প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

নিতির গল্প

উপন্যাস ২১

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

মাগরিবের আজান হলে ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে খাটের উপর উঠে বসল সুমন। বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে জল দিয়ে রুম থেকে পেস্ট-ব্রাশ নিয়ে এসে দাঁত ব্রাশ করে নিল। দাঁড়িয়ে লুঙ্গি উঁচু করে প্রচ্ছাপ করে বেসিন থেকে হাতের আঁজলায় জল ধরে নিন্মাঙ্গে জল ব্যবহারের কাজটা সারল। ট্যাপ খুলে হাত-পা ধুয়ে বাথরুমের দরজাটা টেনে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে খাটের কোনায় বসে গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে নিল। একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে টানতে মানিব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশ টাকার নোট, কিছু খুচরা টাকা আলাদা করে বের করে রাখল। স্মার্টফোন, মানিব্যাগ, টেবিলের ড্রয়ারে তালা মেরে রাখে ওর হাত ব্যাগ থেকে নতুন তালাচাবি বের করল।

সিগারেট টানা শেষ হলে ফিল্টার ঘরের কোনায় ছুঁড়ে ফেলে আন্ডারওয়্যারের উপর একটা হাফ শার্ট, জিন্সের প্যান্ট পরে নিল। টাকাগুলো প্যান্টের ডান পকেটে রাখল, বাম পকেটে নিল একটা ছোট বাটন ফোন। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল গলিয়ে নতুন তালাচাবি নিয়ে বাইরে এল। বাইরে থেকে নতুন তালা দরজার হ্যাজবোল্ডে লাগিয়ে সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। বোডিংয়ের ছেলেটা বসে বসে টিভি দেখছিল। সুমন `আসছি, রুমের দিকে খেয়াল রাখিস` বলতে বলতে রাস্তায় পা বাড়াল। রাস্তা দিয়ে কিছুটা হেঁটে রেললাইন ক্রস করে এপারে এসে একটা গলির মুখে থমকে দাঁড়াল। গলির দু`পাশে পান-সিগারেটের দোকান, দোকানে নানা বয়েসি মানুষের জটলা। কেউ পান, কেউ সিগারেট, কেউ পানি কিনছে, কেউ চা-বিস্কিট খাচ্ছে। অবিরাম হিন্দি গান বেজে চলেছে দোকানে দোকানে। সুমন গলির ভেতর একটু এগিয়ে এলো। বামপাশে ভীষণাকার কালো এক ভুড়িঅলা লোক বসে আছে। স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি, মুখে কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাতে বাস কন্ডাকটরের মতো খুচরা টাকার বান্ডিল।

সুমন একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিলে লোকটা একটা পাতলা হলুদ টিকিট হাতে ধরিয়ে, বিশ টাকা ফেরত দিল। সুমন টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে, টিকিট হাতে ধরে গলির আরো ভেতর দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা এগোতেই একটা হ্যাংলা লোক টিকিটটা নিয়ে ছিঁড়ে দিলে সুমন টিকিটটা পকেটে পুরে আরেকটু এগিয়ে গেল। দু`পাশে অসংখ্য মেয়ে। উপরে উজ্জ্বল আলোর লাইট জ্বলছে। সাউন্ড বক্সে হিন্দি সিনেমার গান বাজছে। মেয়েরা কেউ শাড়ি পরে আছে, আলুথালু আলগা পেট, স্লিভলেস ব্লাউজ গায়ে। কেউ গেঞ্জি-প্যান্ট পরে আছে, আবার কারো পরনে টাইট জিন্স, ফিলফিলে হাফ শার্ট। কেউ বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ দোকানের বেঞ্চে বসে, কেউ আবার দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। হাসির ফোররা ছুটছে। অট্টহাসি, খিলখিল হাসি, মুখচাপা হাসি, খলবল করে উঠা হাসি, বিদ্রুপ মেশান হাসি। হাসির হাট বসেছে।

সুমন যখন ভেতরে এলো, তখন একসাথে গোটা দশেক পুরুষ লোক ভেতরে ঢুকল। তাদের একজনের মুখে লম্বা কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে লাল রঙের অরুচিকর টিশার্ট। একজন উঁচুলম্বা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, চোখে চশমা, মাথার সামনের অংশে চকচকে টাক, জামা-জুতো পরা, ইন করা। তের চোদ্দ বছর বয়স্ক দুটো ছেলে এলো একে অপরের ঘাড়ে হাত দিয়ে। চোখে একরাশ বিস্ময়, হাজারো কৌতূহল। তিনজন যুবক বয়সের ছেলে থোরাই কেয়ার ভাব নিয়ে একসাথে ঢুকল। তারা ঢুকতেই একটা ঝরঝরে মেয়ে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। হাসতে হাসতে ছেলেগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত হ্যান্ডসাম ছেলেটার হাত ধরে `চল আজ তোমাদের এক সাথে পরীক্ষা হবে। কে ফার্স্ট হও দেখি?` বলে হাসতে হাসতে ছেলেগুলোর গায়ে ঢুলে পড়ল।

ছেলেটা `পারবি, এক সাথে তিনজনের সাথে?` বলে মেয়েটার স্তনের বোঁটায় মোড়া দিল। মেয়েটা কোনও রকম অস্বস্তি অনুভব না করে, `আগে পরীক্ষাটা দাও, দেখি তোমারা পার কিনা?` বলে আবার হেঁসে ঢলাঢলি করতে থাকল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা `চলো` বলে হাত ধরে টানতেই, ছেলে তিনটে ওর পশ্চাতে হাঁটতে শুরু করল, একটা গলির মধ্যে চারটা ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। দাড়িঅলা মুরব্বি একটা শাড়ি পরা মহিলার পাল্লায় পড়ল। মহিলাটার কাছে যেতেই `একহাজার টাকা লাগবে` বলে ডান হাতের তর্জনিটা উঁচু করে মহিলা মুখ বেঁকিয়ে দাঁড়াল। মুরব্বি মুখ ভেঙচে `হ্যাঁ, এক হাজার না, আরো কিছু! দু`শো টাকা দেব, যাবি?` বলে মহিলাটার আরেকটু গা ঘেষে দাঁড়াল। মহিলাটা চোখ মোটা মোটা করে, `দু`শো টাকা তো তোমার সোনা ধরতেই লেগে যাবে, কাজ করবা কি দিয়ে?` বলে আবার মুখ ভেঙচে অন্য দিকে তাকাল।

মুরব্বি এবার ডানহাতের তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা একসাথে তুলে মহিলার আড়চোখের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল- `এই দেব, গেলে চল?` মহিলা ডানহাতের পাঁচটা আঙুল তুলে রেগে গিয়ে বলল, এই লাগবে, গেলে চলো, না হলে গলির মধ্যে গুবসা মাগীদের কাছে যাও, আমার পিছে ঘেনঘেন করো না। শেষ পর্যন্ত চারশো টাকায় দফারফা হলো। মহিলা স্ফিত নিতম্ব দুলাতে দুলাতে আগে আগে চলল। মুরব্বি তার পিছে পিছে চলল।

এদিকে নিতিশ বাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। ভাঙা ভাঙা স্বরে দু`একটা কথা বলছে। ডাক্তার এলো। দেখে জানিয়ে গেল বিপদ কেটে গেছে, আগামীকাল থেকে ভাত খেতে পারবে। নিতিশ বাবুর পায়ে বল নেই। পায়ের উপর একটা পাতলা কাঁথা দেয়া। তিনি তার পা হারানোর বিষয়টি এখনো বোঝেননি। নিতি অপলক দৃষ্টিতে বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। নিতিশ বাবু চোখের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকলে নিতি বাবার কাছে গিয়ে মুখের কাছে মুখ লাগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। দুজনের অশ্রুতে দুজনের চোখ ভিজে গেল।

হেডস্যার এসেছেন বিদায় নিতে। তিনি মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত। এ ঘটনার জন্য নিজের মনে নিজেকেই দায়ী করছেন। চোখেমুখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা। অপরাধীর মতো সঙ্কোচ। নিতিশ বাবু চোখের জলে রেজাউল সাহেবকে বিদায় দিলেন। নিতির ভাই, বাসুদেব বাবু ও স্যারেরা একসাথে মাগুরার উদ্দেশে রওনা দিল। নিতির মামা থেকে গেলেন। যে হোটেলে স্যারেরা রুম নিয়েছিলেন, সেখানেই একটা রুম নিলেন। গতকাল থেকে রেবা দেবি, নিতি, স্নান করেনি, বিশ্রাম নেয়নি, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেনি, মুখে একরাশ ক্লান্তির ছাপ। মামার কাছ থেকে চাবি নিয়ে ওরা ফ্রেশ হতে হোটেলে গেল। মামা নিতিশ বাবুর কেবিনে থেকে গেলেন। নিতিশ বাবুর স্যালাইন চলছে। এই দু`দিনেই লোকটার শরীর বিছানার সাথে মিশে গেছে। চোয়াল ভেঙে গেছে। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। চোখদুটো কোটরের মধ্যে ঢুকে এমন হয়েছে হঠাৎ দেখলে চেনা মানুষের মুখ অচেনা লাগছে, বড্ড করুণ লাগছে।

ঘণ্টাখানেক পর রেবা দেবি ও নিতি ফিরে এলো। চুল ভেজা, পোষাক পরিবর্তন করেছে, ওদেরকে এখন একটু সতেজ লাগছে। মামা ওদেরকে বসিয়ে রাতের খাবার আনতে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পাশেই কাঠের পুল ব্রিজ। মামা ব্রিজ পার হয়ে, মাছ বাজারের ভেতর দিয়ে, বরফ কলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সামনেই নিতাই দা`র বাড়ি। মামা গেট ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। ঘরের বারান্দায় লম্বালম্বি ভাবে কয়েকটা টেবিল-বেঞ্চ পাতা। মামা একটা বেঞ্চ একটু টেনে নিয়ে বসলেন। নিতাই দা`র বউ রান্না ঘরে বড় কড়াইয়ে মাছ রাধছে। একটা কাজের মহিলা পাশের কলপাড়ে থালাবাসন ধুচ্ছে। ঘরের মধ্যে সাবেকি আমলের একটা রঙিন টিভিতে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল চলছে। জানালা দিয়ে টিভি দেখা যাচ্ছে, বাইরে থেকে স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। বারান্দায় একটা খাঁচা ফ্যান ঝুলানো, তাতে কটকট কটকট শব্দ হচ্ছে। নিতাই দা রান্না ঘরে ছিল, ভাতের ফ্যান গালিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাসি মুখ করে মামার দিকে তাকিয়ে `একটু বসতে হবে, মাছ এখনো হয়নি` বলে আবার ভেতরে চলে গেল। মামা বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘরের মধ্যে থেকে শিশু কোলে একটা অল্পবয়স্কা সুশ্রী মেয়ে বেরিয়ে এল। রান্না ঘরে ঢুকে একটা থালা নিয়ে আবার ঘরের ভেতর চলে গেল। দরজা ভাজিয়ে দিল।

কাঠের ঘর, উপরে একচালা টিন, সিমেন্টের মেঝে, নিচু পোতা। ঘরের লাগুয়া রান্নাঘর। দুটো শোবার ঘরের সামনে লম্বা বারান্দা। যেখানে মানুষজন খেতে বসে। বারান্দার সামনে প্রাচীরের গায়ে খোলা আকাশের নিচে একজোড়া স্টিলের ছোট সাইজের বেসিন রাখা। খেয়েদেয়ে সেখানেই সবাই হাত ধুয়ে নেয়। নিতাই দা`র বউ বেশ স্বাস্থ্যবতী, আগুনের আঁচে থেকে থেকে গায়ের রঙ তাম্র বর্ণ ধারণ করেছে। নিতাই দা উজ্জ্বল গৌড়বর্ণের অধিকারী। কিছুক্ষণ পর মাছ রান্না হয়ে গামলা করে টেবিলের উপর এলো। নিতাই দা মামার সামনে গামলা ধরে `কোনটা কোনটা দেব` বলে হাতা দিয়ে মাছের পিচ তুলে তুলে দেখাতে থাকল। মামা- `পেটির মাছ দেন` বললে, নিতাই দা- `পেটির মাছ নেই, সব গাদা পেটি` বলে দাঁড়িয়ে থাকল। মামা- `তাহলে গাদা পেটিই দেন` বলে একটু নড়েচড়ে বসলেন। রুই মাছ, আলু পটোলের পাতলা ঝোল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রান্না করা। জিরা ফোরান দিয়েছে, গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে। মামা প্লাস্টিকের বাটি সঙ্গে এনেছিলেন। নিতাই দা বাটি দুটো নিয়ে, সেগুলো ধুয়ে, তার একটাতে ভাত, একটাতে মাছের ঝোল দিয়ে, মুখ বন্ধ করে মামার হাতে দিল। মামা বাটি দু`টো নিয়ে `আসি নিতাই দা` বলে বিদায় নিলেন।

ঢাকায় বিকেল নাগাদ রিমি শোভার কাছে ফোন দিল। শোভার কথামতো রমেশ বাবু রিমিকে সাথে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের সামনে এলেন। পুরাতন মন্দির। গেট ঠেলে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। মাকে প্রণাম সেরে মন্দিরের চাতালে বসে কথা বাবা-মেয়ে কথা বলছিল। এমন সময় শোভা এলো। রিমিদের নিয়ে শোভা একটা পাঁচতলা বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের সিকিউরিটির সাথে কথা বলে তিনতলায় বাড়িমালিক খালাম্মার ফ্ল্যাটের সামনে আসল ওরা। বেল বাজতে কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ওরা ভেতরে ঢুকলে দরজার ছিটকিনি তুলে মেয়েটি আঙুলের ইশারায় সোফা দেখিয়ে বসে অপেক্ষা করতে বলল। একটা সোফায় তিনজন বসল। খালাম্মা বাসায় ছিলেন। হেলেদুলে হেঁটে এসে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। রমেশ বাবু `আদাব` দিলে মহিলা ঘাড় নাড়ালেন। মোটাসোটা ভীষণ চেহারা, পরনে ঢিলেঢালা ম্যাক্সি, পেট বুক সমান গোলাকার। দেহের তুলনায় মাথা চিকন ও ছোট। ঘাড় ছোট হয়ে গলা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বুকের উপর একটা ওড়না ফেলা আছে।

সোফায় বসে দম্ভের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ে ক`জন?
রমেশ বাবু স্মিত হেসে বললেন, একজন।
বাড়ি কোথায়?
যশোরে।
মেয়ে কি করে? পড়াশোনা করছে কি?
রমেশ বাবুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শোভা হাসি-হাসি মুখ করে বলে উঠল, জি আন্টি, আমার সাথে পড়ে, সিদ্ধেশ্বরী কলেজে, আমার পাশের গলিতেই বাসা।

মহিলা বললেন, বেশ। তারপর শোভার দিকে তাকিয়ে, এখানকার নিয়মকানুন তুমি জান কি? শোভা ঘাড় দুলাল, তারপর বলে উঠল, জি, জানি আন্টি। আমার আরো দুজন বন্ধু আপনার এখানে থাকে।

মহিলা `বেশ, তাহলে তো হয়েই গেল` বলে, গলাটা চওড়া করে ডাক দিল, রহিমা? রহিমা কাছেই ছিল, এ ডাকে পাশে এসে, `জি খালাম্মা` বলে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। খালাম্মা রহিমাকে রুম দেখাতে বলে দিলে ওরা তিনজন রহিমার সাথে চারতলায় উঠে গেল। শোভার কথামত রিমি, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, কলেজের টেম্পোরারি আইডির ফটোকপি সাথে এনেছিল। নিচে গেটে সিকিউরিটির কাছে টাকা দিয়ে, ফরম ফিলাপ করে, কাগজপত্র জমা রেখে খালাম্মার হোস্টেলের সদস্য হয়ে গেল। রমেশ বাবু চিন্তা মুক্ত হলেন, কলেজ হাঁটাপথের দূরত্বে। শোভাকেও রমেশ বাবুর পছন্দ হলো। মেয়ের মতো স্নেহ করতে লাগলেন।

ঢাকায় রিমির নতুন পরিচয় হলো। আর দশটা কলেজে পড়া মেয়ের মতো, তাকেও সবাই অবিবাহিত বলেই জানল। সেও সুকৌশলে নিজের পুরান পরিচয় সবার কাছে গোপন করে রাখল। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল সকালেই রিমি এখানে উঠে যাবে। মা ফোন কেড়ে নিলেও রাখির যোগাযোগ বন্ধ হলো না। একটা পরিত্যক্ত ফোন ছিল ঘরে। রাতে ফোনটা চার্জ দিলে অন হলো। পার্সে একটা সিম ছিল। অনেকদিন ব্যবহার করেনি। ডিস্টার্বিং কল আসত। আজ আবার সিমটা ভরল সে। বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পরার পর আয়ানের কাছে কল গেল। আয়ান ঘুমিয়ে ছিল। মাঝরাতে বিরক্তির সাথে ফোন ধরে, ঘাড় কাত করে শুয়ে, চোখদুটো বন্ধ রেখে বলে উঠল, হ্যালো। রাখি ওপ্রান্ত থেকে সুমিষ্ট গলায় বলল, আয়ান, আমি রাখি।

আয়ান রাখির কণ্ঠ শুনে ধরফর করে খাটের উপর উঠে বসল। রুমের ছোট বাতিটা অন করল। এরপর অবিশ্রাম কথা, অসংখ্য পরিকল্পনা চলল ভোর রাত পর্যন্ত। আয়ান বেকার, এম এম কলেজে পাস কোর্সে বিএ পড়ছে। বাবার রেল স্টেশনে পত্রিকার দোকান, শেখপাড়া বাড়ি। সবকিছু কীভাবে সামলাবে এই নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ হলো। রাখি তবুও অনড়। আয়ানের মাথায় হাজারটা আশঙ্কা এসে ভর করল। ফজরের আজান শুরু হলে ওদের কথা শেষ হলো, ওরা ঘুমাতে গেল।

এদিকে সকাল থেকেই রাখিদের বাড়ির চেহারা বদলাতে লাগল। পার্বতী দেবী যা বলছেন, দীপেন বাবু তাই কিনে আনছেন। নতুন কুটুম আসবে, বাড়িতে ঝাড়ামোছা চলতে থাকল সমান তালে। কাজের মেয়েটার সাথে আরো দুজন নতুন মহিলা যুক্ত হলো। বিউটি পার্লার থেকে মেয়েরা এসে রাখির চুলের সেপ ঠিক করে দিল, ফেসিয়াল করাল। বাড়িতে উৎসবের মেজাজ। মোহাম্মদপুরের নন্দ বাবুর ছেলের সাথে যশোরের দীপেন বাবুর মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে। রাধার বাবা নন্দ বাবুর দোকানে কাজ করে। সারের বস্তা ভ্যানে তুলে দেওয়া, সার ওজন করা, এসব নানাবিধ কাজ তার করতে হয়। মা, নন্দ বাবুর বাড়িতে ঘর-গৃহস্থলীর কাজ করে। ছেলের বিয়ে, এ বাড়িতেও কাজের ধুম পড়ে গেছে। কৃপণ নন্দ বাবু ছেলের বিষয়ে মুক্ত হস্ত। ছেলে ডাক্তার, মাগুরা সদর হাসপাতালে পোস্টিং। এফসিপিএস থার্ড পার্ট, পড়াশোনা, ডাক্তারি সমান তালে চলছে তার। ভদ্র, স্মার্ট ডাঃ সুনন্দ কর্মকার বেশ নাম করেছেন শহরে। প্রাকটিস মাগুরা শহরেই করেন, গরীবের ডাক্তার নামে সুখ্যাতি ছড়িয়েছে।

মা নন্দ কাকার বাড়ি ব্যস্ত থাকায় রাধাকে অসুস্থ শরীর নিয়েই বিকালবেলা রাতের রান্নাটা করতে যেতে হলো। আনমনে তেলের উপর তরকারি ছাড়তেই রাধা `মাগো` বলে চিৎকার করে উঠল। চলবে

১৬ মে ২০২০