাকে যে, রাষ্ট্র ধর্মের জায়গা নিয়ে সেরকমভাবে ভয়, ভীতি দিয়ে দেশ চালাবে, তাহলে ১৯৪৭ এর ভুলটার শুধু পুনরাবৃত্তি নয়, ১৯১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে একেবারে অর্থহীন করে ফেলা হয়।

আধিকারবোধ অর্জন ও দেয়ার দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। ভয় দেখানোর জায়গাগুলোকে বারবার চিহ্নিত করলে তাও অধিকারের পথে হাঁটার সামিল। আর তুলনামূলকভাবে কোনো সমাজ ব্যক্তিকে অধিকার দেয়ার ফলে তাদের দায়িত্ববোধ বেড়েছে, সৃজনশীলতার বিকাশ হয়েছে, বিনোদনের বিচিত্রতার ব্যাপারে পারস্পরিক সহনশীলতা বেড়েছে তাও আমরা জেনে নিতে পারি।