
অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
নিতির গল্প
উপন্যাস ৮
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : মে ০৪, ২০২০
নিতি ঘন্টাখানেক গল্পগুচ্ছ পড়ল। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলে ফোন তুলে নিল। মা ফোন করেছে। মা যদি প্রশ্ন করে কোথায় আছিস, মাকে কি বলবে নিতি? নিতির বুক কেঁপে উঠল। এমন নয় যে, নিতি কখনো মিথ্যা বলে না, বা মায়ের কাছেও কখনো মিথ্যা বলেনি। ঢের বলেছে।
ছোট ভাই হলে বাড়িতে প্রথম যখন তার আদর-অধিকার কমে গেল, তখন প্রায় লুকিয়ে ছোটভাইকে চিমটি দিয়ে পালিয়ে যেত। মা বুঝতে পারত না। কোথাও লাল হয়ে গেছে দেখলে অতিক্ষুদ্র অজানা কোনও পিঁপড়ার উপর মায়ের সমস্ত গালি বর্ষিত হতো। একদিন মায়ের কেমন যেন সন্দেহ হলো। সে নিতিকে কাছে ডাকল, আদর করে নিতিকে কোলের মধ্যে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, নিতি মা, তোমার কি ভাই হয়েছে বলে রাগ হয়? তুমি কি তাকে চিমটি কেটে পালিয়ে যাও?
নিতি ভয় পেয়ে গেল। মা নিতির ভয় পাওয়া মুখ দেখে যা বোঝার ছিল বুঝে নিল। নিতি সজোরে ঘাড় নাড়িয়ে বলল, না, আমি ভাইকে ভালোবাসি। আমি ওকে কাঁদাতে যাব কেন?
মা নিতিকে বেশি কিছু বললেন না। বকলেন না। বেশি উপদেশও দিলেন না। শুধু মিষ্টি করে হেসে বললেন, বেশ, এ তো খুব ভালো কথা। ঠিকাছে, তুমি তাহলে একটা কাজ করো, ভাইয়ের স্নানের সময় হয়েছে, আমি জল গরম করতে যাচ্ছি, এই ফাঁকে তুমি ভাইয়ের গায়ে তেল মাখিয়ে দাও।
নিতি ধরা পড়ে বাঁধা পড়ে গেল। এখন না বলার উপায় নেই। সে ভাইকে কোলে তুলে নিল। রোদে এসে বসল। ভাইয়ের নরম শরীরে আস্তে আস্তে সরিষার তেল মাখিয়ে দিতে লাগল। ভাইটি কাঁদল না, বরং দিদির কোলে শুয়ে হাত-পা নেড়ে, হেসে, ভালোবাসা প্রকাশ করতে থাকল। নিতি ভাইয়ের হাসি, হাত-পা ছোটাছুটি, দিদির কোলে এসে অসীম আনন্দ দেখে ভাইকে ভালোবেসে ফেলল। ভাইয়ের উপর সমস্ত ঈর্ষা, ক্রোধ, ভালোবাসা ভাগ হওয়ার বেদনা, সব নিমিষে উড়ে গেল। এই ছোট্ট মানুষটি তার দিদির ছোট্ট হৃদয় একমুহূর্তে জয় করে নিল।
এরপর সর্বক্ষণ নিতির সঙ্গী হয়ে উঠল তার ভাই। ক্রমে ভাইয়ের স্নান, খাওয়া, ঘুমপাড়ানো এক অদৃশ্য কারণে নিতির অধিকারে এসে দাঁড়াল। এমনকি তার ভাইয়ের যত্ন তার মা করলেও নিতির রাগ হতো, অসহ্য লাগত। ছোট্ট নিতি তার ছোট্ট দুটি হাতে ভাইকে আগলে রাখত। ভাই তার বুক জুড়ে থাকত। এ ঘটনার বেশ কয়েকবছর পরে, এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক এসেছে নিতিদের বাড়ি। নিতির মা স্নান করতে নদীর ঘাটে গেছে। বাড়িতে নিতি ও তার ছোট ভাই। বৃদ্ধা কেঁদেকেটে একটা শাড়ি চাইল। নিতি কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। মা-বাবা বাড়িতে নেই। এদিকে বৃদ্ধার অশ্রু সংবরণ হচ্ছে না। নিতির চোখে জল চলে এল। সে মায়ের সদ্য কেনা একটা আটপৌরে শাড়ি তুলে দিল বৃদ্ধার হাতে। বৃদ্ধা জগৎ-সংসারের সমস্ত আশীর্বাদ এই দুই ছোট প্রাণকে করতে করতে নিতিদের বাড়ি ত্যাগ করল। নিতি মনে মনে খুশি হলো, পরমুহূর্তেই একটা দুশ্চিন্তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মা কে কি বলবে?
মা স্নান সেরে বাড়িতে এল। কাপড় পরতে গিয়ে নতুন কাপড়টি পেল না। নিতির কাছে প্রশ্ন করল। নিতি মায়ের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, সে শাড়ির বিষয়ে কিছু জানে না। মা সন্তানের মুখ দেখলে অনেক কিছু বুঝতে পারে। প্রকৃতি পৃথিবীর সমস্ত মাকে এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। মা যখন সন্তানের মুখ দেখে অনেক কিছু বুঝেও মুখ ফুটে কিছু বলে উঠতে পারে না, প্রকৃতি তখন দূর থেকে সে দৃশ্য দেখে মুখ টিপে হাসে। মা ও প্রকৃতির এই মধুর দ্বন্দ্ব আমাদের সামান্য চোখ দিয়ে দেখা যায় না, সামান্য কান সেই তুমুল দ্বন্দ্বের শব্দ শুনতে পারে না। এমনকি কত মা, কত বিষ হৃদয়ে ধারণ করে মুখে হাসি বজায় রাখে, তাও আমাদের কাছে ধরা পরে না। মা সর্বংসহা, তার সন্তানের ভালোর জন্য।
এটা ছিল নিতির দ্বিতীয় মিথ্যা। মায়ের কাছে, তার সবচেয়ে নির্ভরতার কাছে। মাও এই শাড়ি উবে যাবার আশ্চর্য ঘটনা বাবার কাছে বললেন না। পাছে গোল বাঁধে। সামান্য বেতনের স্বচ্ছল স্কুল মাস্টার স্বামীর স্ত্রী, তার পুরান শাড়ি পরেই রান্না ঘরে চলে গেল।
এরপর যেদিন নিতি ভাইকে গ্রামে রেখে ঢাকায় কোচিং করতে এল, সেদিন আরেকবার মাকে মিথ্যা বলতে হলো। ভাইকে ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে আসার সময়, নিতির দু`চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। মা দু`চোখের অশ্রু গোপন করে, মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে উঠল, কিরে, ভাইয়ের জন্য মন কেমন করছে?
নিতি সশব্দে ঘাড় নাড়িয়ে বলল, না। আমার চোখে কিছু একটা পড়েছে। মা-মেয়ের এই মিথ্যা অভিনয়টুকু কাছে দাঁড়িয়ে ভাই দেখল। সে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সে উভয়ের কথা বিশ্বাস করল। আরেকজন উপর থেকে সমস্ত দেখে আবার মুখটিপে হেসে উঠল। সে সব বুঝতে পেরেও নির্বিকার থাকে। কিন্তু মা-মেয়ে উভয়ে জানল, কত বড় আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে দুজনকে।
আজ অনেকদিন পর আবার কি মায়ের কাছে মিথ্যা বলতে হবে নিতিকে? নিতির গলা শুকিয়ে আসল। বুকের ভেতর কি যেন ধরফর করে নড়তে থাকল। দু-চোখ জলে ভিজে গেল। ফর্সা মুখ নিমিষে কালো বর্ণ ধারণ করল। প্রথমবার কল কেটে গেল। দ্বিতীয়বার কল এলে নিতি রিসিভ করে বলে উঠল, হ্যালো। মা অপরপ্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠল, কিরে, শরীর খারাপ হয়েছে? গলাটা ধরা ধরা লাগছে যেন। নিতি এবারও মিথ্যা বলল, মায়ের কাছে বলল, হ্যাঁ, একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। শুয়ে আছি। মা কোথায় শুয়ে আছিস সেটা প্রশ্ন করল না। মায়ের বিশ্বাসী মন সে প্রশ্ন করার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি। বিস্তর পরামর্শ দিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজেছে কিনা শুনে, ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে নিষেধ করে, নিজের জানা ওষুধের নাম বলে, মা উৎকণ্ঠিত চিত্তে ফোন রেখে দিল। নিতির চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই থাকল। মা-মেয়ের এই অন্তরের টান, অশ্রু বর্ষণ, দীপ দেখতে পেল না। দেখতে পেলেও কিছু বুঝতে পারত না। তার এখন এসব বোঝার মতো মনের অবস্থা নেই। চলবে
৩ মে ২০২০