নিতির গল্প

পর্ব ৩২

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২০

সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে বেশ রাত হয়ে গেল। ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসেছে রিমি, তার পাশে শোভা, এরপর তুলি, পরপর তিনজন। ড্রাইভারের পাশের সিটে আদনান। পরের সিটগুলোতে একে একে অন্যান্য আর্টিস্টরা জায়গা করে নিয়েছে। এরমধ্যে একঘণ্টা কেটে গেল। গাড়ি হাইওয়েতে চলতে শুরু করেছে। আরামদায়ক একটা দুলুনি টের পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির আদুরে দুলুনিতে একে একে সবার চোখে ঘুম নেমে এলো।

একটা মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে যখন গাড়িটা থামল তখন মধ্যরাত্রি। ঝাঁকুনিতে শোভার ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখল। একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা থেমেছে। সাইনবোর্ডে দেখা যাচ্ছে এটা কুমিল্লা অঞ্চল। আদনান পেছনের সিটের দিকে একপলক তাকাল। সকলকে রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় আসতে বলে দ্রুত নেমে গেল। রিমি তখনও ঘুমাচ্ছে। কী ঘুম রে বাবা! শোভা কাঁধে হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকল। রিমির ঘুম ভাঙল। ততক্ষণে একে একে গাড়ির সবাই নেমে গেছে। সবশেষে ওরা নামল। ড্রাইভার গাড়ি লক করে ওদেরকে অনুসরণ করে উপরে উঠে আসল।

এর মধ্যে ওদের বাসটা এসে পৌঁছেছে। পেছনে পিকাপ দুটো দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে শুটিংয়ের লোকজনে হোটেল পূর্ণ হয়ে উঠল। যার যার প্রয়োজন ওয়াশরুমে যাচ্ছে, এটা ওটা অর্ডার দিয়ে খাওয়া শুরু করছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রেস্টুরেন্টে জুড়ে একটা মৃদু কলরব শুরু হয়েছে। শোভা রিমিকে সাথে নিয়ে একটা টেবিলে এসে বসল। তুলি তপুর সাথে অন্য টেবিলে বসেছে। জলের বোতলটা খুলে এক ঢোক জল খেয়ে নিল। ওয়েটারকে ডাকবে এমন সময় আচমকা আদনান টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসে বলল, খাবার অর্ডার দেয়া হয়েছে।

শোভা বলে উঠল, না।
আদনান রিমির দিকে তাকিয়ে বলল, কি খাবে?
রিমি আদনানের প্রশ্নের উত্তরে বলল, আপনার যা ইচ্ছে?
আদনান উভয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের কোনও পছন্দ নেই?
না। দুজন প্রায় একইসাথে বলে উঠল।
আদনান হাতের ইশারায় ওয়েটারকে ডেকে, তিন প্লেট মুরগির মাংস, ছয়টা পরোটা, তিনটা কোল্ড ড্রিংস আনতে বলে দিল।

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেছে। ওরা দু`চারটা কথা বলছে। মিনিট দশেক পড়ে ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হলো। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের খাবারের দাম এমনিতেই একটু বেশি হয়। এখানে যেন অত্যাধিক বেশি মনে হলো। ওরা খেতে শুরু করল। এর মধ্যে আধঘণ্টা চলে গেছে। খাবার শেষ হয়ে এলে আদনান ওদেরকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি বাকি মেম্বাররা কে কি করছে একটু দেখে আসি, বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল।

ওরা বেসিনে হাত ধুয়ে বিল্ডিংয়ের বাইরের দেয়াল ঘেঁষা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। সেপ্টেম্বর মাস পড়েছে। রাতের বাতাসে হিমেল পরশ পাওয়া যাচ্ছে। একটু একটু শিশির জমতে শুরু করেছে ঘাসে ঘাসে। দূরে তাকালে হালকা কুয়াশায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। নিচে কিছু দোলনা পাতা আছে। রিমি তার একটাতে এসে বসল। পা দিয়ে ঠেললে হালকা দোলুনি হচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে দোলুনিটা। মানুষের মনে একটা শিশু বাস করে। সময় সুযোগ পেলেই সেই শিশুটা বেরিয়ে আসে। শৈশব জাগিয়ে তোলে। মানুষ তখন ফেলে আসা শৈশবের চঞ্চলতা টের পায়।

রিমি যেন সেই চঞ্চলতায় টের পাচ্ছে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা ‘দোল দোল দোলুনি’ গানটা কানে ভেসে আসছে। রিমির চোখে আচমকা মায়ের মুখটা ভেসে উঠল। ছেলেবেলার নানান স্মৃতি চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতে থাকল। রিমির কান্না পেল। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। শোভা পাশের দোকান থেকে দুটো সিগারেট এনে রিমির পাশে বসল। একটা লাইটার সবসময় ওর ব্যাগে থাকে। সেটা ব্যাগ থেকে বের করল। একটা সিগারেট নিজের ঠোঁটের খাঁজে রেখে আরেকটা রিমির দিকে বাড়িয়ে দিল।

রিমি নিয়মিত সিগারেট টানে না। কেউ বাড়িয়ে দিয়ে রিফিউজও করতে পারে না। এখনও পারল না। ঠোঁটের খাঁজে সিগারেটটা রাখল। শোভা লাইটারটা জ্বেলে ওর সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা ধরাল। একটা শান্ত মোহময় পরিবেশ। দূর থেকে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে হুস হাস করে হাইওয়ে দিয়ে দ্রুতগতির গাড়ি চলে যাচ্ছে। ওরা দুজন পায়ে ঠেলে ঠেলে দোল খাচ্ছে, সিগারেট টানছে, নিজেরা মৃদু স্বরে গল্প করছে। এমন সময় নীরবতা ভেঙে কয়েকটা পরিবহন এসে থামল। পরিবহন থামতেই যাত্রীদের ওঠা-নামার শব্দে শান্ত-কোমল পরিবেশটা আর থাকল না। এক লহমায় কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল গোটা চত্ত্বর।

এখন আর এলাকাটা মোলায়েম মনে হচ্ছে না। দোতলা হোটেলের হালকা লাল, হলুদ, সবুজ বাতি মুগ্ধ করছে না। মানুষের জীবনটা বোধহয় এমনই। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ভালো লাগা, মন্দ লাগারও পরিবর্তন হয়ে যায়। চিরস্থায়ী ভালো লাগা বা চিরস্থায়ী মন্দ লাগা বলে বোধহয় কিছু নেই জীবনে। ভাবনার মধ্যে আদনান এসে হাজির হয়ে বলল, কি ব্যপার তোমরা এখানে? ওঠো, আমাদের রওনা দিতে হবে। তোমাদের জন্য গাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।

ওরা `আচ্ছা উঠছি` বলে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে পূর্বের সিটে গিয়ে বসল। আদনান দরজাটা টেনে দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেই গাড়ি স্টার্ট দিল। এরপর আবার ঘুম। আবার হাইওয়েতে অবিশ্রাম গাড়ির ছুটে চলা। একনাগাড়ে ছুটে চলে ভোরবেলা কর্ণফুলি ব্রিজের সামনে এসে গাড়িটা ব্রেক করল। সামনেই কর্ণফুলি নদী। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট লাইটার জাহাজগুলো নদীতে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনও চিন্তা নেই। কোনও ব্যস্ততা নেই। অনন্ত কালের জন্য জলের মধ্যে ঘর বেঁধেছে ওরা। ব্রিজটা পার হয়ে একটা টোল প্লাজায় এসে কয়েক মিনিটের জন্য গাড়িটা থামল। টোলের টাকা পরিশোধ হলে আবার চলতে শুরু করল।

চট্টগ্রাম পার হবার পর আরেকটা রেস্টুরেন্টে ওদের দ্বিতীয় যাত্রা বিরতি হলো। ব্রেকফাস্টটা এখানেই সারতে হবে। একইভাবে সবাই নেমে পড়ল। ওয়াশরুমে গেল। একটু হালকা নাস্তা করে, সিগারেট টেনে, গাড়িতে উঠে বসল। এখানেও প্রায় একঘণ্টা কেটে গেল। সকাল আটটার দিকে ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক পার হলো ওদের গাড়ি। বামপাশে ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা দেখা যাচ্ছে। ডানে কখনো টিলা, কখনো সবুজ মাঠ। মাঝে মধ্যে বাজার এসে সামনে দাঁড়াচ্ছে। কখনো গ্রাম্য পরিবেশে ছোট ছোট বাড়ি-ঘর। কখনো মেঠো পথ। একেক সময় একেক দিকে নজর চলে যাচ্ছে।

বুনো অরণ্যের মাঝ দিয়ে ইলেকট্রিক লাইন চলে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ের টিলার উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সেসব পোল নজরে আসছে। কখনো লেখা ভেসে আসছে হাতি চলার পথ। সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত সেসব টিলাম মধ্য দিয়ে ভেসে আসছে প্রথম সকালের রোদ। কক্সবাজারের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ওরা এগিয়ে চলল। ওদের গাড়ি যখন কলাতলি পয়েন্টে থামল তখন সকাল নয়টা। সকালে খবরের কাগজটা দেখছিল নিতি। হঠাৎ একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ওর চোখ আটকে গেল। প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ ২০১৩। প্রাইমারি স্কুলে ২০১৩ সালে সহকারী শিক্ষক পদে কিছু লোক নিয়োগ করা হবে। বাবার চিকিৎসায় অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছে। চাকরিটা পেলে সেগুলো শোধ করা যাবে। নিতি ঠিক করল ও আবেদনটা করবে।

পোষাক পাল্টে পেপারটা হাতে নিয়ে নিতি বেরিয়ে এলো। একটা কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে অ্যাপ্লিকেশন ফরম সংগ্রহ করে দোকানের একপাশে বসে পূরণ করল। আগে থেকে সত্যয়িত ছবি, কাগজপত্র ওর কাছে ছিল। আবেদন ফর্মের সাথে যেসব কাগজপত্র সংযুক্ত করা প্রয়োজন, সেগুলো সংযুক্ত করল। একটা রিক্সা নিয়ে সোজা পোস্ট অফিসে চলে এলো। কাগজপত্র খামে ভরে খামের মুখ বন্ধ করে রেজিস্টার্ড ডাক যোগে পাঠাতে খামটি পোস্টঅফিসে জমা দিল। কাজটা শেষ করতে করতে বিকেল তিনটা বেজে গেল। হোস্টেলে এসে খাবার পাওয়া গেল না। আজ অনেকটা ধকল গেছে। স্নান সেরে দুটো বিস্কুট গালে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

অন্যদিকে দীপকে আজ ব্রিটিশ কাউন্সিলের অফিসে দেখা গেল। ইংরেজির কয়েকটা কোর্স করবে সে। দীপের একজন রিলেটিভ কানাডায় সেটেল্ড। সম্প্রতি ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছে। অনার্সটা শেষ করে কানাডা প্রবাসী হবার একটা ইচ্ছা জেগেছে মনে। ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠতে ওর নতুন প্রচেষ্টা শুরু হচ্ছে। চলবে