
নিতির গল্প
উপন্যাস ৬
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : মে ০২, ২০২০
প্রথম বর্ষার ছোঁয়া পেলে গাছ যেমন সুশ্রী-সতেজ হয়ে ওঠে, প্রথম প্রেমের ছোঁয়া পেয়ে নিতিও তেমন লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছে। স্কুল মাস্টার বাবার মধুর শাসনের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে কোনো ছেলে নিতির প্রেমিক হয়ে উঠতে পারেনি। গ্রামের পরিচিত গণ্ডির বাইরে যে জগৎ, সে জগতের স্বাদ সে এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত পায়নি।
ঢাকার অচেনা পরিবেশে কোচিং করতে এসে তার জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে। গ্রামের সজীব সবজি শহরে আসলে যেমন মলিন হয়ে যায়, গাঁয়ের সবুজ পরশে যেমন কালো ছোপ পড়ে, নিতির জীবনেও তেমন ছোপ পড়েছে। পিতার শাসনের বাইরে বল্গাহরিণীর মতো বিশৃঙ্খল জীবন-যাপনা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।
গ্রামের মেয়েরা শহরের মেস, হোস্টেল দখল করে নেয়। বাঁধা জীবনের বাইরে এসে তারা মুক্তির সন্ধান পায়। এ মুক্তি কারো জীবনে আলো নিয়ে আসে, কারো জীবনে আঁধার। মুক্তি সুখের হয়, আবার দুখেরও হয়। খাঁচার পাখি নিশ্চিত খাদ্য ও নিরাপদ বাসস্থান পায়, পাশাপাশি হারায় আকাশে উড়বার স্বাধীনতা। বনের পাখির কাছে মুক্ত আকাশ থাকে, কিন্তু নিশ্চিত খাদ্য ও নিরাপদ বাসস্থান থাকে না।
জীবনের প্রতিমুহূর্তে প্রতিটি কাজে দুটি ফল লাভ হয়। `প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।` গ্রামের মেয়েদের শহরে যে স্বাধীনতা আছে তারও উপকার-অপকার দুই-ই আছে। এই স্বাধীনতা পেয়ে কারো জীবন উন্নত হয়, কোনও কোনও মেয়ে উচ্ছন্নে যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে আরো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। কত ছেলে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, তার হিসাব কে রাখে।
ওদের সকালের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। নিতি উঠে ওর ঘরে চলে এল। বুকস শেল্ফ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ বের করে নিল। এর আগেও গল্পগুচ্ছের বেশ কিছু গল্প পড়েছে। আজ পড়তে শুরু করল `মানভঞ্জন` গল্পটি। দীপ মোবাইল নিয়ে বসল। ওর মন চঞ্চল। নিতির সঙ্গ পেতে শরীরে একটা তীব্র তাড়না অনুভব করছে। কিছুই ঠিক করতে পারছে না। একবার ফেসবুকে, একবার হইচই অ্যাপে, একবার ইউটিউবে ঢুকছে। শেষমেশ হইচই এর `একেনবাবু` সিরিজ দেখতে শুরু করল।
বাসার দুটি প্রাণ দুটি রুমে বসে দুই ধরনের কাজে ডুব দিল। কিছুক্ষণ পর দুই প্রান্তের দুজনেই দুটি গল্পের চরিত্রের মধ্যে নিবিষ্ট হলো। একজন `মানভঞ্জন` গল্পের গিরিবালার দুঃখে কাতর হলো। অন্যজন একেনবাবু গল্পের বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের কথা ভাবছে। বাপ্পাদিত্য, সংক্ষেপে বাপি বাবু ব্যাচেলার মানুষ। সুদর্শন ও স্মার্ট। অথচ কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই। দীপ নিজেকে বাপি বাবুর জায়গায় বসিয়ে নিল। তারও তো গার্ল ফ্রেন্ড থেকেও নেই। যে মেজাজ!
নিতির মানভঞ্জন গল্পের শুরুতে গিরিবালার জন্য যে কষ্ট হচ্ছিল, শেষ হবার পর সে কষ্ট থাকল না। বরং গোপীনাথের জন্য অনুকম্পা হলো। যে গিরিবালাকে সে দুপায়ে ঠেলেছে, যে গিরিবালা স্বামীর অবহেলা, অনাদরে, কুলবধু থেকে থিয়েটারের নটি হয়েছে। একজন মনোরঞ্জনকারিনী হয়েছে। সেই গিরিবালার প্রেমে তাণ্ডব করে গোপীনাথ পুলিশের হাতে আটক হলো। গোপীনাথ না পেল কুলবধু গিরিবালার প্রেমের স্পর্শ, না পেল মনোরঞ্জনকারিনী গিরিবালার প্রণয় স্পর্শ। সত্যিকার ভালোবাসার মর্যাদা না দিতে পেরে গোপীনাথের জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল।
এ ভাবনার পর নিতির মনে সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে এক অসহনীয় উদ্বেগ এসে ভর করল। নিতির মনে হতে থাকল। আমি কি তাহলে দীপকে অবহেলা করছি? অনুরাগে অবহেলার কারণে গিরিবালা যেমন গোপীনাথকে ছেড়ে চলে গেছে, দীপ কি তেমনভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
নিতি দীপকে হারাতে চায় না। আবার নীতিবোধকেও হারাতে চায় না। বর্তমানের দীপ ও পূর্বাশ্রমের সংস্কার, নিতিকে ক্রমাগত মানসিক উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তার চিন্তা-ভাবনার ক্রম পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। নিতি এ অসহ্য অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি চায়। রবীন্দ্রনাথ দিতে পারবে সে মুক্তি? নিতি আবার গল্পগুচ্ছ হাতে তুলে নিল। পড়তে থাকল নতুন কোন গল্প। চলবে
১ মে ২০২০