নিতির গল্প

উপন্যাস ২২

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০২০

চিৎকারটা একটু জোরেই হয়েছিল। রাধাদের রান্নাঘরের পাশে রাহেলা খালার গোয়াল ঘর। খালা গোয়ালে বিচালি কাটছিলেন। রাধার চিৎকার শুনে কাজ ফেলে ছুটে এসে `কি হলো রাধা, ওমন চিৎকার করে উঠলি কেন মা?` বলে রাধাদের রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে থাকলেন।

রাধা পুড়ে যাওয়া হাতটা বের করে দেখাল। গরম তেল ছুটে হাতের অনেকটা জুড়ে ফোস্কা পড়েছে। রাহেলা খালা `হাতে পানি দে, আমি পুড়ে যাওয়ার ওষুধ আনছি, তুই একটু অপেক্ষা কর` বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। অল্প সময় পরেই বার্না ক্রিম এনে রাধার হাতের ফোস্কা পড়া অংশে ভালো করে লাগিয়ে দিলেন। ক্রিমটা রাধার হাতে দিয়ে দিনে তিনবার নিয়ম করে পোড়া স্থানে লাগাতে বললেন। কথাটা যাতে ভুলে না যায়, এটা বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

রাহেলা খালার মধ্যে রাধা মায়ের স্নেহ দেখতে পায়, রাহেলা খালাও রাধাকে সন্তান স্নেহে ভালোবাসেন। হাজার অশান্তির মধ্যেও রাহেলা খালার সান্নিধ্যে রাধার মনোকষ্ট দূর হয়ে যায়। রাহেলা খালার মনে হতো রাধার সাথে ছেলেটার বিয়ে হলে বেশ হয়। মনের ইচ্ছা মনেই মারা গেল, ধর্ম সে ইচ্ছার মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকল। পাশের গ্রামের খুশির সাথে এক সন্ধ্যায় হাসানের বিয়ে হয়ে গেল।

বাড়িতে দিদির বিয়ে, হাসপাতালে নিতির বাবা, দু`দিক সামলাতে দীপের দম বেরিয়ে যাবার উপক্রম। তবুও স্বস্তি নিতিশ বাবুর জ্ঞান ফিরেছে, ওর মামা এসে পৌঁছেছে, দীপের গুরুভার একটু লাঘব হয়েছে। যে নিতিকে দীপ চিনতো, এ নিতি সে নিতি নয়। এই দু`দিনেই নিতির বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে; চেহারায়, কথাবার্তায়।

মানুষ যখন সুখে থাকে তখন দু`চোখে হাজারটা স্বপ্ন দেখতে থাকে। স্বপ্নের গালিচায় উড়তে থাকে। চোখেমুখে সেই খুশির একটা দীপ্তি ছড়ায়। মনে রঙ লাগে। সে আবিরে চারপাশের মানুষও রঙিন হয়ে ওঠে। মানুষ যখন দুঃখে থাকে, তখন হাজারটা চিন্তা এসে তার মাথায় ভিড় করে, সেসব চিন্তার সবটাই দুশ্চিন্তা। তখন মানুষ ক্রমশ অন্ধকার খাদে পড়ে যেতে থাকে, তলিয়ে যেতে থাকে গভীর সমুদ্রে, যার কোনও তল নেই, ঠাঁই নেই, নেই কোনও ভবিষ্যৎ। দুরাশার গভীর খাদে, অন্ধকার জগতের কোনে, তার দুঃস্বপ্ন ঘুরে বেড়াতে থাকে। তখন চোখেমুখে সেই ভয়ংকর অনিশ্চয়তার কালো ছাপ পড়ে। চারপাশের পরিচিত মানুষগুলো সে চোখ দেখে আঁতকে ওঠে, ভয় পায়। দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের থেকে দূরে চলে যেতে চায়। পাছে সে কালো ছায়া তার কপালেও পড়ে।

নিতি ঢাকায় ছিল সুখের গালিচায় উড়া পাখি হয়ে, চোখ জুড়ানো রূপ নিয়ে, এক বুক স্বপ্ন নিয়ে, দীপের প্রেয়সী হয়ে, ভবিষ্যৎ জীবনের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে। যশোরে আছে একরাশ দুঃখ, অনিশ্চয়তা, ক্লান্তি আর হতাশা নিয়ে। নিতি ওর বাবার প্রথম সন্তান। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, সেই তো বড়। ভাই নিতান্তই বালক। বাবার অসহায়ত্বে, বাবার অবর্তমানে, সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তায়। এই অসময়ে সেই হতে পারতো বাবার সহায়। অথচ সে তেমন কিছুই করতে পারছে না। দীপ করছে, কিন্তু কেন করছে, এর সামাজিক পরিচয় কি, সামাজিক স্বীকৃতিই বা কি? এখন বিপদের সময় কেউ কিছু না বললেও, এই নিয়ে ভবিষ্যতে যে একটা গল্প ছড়াবে এ বিষয়ে নিতি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তাদের পরিচিত অনেকেই এসে দীপের সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। নিতির মা দীপকে আত্মীয় বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মেয়ের বন্ধু, না না, মেয়ের বন্ধু তাদের গ্রাম্য আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই মেনে নিতে পারতো না।

নিতি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরেও দীপের বাড়ি থেকে কেউ হাসপাতালে আসেনি। অথচ সামান্য দূরেই ওদের বাড়ি। হয়তো দীপ বাড়িতে বলার সাহসই পায়নি, অথবা বললেও কেউ আসার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর আসবেই বা কেন? কোন সম্পর্কের পরিচয়ে আসবে? এরা তাদের কি হয়? দীপ অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলেছে। তার টাকাগুলোও ফেরত দিতে হবে, না হলে দীপের কাছে সম্মান থাকবে না। নিতি কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথা অবস হয়ে যাচ্ছে। নিতি দীপের কথা ভাবছে, এমন সময় দীপ কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে `নিতি আমি দীপ, আসতে পারি?` বলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। নিতি আধবোজা দরজাটা খুলে দিলে দীপ ভেতরে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল।

নিতিশ বাবুর খোঁজখবর নিল। এমন সময় মামাও খাবারের বাটি হাতে নিয়ে কেবিনের ভেতরে চলে এলেন। দীপ মামাকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে নমস্কার করলো মামা বললেন, আরে বসো বসো, উঠে দাঁড়াতে হবে না, কখন এলে?
মাত্র, আপনি আসার মিনিট পাঁচেক আগে।
ওহ্, ওদিককার খবর কি? তোমাদের বাড়ির?
ও-ই, আগামীকাল দিদিকে দেখতে আসছে নন্দ বাবুরা, আমাকেও বাড়িতে থাকতে হবে, রাতের আগে হয়তো এখানে আসতে পারব না। মুখে একটু হাসির রেখা টেনে বলল, আপনাকেই আগামীকাল সবদিক দেখতে হবে।
না, না, তুমি দুশ্চিন্তা করো না, তোমার আগামীকাল বাড়িতেই থাকা কর্তব্য। তুমি যা করলে, দিদির নিজের পেটের ছেলে হলেও তা করতে পারতো না।
না, মামা, লজ্জা দেবেন না। এ অতি সামান্যই করতে পেরেছি।
কিন্তু এই সামান্যই আজকালকার দিনে কয়জন করে দীপ?
দীপ মামার কথায় প্রতিবাদ করল না। আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর দীপ উঠে চলে গেল। এই পুরোটা সময় নিতি একটি কথাও বলেনি। পাশে থেকে অন্যদের কথা শুনেছে মাত্র।

সুমন বড় গলি থেকে মোড় নিয়ে একটা চিকন অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির মধ্যে ঢুকে গেল। কিছুটা এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ ভূত দেখের মতো করে একটা হ্যাংলা-পাতলা চেহারার অল্পবয়স্ক ছেলে সুমনের পথ আগলে `স্যার বাবা লাগবে? নতুন ট্যবলেট আছে`, বলে প্রতি উত্তরের আশায় অপেক্ষা করতে থাকল। সুমন ছেলেটার দিকে একপলক চেয়ে কোনও কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল। একটা মাঝারি সাইজের আমগাছের নিচে আসমার ঘর। সুমন এ ঘরে এর আগেও বহুবার এসেছে। আসমার প্রতি ওর একটা টান আছে। গোপন আবেগ আছে।

আসমা তেমন সুন্দরী নয়। আসমা থেকে ঢের সুন্দরী মেয়ে এ পাড়ার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবুও সুমন সবার আগে এ ঘরেই আসে। এখানে এলে তার লাম্পট্যে মরিচা ধরে। কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে যায়। আসমার শাসনের প্রতাপে বাঁধা পড়ে যায়। আসমা সেটা বুঝতে পারে, ধরা দেয় না। এ পাড়ার মেয়েদের প্রেমে পড়তে নেই, পড়লে প্রতারিত হতে হয়। আর দশটা পুরুষের সাথে আসমা যে ব্যবহার করে, সুমনের সাথে তার অন্যথা হয় না। সুমনও অন্য মেয়েদের কাছে টাকা পয়সা যেমন হিসাব করে খরচ করে, এখানেও তার ব্যতিক্রম করে না। মন দেয়া-নেয়ার ব্যপারটা মনে মনেই থাকে। বাইরে কেউ প্রকাশ করতে চাই না। দুজনের কাছেই সেটা বড় গোপনে থাকে, সযত্নে হৃদয়ের গোপন কোন প্রকষ্ঠে তোলা থাকে।

এ পাড়ার বাসিন্দা হলেও সেতো মেয়ে! মেয়েরা হাজার পুরুষের মাঝেও তার ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিক চিনে নিতে পারে। মানুষ যত খারাপই হোক না কেন, তার একটা দুর্বল জায়গা থাকে। আসমা সুমনের দুর্বলতা। সুমন যখন বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াল, তখন আসমার ঘর থেকে লোমশ কদাকার চেহারার টাক মাথা মোটা বেটে একটা মধ্য বয়স্ক পুরুষ ঘর্মাক্ত কলেবরে বেরিয়ে এলো। লোকটা বেরোতেই সুমন ঘরে ঢুকে খাটের এককোনায় বসল। ঘরজুড়ে কনডমের গন্ধ। একটা লাইট জ্বলছে। ফুল স্পিডে পাখা চলছে। জানালা বন্ধ। খাটের উপর কামিজ-সেলোয়ার পরে আসমা বসে আছে, বুকে ওড়না নেই, চুল রাবার দিয়ে বাঁধা।

ঘরের এক কোনায় থালা বাসন রাখার লোহার তারের মিটসেফ, তাতে কিছু ছোট ছোট গামলা, প্লেট অবিন্যস্তভাবে রাখা রয়েছে। অন্যপাশে একটা আলনায় কিছু জামাকাপড়। মেঝেতে কয়েক জোড়া স্যান্ডেল এলোমেলো পড়ে রয়েছে। দেয়ালে বড় করে সরস্বতী দেবীর বাঁধানো ছবি। `তুমি এমন বন মানুষের মতো পুরুষদের সাথেও শোও নাকি?` সুমন ঠোঁট উল্টো করে ভ্রু-কুঁচকে বলে উঠল।

একটা শ্লেষাত্মক মুখভঙ্গি করে `বেশ্যার আবার মোটা-চিকন বাছলে চলে?` বলে আসমা অন্যদিকে মুখ ঘোরাল। কয়েক মুহূর্ত দুজন নীরব থাকল। নীরাবতা ভেঙে সুমন ঘরের সরস্বতী দেবীর বাঁধানো ছবির দিকে লক্ষ্য করে, তুমি তো মুসলমান, তোমার ঘরে সরস্বতীর ছবি?
বেশ্যার আবার ধর্ম! আসমা আবার মুখ ঝামটি দিল।

এমন সময় বাইরে চিৎকার-চেচামেচির শব্দ শুনে আসমা খাট থেকে নেমে বাড়ির গেটের দিকে এগিয়ে গেল। সুমন আসমার পেছন পেছন এলো। দুটো মেয়ে ঝগড়া করতে করতে একে অপরের চুল টেনে ধরছে। ক্রমে ঝগড়া মারামারিতে রূপান্তরিত হয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সুমন আসমাকে একটা টোকা দিয়ে বলল, এরা কারা?

আসমা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, অই সম্পা মাগীর সাথে বিজলির বেঁধেছে, মাগীদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ভরা হাটের মাঝে গতর দেখাচ্ছে।

সুমন তাকিয়ে দেখল, এরই মধ্যে দুজনেরই ব্লাউজ ছিড়ে স্তন ঝুলে পড়েছে। দুজনের কারো সেদিকে খেয়াল নেই। একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ গলির মধ্যে থেকে একজন লম্বা চিকন ধাঁচের নেশাখোর চেহারার পুরুষ বের হয়ে এলো। চোখ লাল করে খিস্তিখেউড় দিয়ে লাঠি নিয়ে মেয়ে দুটোর পিঠে ধমাধম বারি মারল। দুজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গাল দিতে দিতে দু`দিকে চলে গেল। যেসব দর্শক বিনা পয়সার নাটক দেখছিল, তারা একে একে রঙ্গমঞ্চ থেকে দূরে সরে গেল। গলিতে আগের মতো থমথমে ভাব ফিরে এলো। আসমার ঘরে সুমন ফিরে এসেছে। আসমা দরজার ছিটকিনি তুলতে তুলতে বলল, এতদিন পর মনে পড়ল?

আর বলো না, মাস্টারি একটা চাকরি? ছুটি আছে নাকি? আসমা সুমনের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল। খাটের কাছে দাঁড়িয়ে সেলোয়ার খুলতে খুলতে সুমনের দিকে চেয়ে বলল, ক্যাপটা পরে নাও।
এখনই? একটু গল্প করি?
গল্প পরে হবে, আগে যে কাজ করতে এসেছ সেটা করে নাও!
সুমন জামা-প্যান্ট খুলে পাশে রেখে হাত বাড়াতে আসমা বিছানার চাদরের নিচ থেকে একটা কনডম বের করে বলল, কি হলো টাকাটা দাও?
এখনই?
জানো না বুঝি? এ কাজে বাকি হয়?
সুমন প্যান্টটা টেনে পাঁচশো টাকার একটা নোট পকেট থেকে বের করে দিল।
ক্যাপের টাকা?
সুমন প্যান্ট থেকে বিশ টাকা দিতে যাচ্ছিল। আসমা ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ওতে হবে না। গত মাস থেকে পঞ্চাশ টাকা দাম হয়েছে।
সুমন পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে দিল।
বকশিস?
সুমন আরো একটা পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে দিল।
আসমা কনডমটা ছিঁড়ে নির্দিষ্ট স্থানে পরিয়ে বেড সুইস বন্ধ করে লাইটটা নিভিয়ে দিল। চলবে

১৭ মে ২০২০