
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩৩
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ০৯, ২০২০
কক্সবাজার কলাতলি পয়েন্ট। রিমিদের গাড়িটা সবার আগে এখানে এসে পৌঁছেছে। সমুদ্রের গর্জন এখান থেকে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে কি? উঁচু রাস্তা থেকে নামার সময় এক পলকে সমুদ্রের সৌন্দর্য সবারই দেখা হয়ে গেছে। সেটাই কী কম আনন্দ!
আদনান অন্য গাড়িগুলো আসার অপেক্ষায় আছে। আদনানের সাথে বাকিদেরকেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সারা রাতের জার্নির পর এ অপেক্ষা মোটেও ভালো লাগছে না। তবুও করতে হবে। আফটার অল টিমওয়ার্ক!
বিরক্তি খুব বেশি গভীর হলো না। খুব বেশি সময় অপেক্ষাও করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে শুটিং টিমের অন্য গাড়িগুলো একের পর এক এসে থামল। আদনান গাড়ি থেকে নেমে টিমের বাকি মেম্বারদের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারলেন। শীতের শুরু। রুমের ক্রাইসিস আছে কক্সবাজারে। বাজেটেরও একটা ব্যাপার আছে। সবমিলিয়ে একই হোটেলে টিমের প্রত্যেকের জন্য বিভিন্ন মানের রুম পাওয়া সম্ভব হয়নি।
ঢাকা থেকেই রুম বুকিং দেয়া ছিল। সে অনুযায়ী টিমের যে মেম্বাররা বাসে এসেছিল, তাদের মধ্যে হেল্পার, বাবুর্চির মতো কিছু লোকের জন্য কলাতলির নির্দিষ্ট হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। ক্যামেরা পার্সন ও ম্যানেজারের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্সনদের আগে থেকে ঠিক করা সুগন্ধা পয়েন্টের একটা ভালো মানের হোটেলে তোলা হলো।
প্রযোজক আজ বিকালের ফ্লাইটে কক্সবাজার আসবেন। তিনি হোটেল সী গালে উঠবেন। ওদের থাকার ব্যবস্থাও সেখানে হয়েছে। ওদের হায়াস সী গালের রিসিপশনের সামনে এসে থামল। টোটাল টিম কার্যত তিন ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লম্বা জার্নিতে সবাই ক্লান্ত। আজ কোনও শুটিং হবে না। সাইট সিইং, ঘুরাঘুরি, কেনাকাটা, সমুদ্র স্নান, যার মনে যা চায়, আজ করে নিতে হবে। কাল থেকে ফুল টিমের ডে লং শুটিং।
হোটেলে পৌঁছে কেউ ঘরে থাকল না। নিজের মতো করে কাটানোর জন্য আজ একটা দিনই হাতে আছে। পোষাক পাল্টানো হলে, শোভা এক প্রকার টানতে টানতে ওদেরকে সমুদ্রে নিয়ে এল। তপু, তুলি, শোভা, রিমি কেউই আগে সমুদ্র দেখেনি। যারা সমুদ্র আগে কখনো দেখেনি তাদের জন্য সমুদ্র একটা মহা বিস্ময়ের বিষয়। বিশাল বিশাল ঢেউ, অসীম জলরাশি, প্রবল গর্জন সবই আনন্দের, সবই উপভোগ্য।
ওদের গ্রুপে যারা আছে, তারা কেউ এখনো স্টার হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে ভক্তদের বারাবাড়ি বলে কিছু নেই। নিজেদেরকে লুকানোরও কিছু নেই। উন্মুক্ত সী বিচে আনন্দে করতে ওদের কোন বাধা নেই। মানুষের জীবন বড় বিচিত্র, জীবনের ইচ্ছেরা আরো বিচিত্র। মানুষ যখন অখ্যাত থাকে তখন সে বিখ্যাত হতে চায়, জনপ্রিয়তা চায়, সে চায়, মানুষ তাকে ঘিরে ধরুক। মানুষ ঘিরে ধরছে না বলে মনে মনে ব্যথিত হয়।
যখন সত্যি সত্যিই খুব নাম হয় তার। মানুষ যখন তাকে দেখতে চায়, ছুঁতে চায়। দুদণ্ড বসে গল্প করতে চায়, যখন সে কোথাও দাঁড়ালে জনতার ভিড় লেগে যায়, তখন সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে যেতে চায়। মানুষের জীবনে ইচ্ছা পূরণ হবার মতো এত বড় বিড়ম্বনা আর কিছু নেই। তবুও মানুষ নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে নিরন্তর কত সংগ্রামই না করছে। এই যে এত মানুষ ছুটছে, সফলতার পেছনে ছুটছে। যখন সত্যি সত্যিই সে সফল হবে, তখন দেখবে সময় ফুরিয়ে এসেছে। যে সুখের জন্য সফল হতে চেয়েছিল, সে সুখ ভোগ করতে সময় চায়, অথচ তার কাছে কোনও সময়ই নেই তখন।
আমরা আমাদের জীবনের বড় বড় সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে ছোট ছোট অনেক কিছুকে অবহেলা করি। অথচ এই ছোট ছোট ঘটনা, একটু একটু সুখ, সামান্য পাওয়া এবং অনেকটা না পাওয়া, এই নিয়েই তো জীবন। এটাই তো জীবনের শাশ্বত সত্য। মানুষের শরীর গহনা দিয়ে সাজাতে কয়েক ভরি সোনাই যথেষ্ট। সে ক্ষেত্রে কয়েক টন সোনার কোন প্রয়োজন নেই। কয়েক টন সোনা কারো শরীরে চাপালে সে আর সুন্দর থাকবে না, বরং সোনার চাপে দাম বন্ধ হয়ে সে মারা যাবে।
অথচ আমাদের আরো সোনা, আরো অনেক সোনা চাই। পৃথিবীর সব সোনা পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেলেও আমরা তৃপ্ত হতে পারি না। তখন সোনার সিংহাসন, সোনার বাড়ি, সোনার গাড়ি এমনকি সোনার টয়লেট তৈরি করতেও ইচ্ছে হয় আমাদের। অথচ এসবের কিছুরই দরকার ছিল না। বেঁচে থাকতে দিনে কয়েক গাল খাবারের দরকার হয়। কয়েক হাঁড়ি খাবার মানুষের জন্য নিষ্প্রয়োজন। অথচ আমরা যখন মন মন খাবার কেনার সক্ষমতা অর্জন করি, তখন ডা. আমাদেরকে ডায়েট কন্ট্রোল করতে বলে।
ঘুমানোর জন্য একটি খাট দরকার, একটা রাজবাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই। সারা জীবন পরিশ্রম করে আমরা যখন বসবাস করার জন্য একটা রাজমহল তৈরি করি, তখন আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হয় কাঠের শক্ত বিছানা। আমরা অজস্র টাকা রোজগার করতে জীবন পাত করি। অথচ মৃত্যুর পর আমাদের দরকার হয় সাড়ে তিন হাত জমি বা কিছু গাছের শুকনো ডাল। শেষ যাত্রায় আমাদের সাথে কোনো অলঙ্কার যায় না, দামি পোষাক যায় না, বাড়ি, গাড়ি কিম্বা আত্মীয় পরিজন কেউ সঙ্গে যায় না। পকেটবিহীন একটা সাদা কাপড়ের আচ্ছাদনে আমাদের অন্তিম যাত্রা হয়। কারো কারো মৃত্যু এত করুণ হয়, হয়তো অন্তিম সময়ে সেটুকুও জোটে না।
তবুও জীবিত অবস্থায় আমদের কত কিছু চাই। আমরা সুন্দর সঙ্গী চাই, টাকা চাই, ক্ষমতা চাই, সম্পদ চাই, খ্যাতি চাই, শুধু চাই চাই করেই জীবন পাত করে ফেলি। অথচ পৃথিবীর এত অয়োজন, কেবল ধ্বংস হবার জন্যেই। এত প্রাণের জন্ম, কেবল মৃত্যু হবার জন্যেই। এসব কথা কোন মায়া বলে আমরা একেবারেই ভুলে যাই। রিমিদের এখনই আনন্দ। কেউ চেনে না। কেউ জানে না। এই না চেনার, না জানার কারণে তাদের কোনো বাধা নেই। খ্যাতির বিড়ম্বনা নেই। স্বাধীন চলাচলে কোনো হস্তক্ষেপ নেই। কোনো নিরাপত্তা কর্মীর প্রয়োজন নেই। অথচ আমরা এ জীবন থেকে বেরিয়ে খ্যাতিমান হয়ে শৃঙ্খলিত জীবন বেছে নিয়ে হাসফাস করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করি।
উচ্ছ্বাসে হত-বিহবল হবার সময় এখন রিমিদের। চঞ্চল উচ্ছল, তারুণ্যদীপ্ত যৌবন এখন ওদের। বাধ না মানা বয়স এখন ওদের। ওদের পায়ে একশ ঘোড়ার শক্তি, মনে পাহাড় ভাঙার বলে। ওরা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রের বুকে। ঢেউয়ের সাথে মিতালি হলো, বালির সাথে বন্ধুত্ব হলো, নোনা জলের সাথে সখ্যতা হলো। নিচে সমুদ্র, উপরে সূর্য ওদেরকে এক অপার্থিব আনন্দে ভরিয়ে তুলল। যে আনন্দের না আছে কোন সীমা, না আছে পরিসীমা।
অনেক দিন হলো নিতিশ বাবু নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছেন। আজ মনটা ফুরফুরে। শান্ত ও স্নিগ্ধ। মনটা কোমল ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। মেঘ যত ঘন কালোই হোক না কেন, একসময় সে মেঘ কেটে সূর্যের আলো ঠিক মাটি স্পর্শ করে। অন্ধকার দূরীভূত হয়। যে সূর্য আঁধার কেটে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেয় চরাচর, সেই সূর্যই আবার মাঠ-ঘাট পুড়িয়ে চৌচির করে তোলে গ্রীষ্মে। একদিন গ্রীষ্মের দাবদাহ দূর করে প্রকৃতিতে ঠিকই বৃষ্টি নামে। শ্যামল, স্নিগ্ধ হয়ে যায় রুক্ষ বনাঞ্চল। শীতে যে গাছের পাতা ঝরে পড়ে, বর্ষায় সে গাছই পত্রপল্লবে মুখরিত হয়ে ওঠে।
সুখের পরে যেমন দুঃখ আসে, তেমনি দুখের পরেও অবধারিত ভাবে সুখ আসে। এক ঘটি কাঁদলে, একগাল হাসতেও হয়। হাসাতেও হয়। নিতিশ বাবুও নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ক্লাসরুমে বসে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। পড়ানোর বিরতিতে ছাত্রদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে? আচমকা একটা ছাত্র উঠে দাঁড়াল। নিজেকে সংকুচিত করে, ভয়ে ভয়ে বিষয় বহির্ভূত একটা প্রশ্ন করে ফেলল, স্যার মানুষ জ্ঞান লাভ করে কীভাবে? আর আমরা জ্ঞানী মানুষই বা কাদেরকে বলতে পারি?
ছাত্রটির কথা শুনে নিতিশ বাবু হাসলেন, তারপর হাত ইশারায় ছাত্রটিকে বসতে নির্দেশ দিয়ে বলে উঠলেন, দেখ বাবা, বলা হয়ে থাকে, শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং। মানে, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি মাত্রই জ্ঞান লাভ করে। একটু থেমে শ্বাস নিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, জ্ঞান লাভ হলে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি শান্তি লাভ করেন। তখন নিজেকে পণ্ডিত বলে মনে হয় না। গুরুজনের বা মনিষীদের কথায়, লেখায়, আচরণে, ভুল ধরতে ইচ্ছা করে না, বরং পরমহংসের মতো দুধ জলের মধ্য থেকে দুধ; কিংবা জল কাদার মধ্য থেকে জল শুষে নিতে ইচ্ছা করে। প্রকৃত জ্ঞানী ছাইয়ের মধ্যেও মানিক রতন খুঁজে পায়। অজ্ঞানীর কাছে সোনাও পিতল বলে প্রতিয়মান হয়।
ছাত্ররা স্যারের কথা শুনে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস রুমে পিনপতন নিরবতা। নিতিশ বাবু আবার বলতে শুরু করলেন, যিনি জ্ঞানী জ্ঞান অন্বেষণ করেই তার জীবন পার করে দেয়, অজ্ঞান তর্কে লিপ্ত হয় না বা সর্ববিদ্যাধারী রূপে নিজেকে জাহির করতেও ব্যস্ত হয় না। একজন ছাত্র বলে উঠল, স্যার এগুলোর কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ কি আপনি দেখেছেন? স্যার বললেন, হ্যাঁ, আমি নিজে প্রত্যক্ষ প্রমাণ করে দেখেছি, কোন লেখা বা কোন বই কখনোই ভালো লাগবে না, যদি না ঐ বইয়ের লেখক বা ঐ পুস্তক সম্পর্কে শ্রদ্ধা থাকে। যদি শ্রদ্ধা না থাকে, যদি দৃষ্টি বাঁকা হয়, যদি ভুল ধরার জন্যই কেউ বইটি পড়তে থাকে, তাহলে সে পরিশ্রম পন্ডশ্রম হবে। জ্ঞান নয়, বরং অজ্ঞানই লাভ হবে।
একটু ঢোক গিলে, গ্লাস থেকে একটু জল খেয়ে নিয়ে তিনি আবার বলে উঠলেন, দেখ, আমি দেখেছি, একই বই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে পড়লে অতি সামান্য হলেও উপকার হয়, অন্তত এমন মনে হবে আমি এমনটি লিখব না, বা এর থেকে ভালো বই পড়ব। এই যে এর থেকে ভালো বই পড়ার প্রেরণা, সেটাও আসবে শ্রদ্ধা থেকে, অহংকার জাত মূঢ়তা থেকে নয়। অনেক পণ্ডিত মূর্খ বা গর্দভ পণ্ডিত নিজেদেরকে জ্ঞানী ভেবে মনীষীদের লেখা নিয়ে, তাদের বক্তব্য নিয়ে, তাদের অতীতের কৃতকর্ম নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়। তর্ক ভালো, কিন্তু কুতর্ক ভালো নয়। একটি ছাত্র উঠে প্রশ্ন করল, স্যার, কোনো লেখক বা কোনো গুরুজন তো ভু্লও করতে পারে, আমরা সেটা কীভাবে বুঝব?
দেখ বাবা, প্রথমে বুঝতে হবে, তিনি যখন কথাটি বলেছেন বা লিখেছেন বা কাজটি করেছেন, তখন তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন? সে সময়, সে দেশ বা সে কালের জনসাধারণ কেমন ছিল? সেখানকার তৎকালীন শাসক-প্রশাসক কে ছিল বা কারা ছিল? এগুলো যদি জানা যায়, তখন দেখতে হবে অই সময়ে ব্যক্তিটির বা মনিষীটির নিজের জীবনে কি ঘটে চলেছিল? তিনি কাদের সাথে চলেছেন বা কেন চলেছেন, ইত্যাদি জানতে হয়, এসব জানার পর বিচার-বিশ্লেষণ করে ভুল ধরতে হয়, যদি তখনো ইচ্ছা থাকে। নতুবা মন্তব্য করলে সঠিক সিদ্ধান্ত আসে না।
ছাত্ররা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন বহু যুগের অন্ধকার তাদের চোখ থেকে দূরীভূত হচ্ছে। যেন এইমাত্র তাদের চোখে জ্ঞানের আলো এসে প্রবেশ করল। নিজেদের ক্ষুদ্র গণ্ডির, সংকীর্ণতা থেকে কে যেন একটানে বিশাল সমুদ্রের ধারে এনে দাঁড় করাল। একজন ছাত্র জানতে চাইলেন, স্যার, মনিষীরাও কি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়? স্যার বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা তো জানি, একটি মানুষের বক্তব্য বা লেখা বা কাজ সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক বিষয়াবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেটা বহু বছর আগের লেখা হোক বা তাৎক্ষণিক লেখা হোক। আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কোন লেখা পড়ে না। আর মনিষীরা কোন স্বর্গীয় দূত নয়, তারা আমার তোমার মতই মানুষ। অধ্যাবসায় দ্বারা তারা উন্নততর মানুষে রূপান্তরিত হয়। চেষ্টা করলে, অধ্যাবসায় থাকলে, তুমিও একজন হতে পার। পৃথিবীতে নিজের কীর্তি স্তম্ভ রচনা করতে পার।
একজন ছাত্র প্রশ্ন করল, স্যার কোন কাজ বা লেখার গুরুত্ব কি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়? নিতিশ বাবু বলে উঠলেন, হ্যাঁ সে তো হয়ই। লেখার বা বক্তব্যের বা কাজের গুরুত্ব, সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন দেখ, আমাদের পূর্বপুরুষদের ঘোড়ার প্রয়োজন ছিল, ডিঙি নৌকার প্রয়োজন ছিল, আমাদের নেই। আমাদের মোটরসাইকেল, স্পিডবোট হলেই চলছে। পূর্বপুরুষেরা যদি ঘোড়া বা ডিঙি নৌকার প্রশংসা করে, আমরা কি সেটা খারাপ ভাবে দেখব? ছাত্ররা একসাথে বলে উঠল, না স্যার। নিতিশ বাবু আবার বলে উঠলেন, যেমন ধরো, এক সময় ভারত বলতে অবিভক্ত ভারতকে বুঝাত, তখনকার বাস্তবতায় এই বর্তমান ভারত, বর্তমান পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। ভারত বলতে সমগ্র উপমহাদেশকে বুঝাত। এখন কোন মূর্খ যদি তৎকালীন কোন মনিষীকে নিয়ে বলে, লোকটি বাংলাদেশ বিদ্বেষী, তার কথায় কোথাও বাংলাদেশ নেই, শুধুই ভারত, ভারত। তখন কেবলই হাসি পায়, তার প্রতি করুণা হয়।
ছাত্ররা স্বভাব সুলভ সারল্যে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি সংক্রমিত। নিতিশ বাবুও হেসে উঠে বলতে শুরু করলেন, যেমন ধরো কোন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে কেউ গালি দিতে পারে। প্রকাশ্যেও দিতে পারে, অপ্রকাশ্যেও দিতে পারে। যদি সামনাসামনি গালি দেয়, তাহলে সম্পর্ক নষ্ট হবে। সম্পর্ক নষ্ট করতে না চাইলে, বুদ্ধিমান ব্যক্তি সে পথে পা বাড়াবে না। তারপরও যদি কেউ প্রকাশ্যে গালি দেয়, তাহলে ধরতে হবে, হয় সে পাগল নয়তো, সে অই ব্যক্তি থেকে শক্তিশালী ও মোটেও তাকে গ্রাহ্য করে না। কিংবা, সে অই ব্যক্তি সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাই ভালোবাসা আসেনি, অন্যের প্রভাবে তার হৃদয়ে ব্যক্তিটির প্রতি শুধু ঘৃণাই জন্মেছে। এখন বুদ্ধিমান মানুষ এটা করতে যাবে না। নিরেট মূর্খ বা গর্দভের দ্বারাই গালাগালি সম্ভব। অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করা সম্ভব। বুঝলে বাবা, ভালো মানুষ শুধু ভালোটুকুই দেখে, খারাপের নজর গো ভাগাড়ে। মৌমাছি ফুলে বসে, গোবরে পোকা নোংরা ঘেটে বেড়ায়, সাধারণ মাছির দ্বারা মধুর তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়।
ছাত্ররা ঘাড় নাড়িয়ে `হ্যাঁ` বলে উঠল। স্যার বলতে থাকলেন, তেমনি একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা কোন মনিষীর কর্মকাণ্ডের তাৎপর্য কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে দু`পাতা পড়ে চটজলদি বোঝা সম্ভব নয়। লেখক যেই হোক না কেন, পুরোপুরি না জেনে তার সম্পর্কে বা তার লেখা বই সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা অনুচিত। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত এটা না বুঝলে, যে বুঝছে না সেটা তার ব্যর্থতা। প্রথমেই বলেছি, জ্ঞান লাভ করতে হলে শ্রদ্ধা লাগে। যার মধ্যে শ্রদ্ধা নেই, যে এক বইয়ের পাঠক, যে কুতার্কিক, যে অহেতুক মনিষীদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারে, সে আর যাই হোক জ্ঞান লাভ করতে পারে না।
ছাত্ররা সমস্বরে বলে উঠল, ঠিকই বলেছেন স্যার। এরমধ্যে একজন ছাত্র প্রশ্ন করে উঠল, স্যার আমাদের জ্ঞান অর্জনের কি কোন সীমা পরিসীমা আছে? স্যার ছাত্রটির প্রশ্ন শুনে বলে উঠলেন, খুব ভালো প্রশ্ন করেছ তুমি। আমাদের জেনে রাখা জরুরি, প্রতিটা মানুষের একটা ধারণ ক্ষমতা আছে। কেউ দশ কেজি আবার কেউ একশো কেজি ওজন বহন করতে পারে। আবার জ্ঞানকে পাত্রের সাথে তুলনা করলে, কেউ দশ লিটার আবার কেউ হয়তো একশো লিটার জ্ঞান ধারণ করতে পারে। এর বেশি নিতে চাইলে সে জ্ঞান গড়িয়ে পড়ে যায়। সে জ্ঞান মানুষের কোন কাজে লাগে না।
ছাত্রটি আবার প্রশ্ন করল, স্যার, আমাদের হৃদয়ের জ্ঞান ধারণের এই অদৃশ্য পাত্রটিকে বড় করার কি কোন উপায় আছে?
হ্যাঁ আছে, হৃদয়ে জ্ঞানের পাত্র বড়ো হবে, যদি কোন ব্যক্তি বিনয়ী হওয়া, শ্রদ্ধাশীল হওয়া, নিরহংকারী হওয়া, অনাসক্তা হওয়া, ভয়-ক্রোধ ত্যাগ করা, একনিষ্ঠ হওয়া, জিতেন্দ্রিয় হওয়ার মতো কিছু মহৎ মহৎ গুণ অর্জন করতে পারে।
ছাত্রটি এবার বলে উঠল, কারা জ্ঞান লাভ করতে পারে না স্যার?
স্যার বললেন, অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এমনকি যে গুরুজন বা মনিষীদের উপদেশে সন্দেহ করে সেও জ্ঞান লাভ করতে পারে না।
আরেকজন ছাত্র প্রশ্ন করল, স্যার, জ্ঞান লাভ করতে না পারলে আমাদের কী ক্ষতি হয়?
নিতিশ বাবু বললেন, দেখ বাবা, যার জ্ঞান লাভ হয় না, তার বই পড়ে কানার হাতি দর্শনের মতো অবস্থা হয়। বিষয় সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধি হয় না, খণ্ডিত উপলব্ধি হয়। খণ্ডিত দর্শন বা একপাশ থেকে দেখা সর্বদাই ভয়ংকর। আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। মনিষীরাও আমার আপনার মতো মানুষ ছিলেন। অথবা এমন ভাবে বলতে হয়, পৃথিবীতে যারা জন্মগ্রহণ করেছে তারা মানুষ হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছে। তাঁদেরও ভুল হতে পারে। সেটাকে বড় করে না দেখে, তারা কি দিয়েছে সেটাকে বড় করে দেখতে হবে। তাহলেই আমাদের জ্ঞান লাভ হবে। আমাদের বুদ্ধি বলে দেবে কোনটা গ্রহণ করতে হবে, কোনটা পরিত্যাজ্য। শুধু ভুল ধরার ইচ্ছায় জীবন পাত করলে ভুল ধরা হবে, জীবনে সঠিক ধরা হবে না।
এটা সবসময় মনে রেখ, মানুষ তার পূর্ব সংস্কার দ্বারা পরিচালিত। যেটা আজ আমার খারাপ লাগছে, হতে পারে সেটা আমার পূর্ব সংস্কারের কারণেই লাগছে। নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলতে পারলে ভালো, না পারলে অহেতুক বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে শ্রদ্ধাহীন, অজ্ঞানী, মূঢ় হয়ে কী লাভ?
স্যারের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হতে না হতেই স্কুলে ছুটির ঘন্টা বেজে গেল। স্যার তার ক্রাচ ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসের বাইরে পা বাড়ালেন। ছাত্ররাও স্যারকে অনুসরণ করে বাইরে বেরিয়ে এল।
আজ নিতি প্রাইমারী সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নোত্তর পাওয়া যাবে এমন ধরণের গাইড কিনতে নীলখেতে এসেছে। দীপ এসেছে তার ইংরেজি শিক্ষার কিছু বই কিনতে। দু`জন দুদিক থেকে বই খোঁজ করতে করতে হঠাৎ একটা বইয়ের দোকানে একে অপরের সামনে এসে পড়ল। দু`জন চোখ মোটা মোটা করে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, আরে, তুমি এখানে? চলবে