
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩৬
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১২, ২০২০
মাঝনদীতে নৌকা যখন ঘুরপাক খেয়ে পথ হারিয়ে ফেলে, তখন একটা কূল চায়। গন্তব্য না হলেও একটা কূলের দরকার হয় তার। যে কূলে নৌকা ভেড়ালে জল থেকে অন্তত ডাঙায় ওঠা যায়। রিমির অবস্থাও তেমন হয়েছে। মহম্মদপুরের স্কুল মাস্টার সুমন বাবুর সাথে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল রিমির। লম্পট সুমনের লাম্পট্যে কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে বিরহে পরিণত হয়। ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্স হবার পর মাঝনদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। এখন একটা আশ্রয় দরকার। যেখানে নিশ্চিন্তে নোঙর করা যাবে জীবন নৌকা।
শুভ পাশে বসে আছে। হাতে হাত রেখে। হাতে হাত রাখলে নির্ভরতা আসে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। শুভ হাত ধরে আছে, তবুও শুভকে বিশ্বাস করতে পারছে না রিমি। কেবলই মনে হচ্ছে, শুভ কি ভ্রমরের মতো এসেছে তার জীবনে? মধু পান করার উদগ্রবাসনা নিয়ে। রিমি কি নিছকই একটা ফুল। যার মধু খেয়ে যাবে অচেনা ভ্রমর। যার পাপড়ি কাটবে অচেনা পোকায়। কখনোই ঠাকুর পূজার কাজে লাগবে না এমন এক অভিশপ্ত ফুল? এত কিছু ভেবে কি জীবন চলে? রিমির খুব লোভ হচ্ছে শুভর ভালোবাসা পাবার। শুভ কি সত্যিই ভালোবাসবে? না কি সে ব্যবহৃত হবে একটা খেলনার মতো, এ হাত থেকে অন্য হাতে?
আচমকা রিমির দুটো গাল হাত দিয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকল শুভ। অন্ধকার রাত। নীরব বিচ। সমুদ্রের অবিচ্ছিন্ন গর্জন। পাশাপাশি দু`জন নারী-পুরুষের শরীরের উত্তাপ। সবকিছু ছাপিয়ে এই অবিশ্রাম চুম্বন। রিমির সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। লোমকূপে শিরশির অনুভূতি শুরু হলো। মাথায় ঘোর লাগল। চোখ বুঁজে আসল। সমস্ত শরীর লাউয়ের ডোগার মতো এলিয়ে পড়ল। নরম হয়ে এলো ঘাড়। বাধা দেয়ার ইচ্ছে একেবারেই করল না। নিজেকে সমর্পণ করার ইচ্ছায় সমস্ত শরীর কাদার দলার মতো হয়ে এলো। কপালে জমল বিন্দু বিন্দু ঘাম। কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। রিমি আর সহ্য করতে পারল না।
দু`হাতে শক্ত করে শুভকে জড়িয়ে ধরল। সমস্ত শরীর মিশে যেতে থাকল অন্ধকারে। গলা, ঠোঁট, কপাল কিছুই বাদ থাকল না। একে অপরের সমস্ত শক্তি নিয়ে দু`হাত পিশে দিতে চাইল দুটো শরীর। শরীরের আগুনে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে তৈরি হলো বাদলা পোকার মতো। সমস্ত সত্তা, সমস্ত জগত, ইহকাল-পরকাল, সব মিথ্যে। সব অদৃশ্য, সব কল্পনা, শুধু এই দুটি দেহ সত্য। এই দুটি শরীরের উন্মাদনা সত্য। এই অবিশ্রাম আদর সত্য। এই সমর্পণ সত্য।
‘এই চিপস, চিপস নেবেন’ ডাকে সম্বিত ফিরে পেল দুজন। দূর থেকে একটি ছেলে চিপস হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। দুজন স্বাভাবিক হয়ে দুদিকে মুখ দিয়ে তাকাল। তখনো শরীর কাঁপছে। মাথা দপদপ করছে। চোখে ঘোর লাগা অনুভূতি। পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, অফিসিয়াল সম্পর্ক, কোনও সম্পর্কই মজবুত না, যদি না তাতে স্বার্থ থাকে। স্বার্থই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে। স্বার্থ ছাড়া সব সম্পর্ক ভিত্তিহীন। নোংরা স্বার্থই সম্পর্ককে চালিয়ে নেয়। স্বার্থ ফুরালে সম্পর্কও ফুরিয়ে যায়। প্রেম, ভালবাসা সবই কামনা-বাসনার স্বার্থে। দেহ সুখের তাড়নায়।
বিচের এক প্রান্তে যখন শুভ-রিমি একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে, তখন বিচের অপর প্রান্তে শোভা-আদনান নিজেদেরকে নতুনভাবে রাঙিয়ে নিচ্ছে। মাতাল করে তুলছে সমস্ত সত্তা। সমস্ত অস্তিত্ব। আদরে আহ্লাদে জাগিয়ে রাখছে একে অপরকে। তপু-তুলি সমুদ্রের কিটকট চেয়ারে আর স্থির থাকতে পারল না। হোটেল ফাঁকা। যে রুমে শোভা, রিমি ও তুলি উঠেছে, সে রুমে সে বেডে তপুর পাশে তুলিকে মানিয়ে গেল। উদ্যম যৌবনের আদিম আনন্দে মেতে উঠল নির্জন কক্ষ।
সমুদ্র বড় ভয়ানক জায়গা। সমুদ্রের ধারে এলে নদীর মতো ক্ষুদ্র সংস্কার আর থাকে না। পবিত্র গঙ্গার জল, অপবিত্র ড্রেনের জল, সব একাকার, সব লবনাক্ত হয়ে যায়। সর্বগ্রাসী আগুন, সর্বংসহা মাটির মতো বিশাল জলধি সমস্ত জলই ধারণ করে। একাকার করে দেয়। মানুষও এখানে আসলে একাকার হয়ে যায়। পাপপুণ্য, ভালোমন্দ, সব এক ফুঁৎকার উড়ে যায়। শরীর মুখ্য হয়ে উঠে, আদর আদরনীয় হয়। আজ রাত ওদের জীবনে বাসরশয্যা হয়ে এলো, আনমনে, আচমকা।
কয়েকদিন হলো নিতি একটা টিউশনি শুরু করেছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশে রিচিদের বাসা। রিচি হাইস্কুলে পড়ছে, ক্লাস সিক্সে। ওর দাদা বুয়েট থেকে ট্রিপলই তে বিএসসি করে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ঢাকাতেই পোস্টিং। নাম শোভন সরকার। অফিসের অনার বোর্ডে লেখা থাকে প্রকৌঃ শোভন সরকার। সহকারী প্রকৌশলী। আজ সন্ধ্যায় রিচিকে পড়িয়ে বাসা থেকে বের হবার সময় শোভনের সাথে নিতির দেখা হয়ে গেল। গেটের কাছেই। শোভন বাসায় ঢুকতে যাচ্ছে, নিতি বেরিয়ে যাচ্ছে।
মুখোমুখি দুজনের চোখে চোখ পড়তেই শোভন বলে উঠল, আপনার ছাত্রীর পড়াশোনা কেমন চলছে?
ভালো, বেশ ভালো। অনেক মনোযোগী।
কেমন আছেন আপনি?
ভালো আছি। আপনি?
আমিও ভালো? বুঝতে পারছেন আমি কে?
আপনার কথা রিচির মুখে খুব শুনেছি। দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আজ হলো। নিতি ঠোঁটদু`টো প্রসারিত করে একটু হাসল।
আরে না না, কি যে বলেন। আমি অত বড় মানুষ নই, যে দেখা পেতে সৌভাগ্য লাগবে। বরং আপনার সাথে দেখা হয়ে বেটার ফিল করছি।
নিতি নিঃশব্দে মিষ্টি করে হেসে উঠল, কী যে বলেন না! বেটার ফিল...
শোভন নিতির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে, মিথ্যা কোথায় বললাম, অফিস থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত লাগছিল, এখন চাঙা লাগছে।
আপনি বাড়িয়ে বলছেন। আমি অতটাও...
না না, বিষয়টা আসলে সেটা নয়?
বিষয়টা কি?
আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন।
এটা একটু বেশি হয়ে গেল। আমি ঝগরুটে।
আপনি ঝগরুটে! অই ডোন্ট বিলিভ। আপনি অনেক মিষ্টি করে হাসেন?
নিতি লজ্জা পাচ্ছে। মুখ রক্তাভ হয়ে উঠছে। কথাগুলো শুনতে ভালোও লাগছে, তবুও সহাস্যে বলে উঠল, ইঞ্জিনিয়ার মানুষ এত কথা জানে, জানা ছিল না।
টিস্যার এত সুইট হয় সেটাও জানা ছিল না।
ধুর কি যে বলেন। হা হা হা। মুখে লাগাম নেই বোধহয়।
সত্য একটু লাগামহীন হয় ম্যাডাম।
বাদ দেন, বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, বাদ দিলাম।
নিতি চলে যাচ্ছিল। পা বাড়ানোর আগে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, নাইচ টু মিট ইউ।
সেম টু ইউ। আবার দেখা হবে নিশ্চয়।
আপনাদের বাড়িতে যখন আসছি। দেখা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
গুড নাইট
গুড নাইট।
দুজন দুদিকে চলে গেল। কিছু অনুভূতি ছড়িয়ে গেল দুটি তরুণ হৃদয়ে। দুজনের মনে প্রজাপতির পেখম মেলা আনন্দ। মুখে সলজ্জ হাসি। একটা অজানা শিহরণ।
দীপের সাথে একই ব্যাচে ভর্তি হয়েছে লরেটা গোমেজ। ক্যাথলিক খ্রিস্টান। বাবা লন্ডনে স্থায়ী হয়েছে, এখন স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে যেতে চায়। লরেটা ভালো ইংরেজি বলে। ইউরোপিয়ান স্টাইলে চলাফেরা করে। ড্রাইভ করতে জানে। নিজের গাড়ি নিজেই চালিয়ে আসে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ক্লাস রুমে দীপের সাথে আজই কথা হলো। দুজন পাশাপাশি সিটে বসেছে।
স্মার্টফোনটা পাবার পর রাধার জীবন যেন এক লহমায় বদলে গেল। এখন যখন-তখন কথা হয় সুনন্দের সাথে। বেশিরভাগ সময় সুনন্দই ফোন দেয়। অনেক সময় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রাধাও ফোন দেয়া শুরু করেছে। নতুনভাবে জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে রাধা। সুমনের কারণে যে ট্রমায় ভুগছিল সে, সুনন্দের প্রভাবে তার অনেকটাই কেটে গেছে। এখন রাধার দু`চোখ স্বপ্ন দেখতে জানে৷ নীল আকাশে ডানা মেলে উড়বার স্বপ্ন। চলবে