নিতির গল্প

উপন্যাস ১৩

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ০৯, ২০২০

রাধার কথা শুনে নিতিশ বাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে ভাবলেন। তারপর হঠাৎ নিতিশ বাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। রাধাকে ডেকে বললেন, রাধা মা, তুমি তো জানো, আমি যথাসাধ্য তোমার সহযোগিতা করি। তোমার নিতি দিদির কাছে গত সপ্তাহে টাকা পাঠিয়েছি। এখনো বেতন পাইনি। হাতে টাকাও নেই। তবে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না মা। তোমাদের ইংরেজি শিক্ষক সুমন বাবুর সাথে আজই কথা হলো। তিনি ছাত্রদের ফরমফিলাপের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে চান। তুমি একটিবার সুমন স্যারের কাছে যাও। তিনি তোমাকে সহযোগিতা করবেন। তুমি দেরি করো না মা। এখন গেলে সন্ধ্যার আগেই তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে।

নিতিশ বাবুর কথা শুনে রাধা খুশি হলো, কিন্তু মুখে হাসি ফুটল না। একটা দ্বিধা কাজ করছে মনে। তবুও নিতিশ বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুমন স্যারের বাসায় যেতে উদ্যোগী হলো।

নিতিশ বাবু ছোট থেকে রাধাকে বাড়ির ব্যাচে পড়াচ্ছেন। কখনো টাকা নেননি। রাধার বাবা ডেইলি লেবার। বাজারে একটা ইউরিয়া সারের ডিলার আছে কার্তিক বাবুর, সেখানে কাজ করে। কার্তিক বাবু বেজায় কৃপণ। রাধার বাবা সেখানে টাকা চেয়েছিল। পায়নি। উল্টো কার্তিক বাবু রাধার উদ্দেশে বলেছে, মেয়েকে এত পড়িয়ে কি হবে, কাঁচা বয়স। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দে।

রাধার মা মানুষের বাসায় ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে। সেও চেষ্টা করেছিল। যে যে বাসায় কাজ করে, সেখান থেকে এক-দু’মাসের অগ্রিম নিতে চেয়েছিল। তারাও দেয়নি। গরিবকে কেউ বিশ্বাস করে না। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে রাধার দাদার জন্য টাকা তুলে দিতে হয়েছিল। সেখানেও সম্ভব না। রাধার দাদা নেশা করে। সে বোনকে কিছু দেয় না। বরং সুযোগ পেলে দু`চারটে কিল ঘুষি পিঠের উপর দিয়ে দেয়। যখন টাকা আসার সম্ভাব্য সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল, তখন রাধা নিরুপায় হয় সুমন স্যারের বাড়ির পথে পা বাড়াল।

সুমন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিল রাধা। অকারণে হাত ধরত। গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেছিল। রাধা সামলে নেয়। এরপর আর যায়নি। কেন যায়নি, সেকথা কাউকে বলেওনি। বলে কি হবে? মেয়েদের কথা ক`জন বিশ্বাস করে? তার উপর যদি গরিব বাবার মেয়ে হয়। রাধা ভয়ে ভয়ে সুমন স্যারের বাড়ির দিকে চলছে। আর কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর সব রাস্তা এসে এই একটি রাস্তায় মিলিত হয়েছে। যে রাস্তার একমাত্র পথিক রাধা।

হাঁটতে হাঁটতে আধাঘণ্টা পর সুমন স্যারের বাড়ির গেটে পৌঁছাল। পুরানো বাড়ি। বিরাট সিংহ দরজা। একপাশে ভেঙে পড়েছে। বাড়িটার পরিধি অনেক বড়। চারদিক নিস্তব্ধ। গাছগাছালিতে ঢাকা বিরাট ভগ্ন প্রাচীরের বেষ্টনি। মধ্যে পুরান দিনের বড় দ্বিতল বাড়ি। যেন সমস্ত পৃথিবীর হাহাকার এসে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে।

বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। সুমন স্যারের মা-বাবা দেহ রেখেছে। এক বিধবা বৃদ্ধা পিসি আছে। সকাল-বিকাল সে-ই রান্না করে দেয়। এত বড় বাড়ি, অথচ দুই প্রান্তে মাত্র দুটি প্রাণের বসবাস। লক্ষ্মীছাড়া ভাব পুরো বাড়িজুড়ে।

রাধা সদর দরজা পার হয়ে বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়াল। সহসাই সুমন স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি আন্তরিকতার সাথে রাধাকে ভেতরে ডাকলেন। ঘরে এসে বসতে বললেন। রাধা রাজি হচ্ছিল না। সুমন স্যারের পিড়াপিড়িতে না বসে পারল না। সুমন স্যার রাধাকে রুমে বসিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।

একা এই পোড়োবাড়িতে রাধার গা ছমছম করছে। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ কোত্থেকে মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংস এনে হাজির হলো সুমন স্যার। রাধা সসংকোচে না না বলল কয়েকবার। পেরে উঠল না। কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না সে। স্যারের জোরাজুরিতে মিষ্টি, কোল্ডড্রিংস খেতে বাধ্য হলো।

খাওয়া পর্ব শেষ হলো। রাধা চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে সুমন স্যারকে বলল, স্যার, ফরমফিলাপের টাকা যোগাড় করতে পারিনি। নিতিন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। স্যার আপনার কথা বললেন, তাই...

সুমন বাবু রাধার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ও এই ব্যাপার। বেশ করেছ। কোনো অসুবিধা নেই। এই বলে চেয়ার থেকে উঠলেন। দ্রুত হাতে আলমারি খুললেন। ফরমফিলাপের টাকাটা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। রাধার মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল। স্যারের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকল। তারপর মুখ ফুটে বলল, স্যার কোন মুখে যে আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিব। বলে চেয়ার থেকে উঠল। স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে মাথা নিচু করল।

রাধার মুখে প্রশান্তির হাসি। চোখে কৃতজ্ঞতা। সুমন স্যারের হাসির রহস্য বোঝা গেল না। তার চোখেমুখে বিশ্বজয়ের আনন্দ। তিনি বলে উঠলেন, আরে আরে করে কি, তোমার স্থান কি পায়ে? বলে রাধার দু`হাত ধরে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। রাধা এক মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেল। শিহরিত হয়ে সরে যেতে চাইল। স্যারের দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে পারল না। সুমন স্যার জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। স্যার যখন বাহু আলগা করলেন, তখন মনে মনে পিতার উষ্ণ আলিঙ্গন অনুভব করল রাধা। মনে সান্ত্বনা নিল, কি হয়েছে, শিক্ষক তো পিতারই মতো। সে এখন সেই নিষ্পাপ স্নেহের বন্ধন থেকে মুক্ত। টাকাটা টেবিলের উপর থেকে হাতে নিয়ে বলে উঠল, স্যার, এবার তাহলে আসি।

স্যার হাসিমুখে বললেন, এখনি যাবে কেন? সবে তো এলে। কতদিন আসোনি। সেই কবে প্রাইভেট পড়তে পড়তে চলে গেলে। আর এলে না। রাধা মনে মনে লজ্জা পেল, আর স্যারকে অহেতুক খারাপ ভেবেছে ভেবে নিজেকে নিচু মনের মনে করতে থাকল। রাধা স্যারের কথা উপেক্ষা করতে পারল না। চেয়ারে স্যার বসে আছে দেখে খাটের এক কোনায় এসে বসল। চলবে

৮ মে ২০২০