নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০২৫

১৯০৭ সাল। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন তখন কলকাতায় ফিনান্স অফিসার হিসেবে সরকারি কাজে ১৮ বছর সাত মাস বয়সে যোগদান করেন। কিন্তু চাকরির থেকে পদার্থবিদ্যা ছিল অনেক প্রিয়। একদিন বউবাজার স্ট্রিট দিয়ে ট্রামে করে যেতে যেতে রামনের চোখে পড়ল একটি নামফলক, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্সেস।

সূর্যমুখী ফুল যেমন সূর্যের দিকে চেয়ে দেখে, রামনও সেদিন ওই নামের ফলকের  দিকে তেমনভাবেই তাকিয়ে ছিলেন। দেখামাত্রই ট্রাম থেকে নেমে রামন যখন এই অ্যাসোসিয়েশনের বাড়িতে প্রবেশ করেন তখন সেখানে হাজির ছিলেন এই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের পুত্র অমৃতলাল সরকার।

মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে হেঁটেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর  দি কাল্টিভেশন অফ সাইন্সেস (IACS)। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য মহেন্দ্রলাল নিজে দেখে যেতে পারেননি। ১৯০৪ সালে মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর তার পুত্র অমৃতলাল এই অ্যাসোসিয়েশনের অবৈতনিক সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।

অমৃতলালের সঙ্গে দেখা হয় যখন, রামন ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি অবসর সময়ে অ্যাসোসিয়েশনে এক্সপেরিমেন্ট করতে আসতে পারেন? আনন্দে আত্মহারা হয়ে তখন অমৃতলাল সরকার রামনকে জড়িয়ে ধরে বললেন যে, বহু বছর ধরে এমনই কারোর সন্ধানে তিনি অপেক্ষা করছিলেন এবং মহেন্দ্রলাল সরকার বেঁচে থাকলে আজ তিনি কত আনন্দই না পেতেন।

১৯০৭ সালের সেই দিন থেকে ১৯৩৩ সালে কলকাতা ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষামূলক গবেষণা রামন IACS এর পরীক্ষাগারেই করেন। তখন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন আশুতোষ মুখার্জী। তিনি নিজেও কৃতি গণিতজ্ঞ ছিলেন। রামনের গবেষণার কাজ তার নজরে পড়ে। এরপর তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন এবং ১৯১৪ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সাইন্স প্রতিষ্ঠিত হয় তখন রামনকে আমন্ত্রণ জানান সেখানে অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য।

অধ্যাপক পদের বেতন সামান্য তবুও লোভনীয় সরকারি চাকরির উচ্চপদ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ নিতে কোনো সময় লাগেনি রামনের। সকালে কাজ করতেন অ্যাসোসিয়েশনে এবং দুপুরে সায়েন্স কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ১৯২১ সালে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কংগ্রেস অফ ইউনিভার্সিটিস অফ দা ব্রিটিশ এম্পায়ার-এ আমন্ত্রণ পেলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সমুদ্র পথে জাহাজে করে দেশে ফেরার সময় তার মাথায় একটা প্রশ্ন এলো। আচ্ছা, গ্লাসের জল তো স্বচ্ছ, কিন্তু সমুদ্রের জলের রং নীল কেন? আকাশের রং নীল কেন, সে সম্পর্কে বিক্ষেপণের তত্ত্ব জানতেন রামন, কিন্তু আকাশের প্রতিচ্ছবির কারণে জলের রং নীল, এই ব্যাখ্যা তার মনে ঠিক ধরল না।

হাতের কাছে থাকা জিনিস দিয়েই তৎক্ষণাৎ শুরু করেন পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ। গ্রেটিং দিয়ে দেখলেন জলের রংয়ের বর্ণালীর সাথে আকাশের আলোর বর্ণালী মেলে না। তাতে আছে আরও কিছু অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যে, যা প্রক্ষেপণ তত্ত্ব অনুযায়ী থাকার কথা নয়। জাহাজে থাকা অবস্থাতেই লিখলেন পেপার। জাহাজ থেকে নেমেই পাঠালেন জার্নালে ছাপতে। ঠিকানা হিসেবে বাড়ি বা গবেষণাগারের ঠিকানা নয়, দিলেন সেই বন্দরের ঠিকানা যেখানে তার জাহাজটি রাখা হয়েছিল। ফিরে এসেই এই প্রশ্নটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন IACS এ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কে এস কৃষ্ণাণকে সঙ্গে নিয়ে।

কথিত আছে, গবেষণার জন্য অনুদান সংগ্রহের সময় নাকি তিনি বলেছিলেন, আমি যদি এটা করে দেখাতে পারি, আমার মনে হয় আমি ভারতের জন্য একটা `নোবেল` আনতে পারি। যে পরিকাঠামো নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন তা আজকে দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। তার তৈরি স্পেক্ট্রোগ্রাফ যন্ত্রটি আজও সংরক্ষিত আছে IACS এ। প্রাথমিকভাবে তিনি সূর্যের আলোকেই উৎস এবং মানুষের চোখকে ডিটেক্টর হিসেবে ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানী কৃষ্ণাণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকার ঘরে বসে নিজের চোখকে অন্ধকারে অভ্যস্ত করেন, যাতে অতি ক্ষীণ আলোও যাতে তার চোখে ধরা দেয়। এভাবে তারা প্রায় পঞ্চাশটি তরলের উপর পরীক্ষা করে দেখেনে, সত্যিই উৎসের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছাড়াও, তরলের মধ্যে দিয়ে আসার সময় বিক্ষেপণের ফলে তৈরি হয় নতুন তরঙ্গদৈর্ঘ্য।

এটা ছিল বিজ্ঞান জগতে এক মৌলিক আবিষ্কার। তাদের এই আবিষ্কারের ঘোষণা করার দিনটা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮। এই আবিষ্কারকে সম্মান দিয়েই ভারতবর্ষে এই দিনটিকে `জাতীয় বিজ্ঞান দিবস` হিসেবে পালন করা হয়। তাদের পরীক্ষালব্ধ ফল ছাপা হলো ইন্ডিয়ান জার্নাল ফর ফিজিক্স এ ‘আ নিউ রেডিয়েশন` শীর্ষক গবেষণাপত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। মাত্র দু`বছরের মধ্যে ১৯৩০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন রামন।

১৯৩৩ সালে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর নির্দেশক হয়ে চলে যান সেখানে। ষাট বছর বয়সে গড়ে তুললেন নতুন গবেষণাকেন্দ্র `রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট`। বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন `ইন্ডিয়ান অ্যাক্যাডেমি অফ সায়ন্সেস`। আজীবন সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন, ভারতীয়ত্ব বহন করে চলেছিলেন শুধু পোশাক-আশাকে নয়, মননেও। তার লেখনীর মাধ্যমে তার প্রকাশ লক্ষিত হয়েছে।

সে দিনের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে রামন বলেন, যখন নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হল, আমি সেটাকে আমার এবং আমার সহকারীদের ব্যক্তিগত সাফল্য হিসেবেই নিয়েছিলাম। একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের স্বীকৃতি, যা আমাদের সাত বছরের গবেষণার ফল। কিন্তু যখন আমি জনাকীর্ণ সভাঘরে পশ্চিশি মানুষের মধ্যে বসেছিলাম, পাগড়ি আর গলাবন্ধ কোট পরা একমাত্র ভারতীয়, তখন আমার মনে হলো আসলে এখানে আমি আমার দেশ আর জনগণেরই প্রতিনিধি। সম্রাট গুস্তাভের কাছ থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করার সময় সত্যিই নিজেকে নগণ্য মনে হচ্ছিল। আবেগে ভাসছিলাম, কিন্তু নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম। কিন্তু যখন ঘুরে দেখলাম ব্রিটিশ পতাকার নিচে বসে আছি, বুঝতে পারলাম আমার হতভাগ্য মাতৃভূমি ভারতবর্ষের কোনো পতাকাই নেই, তখনই আমি ভেঙে পড়লাম।

১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর পরাধীন ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তিরুচিরাপল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। ৮২ বছর বয়সে ১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর বেঙ্গালুরুতে তিনি মারা যান।