
নিতির গল্প
উপন্যাস ৪১
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২০
খুব সুন্দর দেখাচ্ছে নিতিকে। মাথার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ভেজা চুল। চুল থেকে পিঠে জল চুইয়ে পড়ছে। সেসব চুলের দু`একটা ঠোঁটের কোনায় লেপটে রয়েছে। মুখে জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু জল। সূর্যের আলো পড়ে জলবিন্দু হীরার মতো জ্বলছে। বাতাসের ঝাপটা এসে দু`একটা চুল উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আনমনে, অকারণে। নবগঙ্গার শীতল জলে ডুব দিয়ে এইমাত্র উঠে এলো নিতি। পায়ে রুপোর নূপুর। ঢাকায় থাকলে নূপুর পরা হয় না। গ্রামে এলে তুলে রাখা নূপুরের সন্ধান পড়ে। গ্রাম মানুষকে পবিত্র করে তোলে। স্নিগ্ধ করে তোলে। শান্ত প্রকৃতি মানুষের মনে শৈশব জাগিয়ে তোলে।
নিতি বাসায় এসে ভেজা কাপড় বদলে নিল। অনেকদিন শাড়ি পরা হয় না, আজ একটা শাড়ি পরল। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। কপালে লাগাল লাল টিপ। কপালের মাঝখানে সিঁথি কেটে চুল দু`পাশে এলিয়ে দিল। অসম্ভব সুন্দর লাগছে এখন। একবার দেখলে মুখ ঘুরিয়ে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে। বারবার দেখলে আরো একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের পলক পড়ছে না।
ইশ্, কত সুন্দর লাগছে তোমাকে। দীপের গলা স্পষ্ট শুনতে পেল নিতি। কোথায় দীপ? ঘরের মধ্যে? ক্রস্ত হরিণীর মতো চোখে মেলে ঘরটা একবার দেখে নিল। কোথায় দীপ? দীপ তো নেই! এক দৌড়ে বাইরে এলো। এদিক ওদিক চাতকির মতো তাকাল। কোথায় দীপ? আমি কী তাহলে ভুল শুনলাম? এতটা ভুল হতে পারে! নিতির মন বিমর্ষ হয়ে গেল। দু`চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিতি মন খারাপ করে বারান্দায় চৌকির উপর বসে পড়ল। হঠাৎ কোথা থেকে রাধা, ছায়া, সোমা দৌড়ে এল। চারদিক থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে ধরল। টানতে লাগল নিতির হাত।
কী রে দিদি, তুই এখনো এখানে বসে আছিস? এদিকে কলাবউ স্নান এখনো বাকি রয়েছে। কাকিরা অপেক্ষা করছে। ওঠ, আরে ওঠ না। তাড়াতাড়ি চল। রাধা বলে উঠল।
আ মহাসপ্তমী। নবপত্রিকা স্নান করাতে চলেছে ওরা। নদীর পথে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে। সবার আগে হেঁটে যাচ্ছেন পুরোহিত। তার কাঁধেই নবপত্রিকা। পুরোহিতের পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। মহিলারা যাচ্ছে শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে। গ্রামের কাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে বউদের হাসি আনন্দে মুখরিত নদীর পথ। পুরোহিতের কাঁধে একটি করে কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান গাছের চারা। তিনি নদীর জলে গাছের চারাগুলো নামালেন। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানো হলো নবপত্রিকা। স্নান শেষে ঢাকের শব্দে গ্রামের রাস্তা মুখরিত করে পূজামণ্ডপে ফিরে এল নবপত্রিকা।
সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো। নববধূবেশে লাগিয়ে দেওয়া হলো সিঁদুর। সপত্র কলাগাছ সহ নবপত্রিকাকে গায়ে ঘোমটা টানা বউয়ের মতো করে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি জড়ান হলো। যেন নতুন বউ লজ্জায় একহাত ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নিতি, রাধারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পূজা পদ্ধতি দেখছে। সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে কলাবউকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করল পুরোহিত। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হলো। ঢাকা-কাসর বেজে উঠল। কলাবউ দাঁড় করিয়ে প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই নবপত্রিকার পূজা শুরু হলো। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হলো, সকলের চোখেমুখে আনন্দ। নিপু মা-দিদির সাথে পূজার অনুষঙ্গ দেখছিল। বাড়ি ফিরে নিতিশ বাবুর কাছে প্রশ্ন করল, বাবা নবপত্রিকা কী?
নিতিশ বাবু ছেলেকে পাশে বসিয়ে নিলেন। স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।
কিন্তু বাবা, কলাগাছ সহ নয়টি উদ্ভিদ কেন পূজা করা হয়?
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক। উদ্ভিদকে প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়। যেমন ধরো,
কদলী: কলা গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
কচু: কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা;
হরিদ্রা: হলুদ গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা;
জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী;
বিল্ব: বেল গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা;
দাড়িম্ব: ডালিম গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
অশোক: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা;
মান: মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
ধান: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
এই নয় দেবী একত্রে নবপত্রিকাবাসিনী নবদূর্গা নামে নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন।
কিন্তু এটা করে লাভ কী বাবা? নিপুর সরল কৌতুহল। চোখে বিস্ময়!
নিতিশ বাবু বলে উঠলেন, দেখ, নবপত্রিকার পূজা আসলে শস্যদেবীর পূজা। শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক ভেবে পূজা করা হয়। দূর্গা পূজার আড়ালে এই শস্য-দেবীরই পূজা। শস্য-দেবী পৃথিবীরূপি মা। আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও পৃথিবীর পূজা মিশে আছে। যেহেতু শস্য আমাদের খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, তাই প্রতীক রূপে শস্য পূজা করা হয়। তাছাড়া রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ আছে। সেজন্যও এটা চলমান আছে।
কিন্তু বাবা, আমরা এই প্রতীক পূজা কেন করি? ঈশ্বর তো নিরাকার। নিরাকার উপাসনা কেন করি না?
আচ্ছা উত্তর দিচ্ছি, তার আগে তুমি আমার বাঁধানো ছবিটা খুলে নিয়ে আসো তো বাবা।
নিপু কোনও পাল্টা প্রশ্ন করল না। বাবার নির্দেশে বাবার বাঁধানো ছবিটা খুলে আনল। বাবার কথায় সেটা চৌকির উপর রাখল। এবার নিতিশ বাবু বলে উঠলেন, এবার তুমি আমার ছবিতে থুতু দাও।
নিপু অবাক! বাবা কী পাগল হয়ে গেল? না হলে নিজের ছবিতে কেউ নিজে থুতু দিতে বলে। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে মুখ ভার করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। বাবার ছবিতে থুতু দিতে পারল না। বাবা তার মুখের অবস্থা দেখে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, বলছি না আমার ছবিতে থুতু দিতে?
নিপু এবার ভয় পেয়ে গেল। `মা বাবা বকা দিচ্ছে` বলে কেঁদে উঠল। নিপুর কান্না শুনে মা, নিতি ছুটে বারান্দায় চলে এল। নিপু কাঁদছে, বাবা হাসছে। নিতি অবাক! প্রশ্ন করে উঠল, কী হয়েছে বাবা, তুমি ভাইকে বকছ কেন?
নিতিশ বাবু বলে উঠলেন, কিছু না, তোর ভাই বলছিল, আমরা প্রতীক পূজা করি কেন? নিরাকার উপাসনা কেন করি না? তাই আমার ছবিতে থুতু দিতে বলছিলাম।
কী বলো বাবা, তোমার ছবিতে থুতু দিতে যাবে কেন? নিতির ভ্রু কুঁচকে গেল। সে যারপরনাই বিস্মিত।
বাবা হাসছে। সে হাসির মধ্যে বিস্ময় লুকিয়ে আছে। একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। তিনি উত্তর দিলেন, কেন দোষ কী? আমার মুখে তো দিচ্ছে না, দিচ্ছে আমার ছবিতে। ওটা কী আমি? ও তো একটা কাগজ-কালির সমাহার মাত্র।
নিতি দৃঢ় প্রতিবাদ করে উঠল, এ কেমন কথা বলছে তার বাবা? এ কী মেনে নেয়া যায়? নিতি বলে উঠল, তবুও। ছবিতে চুমু খাওয়া যায়। মনে হয় তোমার গালেই আদর এঁকে দিচ্ছি। ছবি দেখলে মনে হয়, আমার বাবা কাছেই আছে। তোমার কথা মনে পড়ে যায়। থুতু দিলে তো মনে হবে তোমাকে ঘৃণা জানাচ্ছি। মানুষ যেমন শয়তানের প্রতীক কল্পনা করে পাথর ছোঁড়ে, কুশপুত্তলিকা পুড়ায়, ছবিতে কাঁদা ছুড়ে ঘৃণা জানায়, তেমন কেউ কী তুমি? তুমি তো আমাদের বাবা।
নিতিশ বাবু নিতির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, এই তো এবার বুঝেছ। দেখ মা, প্রতীককে ঘৃণা করা গেলে, প্রতীককে ভালোবাসা কেন যাবে না? ঠিক ঠিক বিশ্বাস থাকলেই হলো। এই যে মাটির প্রতিমা, পাথরের প্রতিমা, গাছ, চন্দ্র, সূর্য, হিন্দুরা পুজো করে? এ কী এমনি? কল্পনা করে এই প্রতীকের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান আছে। ঈশ্বর তো সর্বব্যাপী। সকল সময়ে, সব স্থানে তাঁর বসবাস। সে যেমন আকাশে আছে, যেমন মানুষের মধ্যে আছে, তেমনি এই গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, মাটি-পাথরের মধ্যেও আছে। ঠিক ঠিক দেখার চোখ থাকলেই হলো। যেমন জল বাষ্প হলে দেখা যায় না, কিন্তু ঠাণ্ডায় বরফ হলে তখন দেখাও যায় আবার আকৃতিও পায়। ঈশ্বর জলের মতোই সাকার আবার নিরাকারও। ভক্ত তাকে ভক্তিহীমে সাকার রূপে কল্পনা করে খুশি হয়। ঈশ্বরকে কাছাকাছি অনুভব করে। যে বড় ভক্ত তার মূর্তি পূজা লাগে না। সে তখন সর্বত্র ঈশ্বরের দর্শন পায়। যেমন তুই, ঢাকায় থাকতে আমার মুখ কল্পনা করতে কী তোর ছবি লাগে?
নিতি, নিপু দুজনেই বুঝল। এই প্রতীক পূজা আসলে ঈশ্বরকে কল্পনা করেই পূজা। যিনি বড় ভক্ত তার কল্পনা লাগে না। সে নিরাকার ঈশ্বরকে সর্বত্র দেখতে পায়। তার ঈশ্বর মূর্তির মাঝে আবদ্ধ থাকে না। অধম ভক্তের মূর্তির আনুষ্ঠানিকতা লাগে উত্তম ভক্তের এসব কিছুই লাগে না। চলবে