নিতির গল্প

উপন্যাস ১৫

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১১, ২০২০

রাতে খাওয়া হয়নি রাধার। মা কয়েকবার ডেকেছিল। মেয়ের গভীর ঘুম সে ডাক শুনতে পায়নি। সকালে যখন রাধার ঘুম ভাঙল, তখন গায়ে চাপা ব্যথা। ঠোঁটের কোনাটা ফুলে উঠেছে। অন্যস্থানেও আঘাত অনুভব করতে পারল। এখনো মৃদু ব্লিডিং হচ্ছে। রাধা সেটা টের পাচ্ছে।

মা ঘরে এসে মেয়েকে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঠোঁট কাটল কি করে?
রাধা নত মুখে বলল, টিউবওয়েলের হাতল ছুটে লেগেছে।

মায়ের কথাটা বিশ্বাস হলো। বেশ কিছুদিন ধরে কলে ভালো জল উঠছে না। গরম পড়ার পর থেকে কলের জলও শুকিয়ে আসছে। যাদের মটর আছে তাদের চিন্তা নেই। যাদের তা নেই তাদের কয়েক মাস জলকষ্টে থাকা লাগবে। রাধাদের কষ্ট সব সময়। শীতে ঠাণ্ডার কষ্ট। গরমে গরমের কষ্ট। বর্ষায় চাল চুইয়ে জল পড়ে ঘর ভেজার কষ্ট। এদের কষ্টের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই।

মা বলে উঠল, কালাম ডাক্তার আজ বিকেলে বাজারে বসবে। একবার যাস তার কাছে।
রাধা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না। সর্বশরীর নির্বল হয়ে গেছে। তবুও উঠতে হলো। বালতিতে মা জল তুলে রেখেছিল। সেটা নিয়ে একটু দূরে বাঁশবাগানের দিকে হেঁটে গেল।

বাঁশঝাড়ের পাশে একটু আড়ালে তাদের পায়খানা। সুপারি পাতার বেড়া। দরজা নেই। সামনে সারের বস্তা দিয়ে ঢাকা। সিমেন্টের একটা প্যান আছে, তবে জল আটকানোর ব্যবস্থা নেই। নিচ থেকে কটু গন্ধ ভেসে আসছে। মাছি ভনভন করছে। উপরে পাটকাঠির চাল। চারটা পুরান বাঁশের খুঁটির উপর ভর দিয়ে টিকে আছে।

রাধা এই পূতিগন্ধময় পায়খানা থেকে বেরিয়ে কলপাড়ে এলো। একটা বল সাবানের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে হাত ধুয়ে নিল। মা রান্নাঘরে। শোবার ঘর থেকে একটু দূরে রান্নাঘর। পাটকাঠির বেড়া। মাটির পোতা। পাটকাঠি-পলিথিনের চাল। বাঁশের চটার রেলিং করা দরজা। বাঁশের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে।

পাশাপাশি দুটি শোবার ঘর। টিনের একচালা। মাটির পোতা। কঞ্চির বেড়া। টিন বহুপুরোনো। শতছিদ্র। ঘর দুটোর সামনে একটা চিকন মাটির বারান্দা। ঘরে আসবাব তেমন নেই। দড়ি টাঙিয়ে কাপর রাখা। খাট বলতে বাঁশ পুতে চালা করা। একটা টিনের সোকেজ আছে। তাতে দারিদ্র্যের লক্ষণ স্পষ্ট।

সারা পাড়ার কারেন্ট থাকলেও এই বাড়িতে নেই। বিদ্যুৎ নেবার চেষ্টা করেছে। প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে সেটা হয়নি। বাবার গায়ের হাড় ক‘খানা গোনা যায়। অধিক পরিশ্রমে কৃশ শরীর মায়ের। দাঁতের উপরের পাটি বের হয়ে থাকে। মুখ পুড়ে পাণ্ডুর বর্ণ। সারা বাড়ি লক্ষ্মীছাড়া ভাব। দারিদ্র্যের ভীষণ চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

মা পরের বাড়ি কাজ করে। ঘরকন্যার কাজ রাধাকেই করতে হয়। মা বুঝতে পেরেছিল মেয়ে অসুস্থ। আজ সকালে ভাত রেঁধে রাখল। মুসুর ডাল, কলমি শাক আর মোটা চালের শক্ত শক্ত ভাত।

রাধার দাদা খারাপ ছেলেদের সাথে মেশে। নেশা করে। তার কারণে সংসারের হাল আরও খারাপ হয়ে গেছে। সে তো কোনও টাকা দেয়ই না, বরং সুযোগ পেলে বাড়িতে মা, বাবা, রাধাকে জিম্মি করে দু’একশো টাকা যা থাকে, কেড়ে নিয়ে চলে যায়।

অসুস্থ ক্লান্ত শরীর, অর্ধ উন্মদ ছেলে, আর জরা ক্লিষ্ট স্বামী নিয়ে মায়ের সংসার। এর মধ্যে একমাত্র আশা রাধা। সে ভালো ছাত্রী। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু তার জন্য কিছু করার উপায় নেই। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ায়। তাতে তার যে দু`চারশো টাকা হয়, তাও দাদার জন্য রাখার কায়দা নেই। চারদিক থেকে সবকিছু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।

এদিকে দীপ-নিতি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠে তাদের গতকালের মতোই খাওয়া, স্নান, বিশ্রাম চলতে থাকল। খুনসুটি, হাসাহাসিও চলতে থাকল। শুধু কাছে আসা হচ্ছে না। কোথায় যে বাধা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। তারা বুঝতে চাইছে। তবুও বুঝতে পারছে না। এক উদ্দেশ্যহীন জীবনের দিকে, সম্পর্কের দিকে, তাদের সময় বয়ে চলেছে।

যশোরে রাখি, মিলির বাড়িতে এসেছে। মিলির মা খুলনাতে তার কাকার বাসায় গেছে। রাতের ট্রেনে আসবে। বিকেলটা রাখি মিলির সাথে কাটাবে। এমন অনেক সকাল, দুপুর, বিকেল তারা একসাথে কাটিয়েছে। এটা নতুন নয়। নতুন আজ আয়ান আসবে। মিলিদের বাড়ি। আয়ানের সাথে আগেও অনেক দেখা হয়েছে। সেসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আজ একেবারে ভিন্ন মেজাজে। ফাঁকা বাড়িতে। এ এমন এক সময়, যখন দুজন দুজনকে কাছে পেতে সব করতে পারে। দুটি তরুণ-তরুণীর উদগ্র বাসনা এদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা হয়তো এরা নিজেরাও জানে না।

দুপুরে চারটে খেয়ে রাধা কালাম ডাক্তারের চেম্বারে এলো। বিকের হয়েছে। রুগী আসতে শুরু করেছে। ধীর পায়ে ডাক্তারের চেম্বারের এক কোনায় এসে বসল। গুটিসুটি মেরে। এমন ভাবে, যেন তার মুখটা সহজে দেখা না যায়। মাথায় ওড়না জড়িয়ে নিল। ঘোমটার মতো করে।

কালাম ডাক্তার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তবে জেনারেল প্র্যাকটিস করেন। এলাকার অসহায় গরিব রোগীর ভরসাস্থল। মুখে লম্বা দাড়ি। লম্বা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। মাথায় টুপি। আপাদমস্তক ধার্মিক। অন্তরে ও বাহিরে। উঁচু লম্বা মানুষটার চওড়া বুকের মতো, হৃদয়টাও প্রশস্ত। এখানে আসতে বড় রাস্তা থেকে মোড় নিয়ে ছোট রাস্তায় নামতে হয়। সেই সংকীর্ণ রাস্তার পাশে ছোট এক মোবাইল মার্কেট। সেই মার্কেটের আরো সংকীর্ণ গলির মধ্যে এই ক্ষুদ্র চেম্বার। রাস্তা দিয়ে দেখা যায় না। ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায়ও আলো জ্বালাতে হয়। এই অন্ধকার ঘুপসির মধ্যে এসে বসেন এক আলোকিত মানুষ।

কালাম ডাক্তার সপ্তাহে একদিন এই চেম্বারে আসেন। এখানে তার শ্বশুরবাড়ি। রাতে সেখানেই থেকে যান। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের জীবনে বড় আশীর্বাদ এই ডাক্তার। কিছুক্ষণ পর সিরিয়ালের ছেলেটা রাধাকে ডাকল। রাধা ডাক শুনে চেম্বারের ভেতর এলো। ডাক্তার সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, কি সমস্যা? রাধা ঠোঁট দেখাল, বলল, টিউবওয়েলের হাতলের বাড়ি লেগে কেটে গেছে। অন্য কিছু মুখ ফুটে বলতে পারল না। ডাক্তার তার চেনা। এর আগে বহুবার দেখিয়েছে। ভিজিট নেননি।

ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, কাছে টাকা আছে, এগুলো কিনতে পারবে? রাধা নতমুখে ঘার দুলিয়ে না বলল। মুখ থেকেও অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো, কাছে টাকা নেই। ডাক্তার সিরিয়ালের ছেলেটিকে ডেকে বললেন, রফিক, স্যাম্পলের ওষুধ থেকে এর ওষুধগুলো দিয়ে দাও। রফিক ওষুধ দিতে উদ্যোগী হলে, রাধা নত মুখে হাতটা বাড়িয়ে দিল। রাধা ওষুধ নিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছাল, তখন মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে। চলবে

১০ মে ২০২০