নিতির গল্প

উপন্যাস ১৭

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৩, ২০২০

দীপের চমকে ওঠার ব্যাপারটি নিতিও লক্ষ্য করল। দীপেক মুখে ভয়। চোখ দুটো ধরা পরা অপরাধীর মতো। হাতে মোবাইল। পরনে ট্রাউজার। গায়ে টি শার্ট। আলনাটা অগোছালো। পাপসের এক প্রান্ত মোড়ান। মশারি অবিন্যস্তভাবে পর্দার পাইপের খাঁজে গুজে রাখা। দুটো কোলবালিশ দীপের দুপাশে। তারা বাঁকা হয়ে নিজেদের জায়গা দখল করেছে। খাটের প্রান্তে, পায়ের কাছে কাঁথা। কাভার ছাড়া জড়ো হয়ে আছে। বিছানার চাদরটি দীর্ঘক্ষণ পরিপাটি হয়নি। জায়গায় জায়গায় ভাঁজ পড়ে রয়েছে। একটা এয়ারলাইন্স কোম্পানির ক্যালেন্ডার দেয়ালে ঝুলানো। পৃষ্ঠাগুলো ফ্যানের বাতাসে দুলছে। নতুন মাস পড়েছে। পৃষ্ঠা বদলানো হয়নি। ছাদের নীচে একটা টিউব লাইট। নির্বিবাদে জ্বলছে। এই কক্ষটিতে কোন নারীর হাতের স্পর্শ নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

নিতি দীপের মনোযোগ অাকর্ষণ করে বলল- তুমি একটু অন্য ঘরে যাও। ঘরটা গুছিয়ে দিই। দীপ কোন কথা বলল না। শান্ত ছেলের মতো অন্য ঘরে চলে গেল।

ওদিকে আয়ান মিলিকে ফোন দিয়ে জানাল, ও মেইন গেটে অপেক্ষা করছে। মিলি গেট খুলে ওকে ভেতরে নিয়ে এল। রাখি আয়ানের অপেক্ষায় বসে আছে। সদ্য সন্ধ্যা হয়েছে। বাড়ির সামনে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। এ বাড়িতে বেশ গাছগাছালি আছে। সন্ধ্যায় একটা আলো-আঁধারের ইন্দ্রজাল তৈরি হয়েছে।

বাড়িটি বড়। প্রাচীরের মধ্যে ছোট দ্বিতল বিল্ডিং। মিলি আয়ানকে নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল। চিকন সিঁড়ি। সিঁড়ির দুপাশে ঘর। অন্য পাশ ইটের উপর প্লাস্টার করে দু`ফুট উঁচু কার্ণিশ তোলা। সাবেকি ঢঙের।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রথমেই একটা ছোট ড্রয়িং রুম। এ রুমের মধ্য দিয়ে ওরা এগিয়ে গেল। কয়েকটা সোফা পাতা আছে। পুরান। কাভারগুলো বহু ব্যবহারে মলিন। কাঠের রঙ উঠে গেছে। দেয়ালের রঙ বিবর্ণ। কোথাও কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে। রাখি যে ঘরে বসে আছে, ওরা দু`জন সে ঘরে এল। দরজার চৌকাঠ ঘুনে খেয়ে গেছে। পাল্লায় ছোট ছোট কয়েকটা ছিদ্র।

রাখি খাটের উপর পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। আয়ানের চোখে চোখ পড়লে, ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে মুখ নিচু করল। মিলি `তোরা দু`জন এখানে গল্প কর, আমি নিচে হাতের কাজটা সেরে আসি` বলে দরজা টেনে চলে গেল। পুরান জংধরা কব্জায় ক্যাচ করে একটা শব্দ করে উঠল। রাখি উৎকর্ণ হলো।

মিলি যাবার পর আয়ান দরজার সিটকিনি তুলে দিল। পর্দাটা টেনে দিল। এমনভাবে, যেন পুরাতন দরজার ছিদ্র দিয়ে ভেতরের কিছু দেখা না যায়। জানালা আগে থেকেই বন্ধ। পর্দাও দেওয়া ছিল। আয়ান আরেকবার দেখে নিল। দেয়ালে একটা চিকন টিকটিকি লাইটের দিকে মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিকার ধরার অপেক্ষায়।

রুমে একটা খাট। রঙচটা স্টিলের আলমারি। বিছানার চাদর মলিন। বালিশের কভার দীর্ঘদিন ব্যবহারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। একটা কাঠের টেবিলের উপর পুরাতন একুশ ইঞ্চি রঙিন টিভি। পুরো টেবিল জুড়ে রয়েছে। একটা আলনা আছে। তাতে পুরুষ মানুষের কোন কাপড় নেই। মিলির বাবা মারা যাবার পর ওর মা একাই এ ঘরে থাকে। আগে বাবা-মা থাকতেন। আয়ান জানালা-দরজার পর্দা ঠিক করতে করতে আড়চোখে রাখিকে দেখছে।

সে রাখির পায়ের কাছে এসে বসল। রাখির পা ভাঁজ করা। কোলের উপর একটা মাথার বালিশ। রাখি আয়ানকে জিজ্ঞেস করল, আসার সময় পরিচিত কেউ দেখেনি তো? আয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল- আরে না, কে দেখবে? আর দেখলেই বা কি আসে যায়?

আয়ানের এই কথাটা শুনে রাখির মুখ কালো হয়ে এল। আয়ান সেটা লক্ষ্য করল। বলে উঠল, ভয় পাচ্ছ? রাখি ঘাড় নাড়ালো, হ্যাঁ। আয়ান বলল, আরে ভয়ের কি আছে? কেউ দেখেনি। বলে রাখির কোল থেকে বালিশটা সরিয়ে পাশে রাখল।

রাখি একটু নড়েচড়ে উঠল। আয়ান রাখির গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দু-বাহু দিয়ে রাখির গলা জড়িয়ে ধরল। রাখির দু`হাত আয়েনের দু`বাহুর নিচ দিয়ে গিয়ে আয়ানকে আলিঙ্গন করল। আয়ান চোখ থেকে চশমাটা খুলে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। টিকটিকি টিকটিক করে ডেকে উঠল। পাশের গাছ থেকে একটা বড় পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল। নিচ থেকে হাত ফসকে স্টিলের বাসন পড়ার একটা ঝনঝন শব্দ উপরে উঠে এল।

দুজন একটু উৎকর্ণ হয়ে আবার নিজেদের মনে ডুব দিল। আয়ানের ঠোঁট রাখির অধর চুম্বন করল। অনেকক্ষণ। একে অপরের মুখ ঠেসে ধরে থাকল। রাখির দাম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। আয়ান সেটা টের পেল। রাখির অ্যাজমা আছে। আয়ান মুখ সরিয়ে নিল। তখন কান, ঘাড়, কপাল, চোখ, চিবুক, গলা ঘুরে ঘুরে চুম্বনের ছাপ পড়তে থাকল। একে অপরকে দু`হাতে জড়িয়ে অপর্যাপ্ত চুম্বনে ভরিয়ে তুলল। দু`জনের চোখ বোজা। মাঝে মাঝে চোখের পাঁপড়ি নড়ছে।

হঠাৎ একটা টিকটিকি ওদের গায়ে লাফিয়ে পড়ে অন্যত্র চলে গেল। দু`জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকল। ঢং ঢং করে আটটা শব্দ করে ঘড়ির পেন্ডুলাম নড়ে উঠল। পাশের রাস্তা দিয়ে একটা মটোর সাইকেল হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। কয়েকজন পথ চলতি মানুষের কলরব শোনা গেল। তারপর আবার সব শান্ত। কিছুক্ষণের আড়ষ্টতা ভাঙলে আবার দু`জন কাছাকাছি চলে এল। আয়ান রাখির ওড়নাটা সরিয়ে খাটের পাশে ফেলে দিল। রাখি আয়ানের টিশার্ট কোমড়ের কাছ থেকে ধরে উপর দিকে নিয়ে টেনে খুলে ফেলল।

আবার চুম্বন। আবার অবিশ্রান্ত আদর। রাখি হেলান দিয়ে বসে ছিল। ধীরে ধীরে মাথা বালিশের উপর রাখল। আয়ান ঝুঁকে পড়ে রাখির কামিজ সরিয়ে নিল। উন্মুক্ত নাভিতে ঠোঁট ছোঁয়াল। রাখি ঝিঝি লাগার মতো করে কেঁপে উঠল। আয়ানের ঠোঁট ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। ওর একটা হাত, কামিজের প্রান্ত জড়িয়ে জড়িয়ে উপরের দিকে তুলছে। অন্য হাত চুলে বিলি কাটছে। রাখির চোখ বোজা। মুখ দিয়ে মৃদু শব্দ করে উঠল। আহ্। রাখি নিজেই উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেল শরীর। গলাটা সোজা হয়ে মাথা পেছনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

আয়ান উপরের পেট থেকে ঠোঁট সরিয়ে গলায় নিয়ে এল। রাখি নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। আয়ানকে হাতের নাগালে পেয়ে আবার জড়িয়ে ধরল। রাখির নখগুলো আয়ানের পিঠে ক্রমাগত আঁচড় কাটছে। কখনো দৃঢ় মুষ্টিতে পিঠে আঘাত করছে। আঘাতে প্রত্যাঘাতে, প্রেমে চুম্বনে, দু`জনের শৃঙ্গার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। দু`জনের বুক একে অপরের সাথে ঠেকে আছে। কামিজর মোড়ানো অংশ দেয়াল হয়ে চরম স্পর্শ থেকে বাঁধা দিচ্ছে। আয়ান রাখিকে টেনে বসিয়ে নিল। দু`হাত দিয়ে কামিজটা ধরল। গলা দিয়ে গলিয়ে শরীর থেকে আলাদা করে ছুঁড়ে ফেলল। রাখি বাধা দিতে চেষ্টা করল। সে বাধায় জোর নেই, আলস্য আছে। নিজেকে বেঁধে রাখার ইচ্ছাও নেই। দূরের মাইকে থেকে একটা ঘোষণা ভেসে আসছে। কারো মেয়ে হারিয়ে গেছে। চার বছর বয়স। শব্দ একটু কাছে আসতে আসতে আবার দূরে চলে গেল। উপরের ফ্যানে ঘড়র ঘড়র আওয়াজ হচ্ছে। পুরান ন্যাশনাল ফ্যান।

রাখির বুকে শুধুই অন্তর্বাস। উন্নত বুক উঁচু হয়ে আছে। আবার দু`জন দু`জনকে জড়িয়ে ধরল। রাখির ঠোঁটের লিপস্টিক একেবারে মুছে গেছে। আয়ান নিচের ঠোঁটে হালকা কামড় বসাল। রাখি উহ্ করে শব্দ করে আয়ানের পিঠে কামড় বসাল। রাখি আয়ানের স্যান্ডোগেঞ্জি দু`হাত ধরে টেনে খুলে ফেলে দিল। আয়ান পিঠে হাত দিয়ে অন্তর্বাসের হুক খুলল। হুক খোলা অন্তর্বাস ধীরে ধীরে অাপনা থেকে আলগা হয়ে রাখির কোলের পাশে পড়ে রইল। রাখির উন্নত বুক। স্তনের বাদামী শক্ত বোটা আয়ানের বুকের সাথে ঠেকে অনুভূতির চরম মুহূর্ত এনে দিল। দু`জন খাটের উপর নিজেদেরকে শক্ত করে ধরে, এপাশ ওপাশ গড়াতে থাকল।

হঠাৎ দরজায় টোকা। মিলি দরজার বাইরে থেকে বলছে `রাখি, আন্টির ফোন ধরছিস না কেন? তোকে না পেয়ে আমাকে কল করছিলেন। আমি বাথরুমে আছে বলেছি। তিনি বের হলে তোকে ফোন করতে বলেছেন।`

রাখি বলল, আচ্ছা, ফোন করছি। বলে নিজেকে সামলে নিল। কামিজটা নিয়ে বুকে বাম হাত দিয়ে চাপা দিল। ডান হাতে মোবাইল নিয়ে লক খুলল। ফোন করতেই ওপ্রান্ত থেকে মায়ের হুংকার শোনা গেল। `কি ব্যাপার, রাত সোয়া আটটা বাজে এখনো বাড়ি এলে না। এখনি বাড়ি রওনা দাও। এক মুহূর্ত যেন দেরি না হয়।` রাখিকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না মা।

রাখি মুহূর্ত বিলম্ব না করে আয়ানের দিকে পেছন দিয়ে অন্তর্বাসের হুক এঁটে নিল। একই পজিশনে থেকে কামিজ পরে আয়ানের মুখের দিকে তাকাল। আয়ান ঝড়ের কবলে পড়া পাখির মতো চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাখি ঝটপট ব্যাগ থেকে ট্যিসু বের করে মুখ মুছে, লিপিস্টিক লাগিয়ে নিল। ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে নিল। এরপর ওড়না গায়ে জড়িয়ে, ব্যাগ হাতে নিয়ে, আয়ানকে লক্ষ্য করে বলল- আসছি, ফোনে কথা হবে।`

আয়ান আদুল গায়ে দরজা দিয়ে রাখিকে বের হতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর স্যান্ডোগেঞ্জি, টিশার্ট পরে নিচে মিলির কাছে নেমে এল।

এদিকে নিতি দীপের ঘর গুছিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে। সে ভেবে রেখেছে এরপর দীপের ফেসবুক পোস্টের বিপরীতে আর পোস্ট করবে না। এটাই তার এই ইদুর-বিড়াল খেলার শেষ পোস্ট। এরপর যা বলবে খোলামেলা, সামনাসামনি। নিতি দীপের জন্য লিখল-

ভালোবাসা। প্রেম। প্রণয়। অনুরাগ। আসক্তি। কামনা। আর যা যা নাম দেওয়া যায়। দিয়ে দিন। বিষয়টা কিন্তু একই। বিষয়টা মায়া। আবেগ। পিটুইটারি গ্রন্থির ভ্রম।

যেমন আগুন জ্বালাতে হলে দাহ্য বস্তুর প্রয়োজন হয়। তেমনি এই প্রণয়ের জন্য প্রয়োজন হয় প্রেমিক মনের। প্রেমিক মন যখন তার সঙ্গী খুঁজে পায়, তখন অাগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। দু`টি তৃষিত প্রাণ একে অপরের সাথে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়।

প্রতিটি জীবসত্তার মধ্যে, সৃষ্টির শুরু থেকেই এই মিলনের আকাঙ্খা সুপ্ত আছে। উপযুক্ত পাত্র-পাত্রি পেলে কখনো তা পূর্ণতা পায়, কখনো সামাজিক-পারিপার্শ্বিক বাধায় অপূর্ণ থেকে যায়।

চাওয়ার প্রাণটি কাছে পেলেই সফলতা হবে, আর না পেলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে এমন নয়। কারণ, আজ যা সুখ বলে মনে হচ্ছে, অচিরেই তার থেকে দুঃখের উৎপত্তি হবে। আজ যা আলো মনে হচ্ছে, দাহ্য বস্তুর অনুপস্থিতিতে অচিরেই তা অন্ধকারে পর্যবসিত হবে। আজ যে শরীর শক্তিতে পরিপূর্ণ, বার্ধক্যে সেই শরীরই শক্তিহীন হয়ে যাবে। পরস্পর বিপরীতধর্মী সত্তা সর্বদা আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। এটাই মায়া। এটাই ভ্রম।

নারী-পুরুষের সঙ্গ লিপ্সা তেমনি এক মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এক মুহূর্তে যা মহার্ঘ মনে হয়, পর মুহূর্তেই তা অসহ্য মনে হতে পারে। যে খাবার গ্রহণ করে প্রাণ আহ্লাদিত হয়, সে খাবারই বর্জে রুপান্তরিত হয়। এটাই মায়া।

আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে যা অনুভব করি, তার বাইরেও কিছু থেকে যায়। আমাদের ইন্দ্রিয়ের স্বল্পতার দরুণ আমরা সেই না জানা বিষয়টা বুঝতে পারি না, না দেখা বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারি না। এটাই মায়া।

নারী-পুরুষ এই মায়ার প্রভাবে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একে অপরের সাথে মিশে যেতে চায়। কিন্তু এই মায়ার বিপরীতমুখী সত্তার করণে তারা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।

আমরা যা গ্রহণ করি, সময়ে তা বর্জন করতেই হয়। এই গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে মায়া আমাদেরকে সংসারে বেঁধে রেখেছে।

এই মায়ার প্রভাবেই নারী-পুরুষ শত দুঃখ পেয়েও দূরে থাকতে পারে না। আবার পুরোপুরি কাছে আসতেও পারে না। ক্রমাগত অাকর্ষণ-বিকর্ষণের দ্বৈত সত্তা আমাদের জীবনে বয়ে চলে। এমন কি এই বিশ্বজগতও তার ব্যতিক্রম নয়।

এই মায়া প্রেম সৃষ্টি করে, আবার ঘৃণাও সৃষ্টি করে। এই মায়া বন্ধন সৃষ্টি করে, আবার বিচ্ছেদও সেই সৃষ্টি করে। এই মায়া অহংকার সৃষ্টি করে, আবার নিরহংকারী হতে সেই সাহায্য করে।

মায়া চোখে দেখা যায় না। এমনকি অন্তর দিয়ে উপলব্ধিও করা যায় না। তবুও তার অস্তিত্ব আছে। কোন এক অদৃশ্য শক্তির বলে মায়া আমাদের জীবনে তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

এই মায়ার কারণে সন্তান দুঃখ দিলেও মা সন্তানকে অভিসম্পাত করতে পারে না। এই মায়ার কারণে প্রতিটি মানুষ মারা যাবে জেনেও, তারা এমন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে যেন তারা চির অমর।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই মায়াকে বুঝতে চেষ্টা করেছে, নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি।

এই মায়ার প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `মহামায়া` গল্পের রাজীবলোচন মহামায়ার প্রেমে পড়ে। মহামায়া কুলিন। রাজীবলোচন কুলিনশ্রেণীর নয়। তবুও তাদের প্রণয় প্রত্যাশি হৃদয় কাছাকাছি আসে। পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে। যে মায়া প্রেম হয়ে তাদেরকে কাছাকাছি আনে।

সেই মায়া অহংকার হয়ে ভবানীচরণের কৌলিন্যকে জাগিয়ে তোলে। ঘাটের মরা কুলিনের সাথে মেয়ের বিবাহ দিতে বাধ সাধে না। এমনকি মিথ্যা স্বর্গ প্রাপ্তির আশায়, কূলরক্ষার কামনায়, সুন্দরী তরুণী, বিয়ের পরদিন বিধবা হওয়া মেয়েকে, চিতায় তুলতেও তার এতটুকু দ্বিধা হয় না।

মায়া বড় বিষম বস্তু। এই মায়া বৃষ্টির জলে নিভে যাওয়া চিতা থেকে বেঁচে যাওয়া মহামায়াকে তুলে আনে রাজীবলোচনের গৃহে। আবার এই মায়ার টানেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে রাজিবলোচন চিতারোহণের আগুনে পুড়ে যাওয়া মহামায়ার মুখ দেখে ফেলে। তখন অভিমান নামক মায়া, মহামায়াকে রাজীবলোচনের ঘরে থেকে বের করে দেয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়।

মায়ার এই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি রূপ শুধু অবাকই করে না, বরং মানব মনে ভীতির সঞ্চারও করে। যদি তা নাই হয়, তবে স্ত্রী-স্বামীকে বা স্বামী-স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে কেন? বা সন্তান বৃদ্ধ পিতা মাতাকে পরিত্যাগইবা করে কি করে?

এত সব কিছু দেখে অামরা বুঝতে পারি সুখ প্রাপ্তির আশাই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে সুখের ইচ্ছা নেই, সেখানে দুঃখের সম্ভাবনাও নেই। তাই আমাদের সুখের কামনা নয়, বরং দুঃখ থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি তারই উপায় খুঁজতে হবে।

সে কারণেই ছেলে-মেয়েদের প্রণয় আকাঙ্খায় মা-বাবার বাধ সাধা ঠিক নয়। মা-বাবা সন্তানের ভালো চেয়ে যে সিদ্ধান্ত নেবে তা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। আবার দু`টি প্রাণ নিজে থেকে এক হবার যে ইচ্ছা পোষণ করে, তাও সঠিক না হতে পারে। সঠিক যে কি হবে তার অনিশ্চিত। এখানেই মায়ার মহত্ত্ব। সব প্রশ্নের মিমাংসা এখানেই এসে থমকে দাঁড়ায়।

নিতি যা লিখল, তার মর্মার্থ দীপ বুঝতে পারবে কিনা সে জানে না। তবুও লিখল। তবুও ফেসবুকে পোস্ট করে দীপকে ট্যাগ করে দিল। নিতি দীপকে চায়। এটা তার সুখের জন্য চায়। অথচ দীপকে হারাতে চায় না। দীপকে হারানোর ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। হয়তো এই ভয়ই দু`জনকে দু`দিকে সরিয়ে রেখেছে। নিতি এর বেশি ভাবতে পারছে না। মোবাইলটা পাশে রেখে দিল। চিৎ হয়ে শুয়ে, চলন্ত ফ্যানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। চলবে

১২ মে ২০২০