নিষুপ্ত সাগরের ৩ কবিতা
প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০২০
টিএসসি
প্রিয়তমা এস্থেটিকা;
তুমি ডেমরার কোণাপাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ো!
কিন্তু তোমার নন্দনতত্ত্বের প্রশংসা টিএসসি’র প্রতিটা মামা করেন।
টিএসসি’কে করেছ তুমি তোমার দ্বিতীয় গৃহ! নাকি প্রথম?
তোমার দেশাল-ভেশাল-ত্রিশালের শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কবি’রা হামাগুড়ি দেন!
তোমাকে নিয়ে তাদের লেখা কবিতা দাগ কেটে যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে!
ফটোগ্রাফার’রা তোমার ছবি তুলতে পারলে রতিক্রিয়ার আনন্দ লাভ করেন।
তোমার কালো কালো ঘোলা ঘোলা ঝিরঝিরা ছবির নন্দনতত্ত্বের ভার নিতে গিয়ে
প্রায়ই আমার কম্পিউটার হ্যাং হয়ে যায় হে এস্থেটিকা!
তোমার চক্রাবক্রা টিপ আর পেন্ডেন্টের জাদুতেই মনে হয়—
শহরের নতুন নতুন গাঁজাখোরগুলাও ইদানিং এস্থেটিক হয়ে উঠছে!
ঢাকায় এখন ভ্যাজাইনা ফ্লেবারের সীসা পাওয়া যায় প্রিয়তমা!
দেশ নিয়ে তোমার ভাবনা আমাদের বিচলিত করে।
আত্মহত্যা নিয়ে তোমার মতামত আমাদের শিহরিত করে।
নারীবাদ নিয়ে তোমার অবস্থান আমাদের উদ্দীপ্ত করে।
প্রিয়তমা এস্থেটিকা;
প্রিয়তমা!
প্রিয়তমা!
অহহ প্রিয়তমা অহহ..!
তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যেন নন্দনতত্ত্বের চিড়িয়াখানার বাইরে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন করা!
আত্মহত্যাপ্রবণ কামুক অসুর
আমি, মানে কুঁজঅলা একটা প্রাচীন কামুক অসুর;
এই ভয়ংকর পরিখা ঘেরা পাথরের দূর্গটার পাশে কুঁজো হয়ে বসে আছি—
কেননা আমি জেনেছি এই দুর্গটার ভেতরেই আছে সেই অতল নারী,
সহস্র প্রেমিক-প্রেমিকার মোহ-মায়ার বলয়ে সুরক্ষিত পদ্মের মতো যে ফুটে আছে
অচিন এক প্রেম নিয়ে।
বিশাল এই পাথরের দূর্গের পাশে কুঁজো হয়ে বসে আমি—
মানে সেই প্রাচীন কুৎসিত অসুর;
ভাবছি সেই সুরক্ষিত পদ্মটি ছিনিয়ে নিয়ে ভাসিয়ে দেব আমার চোখের কোটরে!
অথচ সেই পাথরের দূর্গটির কোনও প্রবেশ দরজা নেই; একটি জানালা আছে—
গতকাল মায়া জাগা ভোরে আমি সেই নারীকে সে জানালায় দেখেছি,
তার প্রেমিকের সাথে— রাতজাগা ক্লান্তি নিয়ে তারা হাসছিল,
সে সময়তেই পরিখার কুমিরগুলোর ওপরে মায়া জন্মে যায় আমার,
রাতেই যাদেরকে আমি একটা একটা করে আছড়ে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
বিশাল এই পাথরের দূর্গের পাশে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি—
মানে একটা প্রাচীন নির্দয় অসুর;
সেই অতল নারীর বাসনায় অসহ্য বিপন্ন বোধ করি,
তখন আমার খসখসে রোমশ চামড়াতে উকুনগুলোর যন্ত্রণা তেমন বোধ করি না।
অসুর হয়ে জন্মানোর অপরাধবোধও কেমন কমে আসে!
আমি পরিখা ঘিরে চক্রাকারে দৌড়াতে শুরু করি— দৌড়াতে থাকি— দৌড়াতে থাকি,
অনুভব করি পিঠের কুঁজটা হালকা হয় ক্রমশ,
আচমকা সেটি ফেটে দুটি শুভ্র ডানা বেরিয়ে আসে!
হায় পৃথিবী, আমি উড়তে পারছি!
আমি, মানে সেই কামুক অসুরটা চিলের মতো ভেসে ভেসে সেই জানালাটা খুঁজি,
অথচ জানালাটি পাওয়া যাচ্ছে না!
আমি আমার অসুরের শক্তি নিয়ে পাথরের দূর্গটি আঘাত করতে থাকি!
আঘাত করতে থাকি!
দূর্গটি কেঁপে কেঁপে ওঠে, কিন্তু আমি ভেতরে যাবার কোনও পথ পাই না।
আমার আসুরিক রাগ হয়। আমি সেই অতল নারীর প্রতি ঘৃণা বোধ করি!
ঠিক সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করি আমার ডানা দুটি নেই।
আমি নিচে পড়তে থাকি!
আকাশের দিকে মুখ রেখে ডানাভাঙা আহত ফেরেস্তার মতো আমার পতন হয়।
আমি, মানে সেই আত্মহত্যাপ্রবণ প্রাচীন অসুরটা পরিখায় ছিটকে পড়ি;
কুমিরগুলো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
খুন হতে হতে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে হতে আমি সেই অতল নারীর কথা ভাবি—
যাকে আমি ভাসাতে চেয়েছিলাম আমার চোখের কোটরে!
ক্যান্সার
বাসা থেকে প্রতিদিন হাসপাতালে খাবার নিয়ে যেতে যেতে আমি
আমার পাতলা হতে থাকা চুলগুলো নিয়ে আতঙ্কিত বোধ করি!
আমার চুলের মতোই আমার আম্মার আয়ুও কমছে দ্রুত!
আম্মা চলে গেলে আমার কী হবে! তা ভাববার চেয়ে আমি যেন
আমার চুল পড়া নিয়ে বেশি আতঙ্কিত বোধ করি আজকাল!
আবার এটাও হতে পারে যে, ‘আম্মা চলে গেলে আমার কী হবে?’
—এটা ভেবে আতঙ্কিত হবার মতো সাহস আমার নাই!
এরচেয়ে বরং চুল হারানো নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া বেশি সহজ।
টাকা হারানো নিয়েও আতঙ্কিত হওয়া সহজ।
কিংবা চাকরি হারানো নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া যায় বেশ।
কেবল আম্মা চলে গেলে আমার কী হবে—
এটা ভেবে আতঙ্কিত হবার মতো সাহস আমার নাই!
তবু ক্যান্সারটা যখন প্রতিদিন আম্মার শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে
আমার চুল পড়ার চেয়েও দ্রুত গতিতে; তখন
আম্মা চলে গেলে আমার কী হবে? —তা ভাববার চেয়ে আমি
আমার চুলা পড়া নিয়ে বেশি আতঙ্কিত বোধ করতে থাকি।
কেমোথেরাপি দেয়ার আগে আম্মার চুল কামিয়ে ফেলা হলো,
ছয়টি কেমোথেরাপির পরে আম্মাকে ছত্রিশটি রেডিওথেরাপি দেয়া হলো।
দেখতে দেখতে শুকিয়ে বালুচরের মরা গাছের মতো হয়ে গেল আম্মা;
তবুও আমি এ নিয়ে তেমন আতঙ্কিত হলাম না!
থেরাপির আগে পরে তিনবার অপারেশন, হিম আইসিইউ, ওষুধের রঙিন সমুদ্র,
বেঁচে থাকার ঘোরতর অনিশ্চয়তা আর হাসপাতালের নিঃসঙ্গ করিডোরে
ভূতের মতো আব্বার হাঁটাহাঁটিও আমাকে আতঙ্কিত করলো না।
আসলে সবকিছু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া যায় না।
সবকিছু নিয়ে আতঙ্কিত হবার মতো সাহস সবার থাকেও না!
বাসা থেকে তাই প্রতিদিন হাসপাতালে খাবার নিয়ে যেতে যেতে আমি
আম্মার চলে যাওয়ার তাড়াতে খুব একটা বিচলিত হই না।
যদিও আমার চুলের মতোই আমার আম্মার আয়ুও কমছে দ্রুত!
৪৮ পৃষ্ঠার কবিতার বইটি বইমেলা ২০২০ এ বৈভব থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কবির ‘জন্মান্ধা প্যাঁচা’ কবিতার বইটি। এ বই থেকে তিনটি কবিতা এখানে পুনর্মুদ্রণ করা হলো। ৩৫% ছাড়ে বইটির বর্তমান দাম ১৬০ টাকা। বইটি অর্ডার করতে ঢুঁ মারুন https://web.facebook.com/boibhob.pub/?hc_location=ufi
























