নিতির গল্প

উপন্যাস ১৯

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০২০

নিতিশ বাবু স্কুলে পৌঁছে সাইকেলটা সিঁড়ি ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলেন। স্কুলের মর্নিং অ্যাসেম্বলি হতে এখনো বেশ দেরি। প্রতিদিনের মতো আজও হেড স্যারের রুমে এলেন। রেজাউল সাহেবকে আদাব দিয়ে সামনের চেয়ার টেনে বসলেন। অন্যান্য দিনের মতো আজও পিওন চা এনে দিল।

এ স্কুলটি বেশ বড়। এল প্যাটার্নের দ্বিমুখী দ্বিতল ভবন। ভবনের সামনে কৃষ্ণচূড়া, বকুল ফুলগাছ। কয়েকটা আম ও লিচু গাছ রয়েছে। গাছগুলোর সামনে প্রশস্ত খেলার মাঠ। হেড স্যারের রুমটিও পরিপাটি করে সাজান। স্যারের সামনের দেয়ালে সুদৃশ্য দেয়াল ঘড়ি। ডানের দেয়ালে একটা ফ্রেমে বাঁধানো সরকারি ক্যালেন্ডার। হেড স্যারের পেছনের দেয়ালে মাথার উপরে সুদৃশ্য ফ্রেমে সরকার প্রধানের ছবি। বামের দেয়ালে বাংলাদেশ ও পৃথিবীর মানচিত্র। টেবিলের উপর প্ল্যাস্টিকের গ্লোব, একটা অ্যালুমিনিয়াম স্ট্যান্ডের সাহায্যে আটকানো। কিছু রেজিস্টার খাতা। জলভর্তি কাচের গ্লাস, সিরামিকের পিরিস দিয়ে ঢাকা। পেন স্ট্যান্ড। ডেস্ক ক্যালেন্ডার। স্কেল ও আনুষঙ্গিক অফিস স্টেশনারি।

চা পান করতে করতে দুজন কুশল বিনিময় শেষে দু`একটা অপ্রয়োজনীয় কথা বললেন। এরপর নিতিশ বাবু বিদায় নিয়ে শিক্ষক মিলনায়তনে যাবার উদ্দেশে চেয়ার থেকে উঠলেন। দু`পা এগোতে না এগোতেই রেজাউল সাহেব নিতিশ বাবুকে ডাকলেন। এরপর বললেন, বাবু একটু বসেন। একটা কাজের কথা আছে।

নিতিশ বাবু আবার চেয়ার টেনে বসলেন। এরপর বললেন, কি ব্যাপারে স্যার?
স্যার উত্তর দিলেন, আপনার ব্যপারে।
নিতিশ বাবু চমকে উঠলেন, তারপর অবাক হয়ে কপাল কুঞ্চিত করে বললেন, আমার ব্যাপারে!
জি, আপনার বিষয়ে।
কি কথা স্যার?

রেজাউল সাহেব একটা ঢোক গিললেন, এরপর বললেন, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আপনি মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছেন।
নিতিশ বাবুর চোখ কপালে উঠে গেল। তিনি মেয়েদের গায়ে হাত দেন! এ কি জঘন্য অপবাদ তার বিরুদ্ধে? নিতিশ বাবু `কক্ষণো না, এ হতেই পারে না স্যার, আমি কখনো মেয়েদের গায়ে হাত দিইনি` বলে দৃঢ় প্রতিবাদ করে উঠলেন।

রেজাউল সাহেব কপাল কুঞ্চিত করে, কণ্ঠে গম্ভীর স্বর এনে বললেন, আপনি ষষ্ঠ শ্রেণির দুটো মেয়ের গায়ে হাত দেননি?
নিতিশ বাবু ঘাবড়ে গেলেন। প্রশ্ন করে উঠলেন, কাদের গায়ে হাত দিয়েছি স্যার? কবে দিয়েছি?

রেজাউল সাহেব দৃপ্ত মুখে বলে উঠলেন, গত মাসের পনেরো তারিখে। সুমি ও মনির বাবা এসে লিখিত অভিযোগ দিয়ে গেছে। স্কুল কমিটির সভাপতি সাহেবকে জানানো হয়েছে। কমিটির মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে আপনাকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিতে।

নিতিশ বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। ফরসা স্বাস্থ্যবান মানুষটির কপাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি চাপা উত্তেজনায় কাঁপছেন।

হেড স্যার অবার বলা শুরু করলেন, অন্য কেউ হলে আমি আলাপ করতাম না। আপনি বলেই করলাম। চিঠিটা রেডি আছে। আমি এখনো স্বাক্ষর করিনি। যদি বিষয়টা আপোষে মিটিয়ে নিতে পারেন, তাতে উভয়েরই মঙ্গল হয়। নতুবা স্কুলের বদনাম হবে। মুখরোচক গল্প ছড়াবে। মেয়ে দুটোরও সম্মান নষ্ট হবে। যদিও ওদের বাবারা সেটা বুঝতে পারছে না।

নিতিশ বাবুর বাকরুদ্ধ হয়ে এল। হ্যাঁ, সে দুটো বেতের বাড়ি মেরেছিল সত্য। তবে, সেতো হাতের তালুতে। মেয়েদুটো বাসা থেকে মোবাইল এনে ফেসবুক চালাচ্ছিল। ক্লাসে মনোযোগ ছিল না। পড়াও পারেনি। তাই দুজনের হাতে মাত্র দুটো বেতের বাড়ি। এটাকে তো মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া বলে না। গায়ে হাত দেয়া, সেতো অন্য ব্যপার। ছি ছি! এ কথা রাষ্ট্র হলে তিনি সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে? স্কুলেই বা আসবেন কি করে?

সামান্য বেতের বাড়ি, সেতো সন্তান স্নেহে। এতেই এতদূর! নিতিশ বাবুর নিজের উপর ঘেন্না হতে থাকল। শিক্ষকতা পেশার উপর ঘেন্না হতে লাগল। শিক্ষার্থীদের প্রতি নিজের স্নেহের উপর ঘেন্না হতে থাকল। তিনি হেড স্যারকে কিছু বলতে পারলেন না। মুখ নিচু করে তার রুম থেকে বের হয়ে এলেন। ধীর পায়ে শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

নিতিশ বাবু অ্যাসেম্বলিতে এলেন না। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারলেন না। সব কাজে খেই হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে মেজাজ হারালেন। শিক্ষার্থীদের সামনে নিজের কপাল থাপড়ে নিজেকে তিরস্কার করতে থাকলেন। পড়ুয়ারা অবাক হলো। স্যারের আচরণ অচেনা লাগল। নিতিশ বাবু ক্লাসে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। রফিক স্যারকে নিজের দুটো ক্লাস নেবার অনুরোধ করে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেলেন। পথে এই একটি চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। সাইকেলের হ্যান্ডেল এদিক ওদিক বেঁকে যেতে থাকল। নিতিশ বাবু নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন।

রিমি ডিভোর্স হবার পর থেকে বাড়িতেই ছিল। পাড়া-প্রতিবেশিদের সামনে বের হতো না। বিয়ের পর পরীক্ষা দিয়ে এইচএসসি পাশ করেছিল। রেজাল্ট ভালো হয়নি। তখন মানসিক অবস্থা যা ছিল, তাতে আর পড়তে ইচ্ছা করেনি। এখন আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাচ্ছে। এভাবে একা একা বাড়িতে বসে থাকা তার পক্ষে ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে। মা-বাবা যশোর মহিলা কলেজে ভর্তি হতে বলেছিল। রিমি রাজি হয়নি। সে পরিচিত মানুষের অবান্তর প্রশ্ন, উৎসুক দৃষ্টি, অনাবশ্যক কৌতূহলের বাইরে যেতে চাচ্ছে। দের বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম করে বাবা-মাকে রাজি করাতে পেরেছে। আজ সকালের ট্রেনে রিমির বাবা রিমিকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। রামপুরায় রিমির কাকাতো বোনের বাসা। আপাতত বাবা-মেয়ে সেখানেই উঠবে। বোন গৃহিনী, বোনের বর একটা রিয়েল স্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। সামান্য বেতন।

রিমির ইচ্ছা আছে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হবার। ভর্তির পরে একটা মহিলা হোস্টেল বা মেস দেখে উঠে যাবে। কাকাতো বোন পাশে থাকবে। মাঝে মাঝে দেখা হবে। বাবার এমন ইচ্ছেতেই এই কলেজ ওর পছন্দ হয়েছে। ট্রেন চুয়াডাঙ্গা স্টেশন ক্রস করছে। রিমি বাবার সাথে ঢাকায় থাকার ব্যপারে আরেকবার আলাপ-আলোচনা করে নিচ্ছে।

সকালেও রাখির মায়ের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো না। রাখি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকল। মা ওকে ডাকতে গেল না। দুজনের মান-অভিমান দু`জনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, না নিয়তি তাদেরকে আলাদা করে দিচ্ছে সেটা দুজনের কেউই বুঝতে পারছে না। পার্বতী মজুমদার মেয়ের অদ্ভুত আচরণের কথা দীপেন বাবুকে বললেন। দীপেন বাবু সকালে খাবার টেবিলে বসে মেয়ের শীঘ্র বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেললেন। টেবিলে বসেই সম্ভাব্য পাত্রের খোঁজে কয়েক জায়গায় ফোন করলেন। কয়েকজনকে অনুরোধ করলেন। তিনি ব্যকুল হয়ে ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। মেয়ের বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ করে দিলেন। রাখি একপ্রকার গৃহবন্দি হলো। রাগে, অভিমানে ফুঁসে উঠল তার সমস্ত অন্তঃকরণ।

সকালে রাধার বাড়ি, পাশের বাসার রাহেলা খালা এসে দাঁড়াল। রাধা ঘরে ছিল। রাহেলা খালার ডাকা শুনে বাইরে এল। একটা কাঠের টুল এগিয়ে দিয়ে খালাকে বসতে বলল। খালা বসল না। উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে পান চিবাতে চিবাতে কথা বলতে থাকল। মাঝে মাঝে তার চারপাশে পানের পিক ফেলতে থাকল। অন্যমনস্ক হয়ে, স্বাভাবিক ভাবে। রাহেলা খালার ছেলে পুলিশ কনস্টেবল। ছেলের বউ বাড়িতেই থাকে। কয়েকমাস হলো একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়েটার জন্য রাধাকে দিয়ে কাঁথা সেলাই করে নিয়েছিল। মোটা ও চিকন সেলাইয়ের, ছোট বড় বেশ কয়েকটা। রাধার হাতের কাজ চমৎকার। পাড়ার অনেকেই রাধাকে দিয়ে কাঁথা সেলাই করে নেয়। যে যা দেয়, রাধা বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা নিয়ে নেয়। বিবাদ করে না। এমনকি কেউ ঠকিয়ে নিলেও না। রাহেলা খালা আজ কাঁথা সেলাইয়ের টাকা দিতে এসেছে।

কথা বলতে বলতে রাধার মুখের দিকে তাকিয়ে `কী হয়েছে তোর রাধা? মুখটা কালো হয়ে গেছে, ঠোঁটের কোনায় কাটা ঘা?` রাহেলা খালা চমকে উঠে প্রশ্নগুলো করে ফেললেন। রাধাকে আবার গুছিয়ে কলের হাতল ছুঁটে কেটে যাবার মিথ্যা গল্পটা বলতে হলো। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলো। রাহেলা খালা `একটু দেখে কাজ করবি নে? সোমত্ত মেয়ে, যদি দাত ভেঙে যেত?` বলে অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলেন। রাধার মুখ দিয়ে আর কোনও কথা বের হলো না। রাহেলা খালাও টাকাটা দিয়ে `যায়, মেয়েটা আবার ঘুম থেকে উঠল কিনা কে জানে? দেখেশুনে চলিস রাধা।` বলে চলে গেল। রাধা টাকাটা নিয়ে ঘরে ঢুকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে গুমরে কেঁদে উঠল।

গতকাল রাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছিল নিতির। দীপের আদর, আহ্লাদ থামতেই চাচ্ছিল না। কত কথা, কত গল্প, কত স্বপ্ন তাদের দু`চোখের সামনে এসে পড়ছিল, তার সীমা-পরিসীমা নেই। শেষরাতে নিতি দীপের বুকে মুখ লুকিয়ে যখন ঘুমের রাজ্যে ডুব দিল, তখন দুজনেরই অবিশ্রাম উন্মত্ততায় ক্লান্ত। বেশ বেলা হলে ওদের ঘুম ভাঙল। দুজন স্নান করে, খিচুরি, ডিম ভাজার ব্যবস্থা করে, খোশমেজাজে সকালের খাবার খেতে বসেছে। খাওয়া প্রায় শেষ। এমন সময় নিতির ফোন বেজে উঠল। নিতি দু-এক গাল খাবার প্লেটে রেখে এঁটো হাতে ফোনের কাছে এলো।

মায়ের ফোন। ফোন ধরতেই মা ওপ্রান্ত থেকে `নিতি সর্বনাশ হয়ে গেছে মা` বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চলবে

১৪ মে ২০২০