পলিয়ার ওয়াহিদের গল্প ‘পিতার দাসত্ব’

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০২০

এক রাকাত নামাজ পড়েই সালাম ফিরিয়ে ফেলেছি! ভুলে। মন কোথায় ছিল আমার? জায়নামাজের ওপর আমার মেয়ে খেলা করছে! ও শুয়ে আছে। দুই হাত দশদিকে ছুঁড়ে আমাকে ডাকছে! সূর্যের আয়তনে ওর বয়স দিনসাতেক। আর চন্দ্রের দৈর্ঘ্যে ছয়। যেন এক মাস পেরিয়ে গেল! ঝড় নিয়ে বৈশাখ মাসটা ধুম করে জৈষ্ঠ্যর গরম কড়াইয়ে পা ফেলেছে! ওর পাশে ওর মা-ও শুয়ে আছে। ঘুমে অচেতন। চিরকাল সে ঘুমকাতুরে। স্বামীকাতুরেও বটে। আমি ওকে কোলে নিতে উবু হয়ে আছি। ইয়া মাবুদ! আমি তো রুকুতে আছি! কিসের ভ্রমে ধরেছে আমাকে? মেয়েটা ফেরেস্তাদের সঙ্গে খেলছে। হাসছে! মায়ের অভ্যেস এখুনি রপ্ত করে ফেলেছে! বাম হাতের শাহাদাৎ আঙুল মুখে ভেতর দিয়ে চুকচুক করে চুষছে। আবার আমার দিকে পা দুটো ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখে লজ্জায় মায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এক হাত দিয়ে মায়ের কাপড় সরিয়ে বের করেছে এনেছে ক্ষুধাতুর দুধ। তারপর মুখের ভেতর পুরে পা দুটো আরো জোরে জোরে আমার মুখের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে বাতাসে। আমি কি এতক্ষণ হাওয়ার উপর সিজদা করেছি? হায় আল্লা! এ আমার কি হলো? নামাজে আমার ভুল হচ্ছে কেন? আমি কি গাফেল হয়ে গেছি? কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে এমনটা করিনি। তোমাকে দেখার ক্ষমতা তো আমাকে দাওনি। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমাকে দেখছো। এটা মিথ্যে হতে পারে না। তুমি আমাকে দেখছো মানে, আমার মনও তুমি দেখতে পাচ্ছ? তাহলে বলো আমার কি দোষ?

দেখ, ভালো করে দেখ। আমার মনের ভেতর একটি শিশু খেলা করছে। তুমুলভাবে সে আমার মন নিয়ে খেলে যাচ্ছে। আমি তোমার পানে স্থির থাকতে পারছি না কেন? এই শিশু যেন ফেরেস্তা। তোমার প্রতিনিধি হিশেবে পৃথিবীতে এসেছে। তুমি তো আমাকেও তোমার প্রতিনিধি হিশেবে পাঠিয়েছিলে? তাহলে আমি কেন তোমাকে ভুলে যাচ্ছি? এই আমার কেমন মায়া মাবুদ? পিতার মায়া আমাকে বিষের মতো জ্বালিয়ে দিচ্ছে! আজ আমার মনে পড়ছে, আমার প্রথম দিন পৃথিবীতে আসা। সুবহে সাদিকের প্রহর। রাত প্রায় শেষ শেষ! ফাল্গুনের ফুরফুরে বাতাসে নারকেলের চিকনপাতাগুলো দুলছে। চাঁদটা ডুববে ডুববে করে ডুবছে না। মলিন জোছনায় আমাদের মাটির বাড়িটি সোনার মতো দেখাচ্ছে। আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে দুনিয়ার মুখে দেখাতে মায়ের নাকি সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছিল। তিনরাত তিনদিন মা ছটফট করেছিল! আমার আব্বা বারান্দায় বেটেপাটির জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তো। তবু আমার নানি আর দাদি আব্বার পা ধোঁয়া পানি খাইয়ে দিতো মাকে। আব্বা ডাক্তার নাকি মুনশি ডাকবে তার দিশা থাকতো না। মায়ের সাফ কথা ‘মরে যাব তবু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিও না। তোমার মুখ দেখে মরে যাবো সেও ভালো।’ আব্বা চাঁদের শেষ ময়লা আলোর ভেতর পায়চারি করছে। হঠাৎ তার মাথার উপর দিয়ে আগুনের মতো ঝলমলে আলো করে কে যেন উড়ে গেল! ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ! আমি এসেছি!

মায়ার দুনিয়া। কত বিচিত্র। কতো খেয়ালি। আমিও আব্বা এখন। প্রতিবার বাবা মায়ের জন্য ঈদে বাড়ি যাই। এবার যেন মেয়ের জন্য যাচ্ছি। ভালোবাসার এই যে ভাগ-বাটোয়ারা আমি পারি না। যতবার মেয়ের কথা ভাবছি, মায়ের মুখ ভেসে উঠছে। যতবার মায়ের কথা ভাবছি, মেয়ের মুখ ভেসে উঠছে। এমনিতেই দূরে থাকি। বছরে এক দুবার বাড়ি যাই। এবার করোনার দূরত্ব কারো মুখ দেখতে দেবে কিনা জানি না। মা আর মেয়ে হয়তো আমাকে বুঝছে। কিন্তু বউ ভুল বুঝে বসে আছে। মোবাইলে তার নাককান্না আমি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে মেয়েকে দেখার জন্য। জেলখানায় থাকলেও মনকে বুঝ দেওয়া যায়। কিন্তু মুক্ত মানুষের বন্দি মন কীভাবে সহ্য করে পাখি? শুধু মেয়ের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ঘর থেকে বের হতে পারছি না। আর যে শহরে আছি, সেখানে যদিও নিরাপত্তা ও নিরাপদ শব্দগুলোও মারা গেছে। হু হু করে কাঁদছে মন। আমি আর পারছি না দয়াল। আমাকে ক্ষমা করো। আমার কি কেবলা ভুল হয়ে যাচ্ছে?

আজ খুব মনে পড়ছে, যেদিন প্রথম শহরে আসি। কি এই নগরের মায়া! আমাকে বড় হতে হবে। লেখাপড়া শিখতে হবে। কত স্বপ্ন আমার। দেখতে দেখতে শহরের সব নিচু খানাখন্দ নতুন দালানে ভরে গেল। কিন্তু আমার লেখা পড়া যেন শেষ হচ্ছে না। বেড়ে যাচ্ছে মানুষের দামও। কিন্তু আমার মনের দাম কেউ বোঝে না। গোরুর গোস্তের চেয়ে আমার মূল্য কম! ঠিকই তো আলোর নিচে অন্ধাকার কি দূর হয়? ভয়ংকর আলোয় লুকোনো হুমোট ভয়! রোদ আমাকে পর করেছে। পর করেছে বাতাস। ভূমিদাস পিতা আমাকে নিয়ে কি হবার স্বপ্ন দেখতেন? ঠিক তিনি জানেন না। তবে এটা বুঝতে পারি তার অভাব মিটাতে হবে? পিতার অভাব মিটাতে গিয়ে আমরা শহরে এলাম অথচ হয়ে গেছি দেশ আর দায়িত্বের গোলাম! কাজের গোলাম! এখন আমাদের মুক্তি নেই। কিন্তু আমার বাবা একটা কথা বলতো। ‘জ্ঞানী হলি, বই পড়লি, কৃষকের হালের গরুর মতো খাটতে হবে না।’ তিনিও কি ভাবতেন, তার কালো ছেলেটা রোদে পুড়ে আরো কালো হয়ে যাবে? হবে হয় তো। কিংবা নয় তো। কিন্তু আব্বা তুমি তো জানলে না, দাস থেকে চাকরি। চাকরি থেকে গোলাম। আর গোলাম থেকে মুক্তি মানুষ পাবেই। সেদিন হয়তো খুব কাছেই। তাই আমাদের এইসব মহামারির পরীক্ষায় ফেল করলে চলবে না। আর মনে রেখো, গোলামী করছি বলেই তোমার ছেলেরা মুক্তির স্বপ্ন দেখে।

দুই মিনিটের জন্য নিচে নামলে গা জ্বালা করছে! স্মৃতি জাগ দেয়া ছাড়া এখন কি বা করার? প্রকৃতি তোমার যেমন দুহাত পেতে দেবে, তেমনি বুক ভরেও নিবে সে। ওহ! আমার কান্না শুনেই আব্বা আজান দিলেন। আমার কানে কানে সেই সুর যেন এখনো ঘোরে। আমি কালো হলাম বলে দাদির মন খারাপ। সে আমাকে কোলে নিলো না। বড় হয়ে দাদিকে আমি ক্ষমা করে দিছি। কিন্তু মা যে কোনো এই কথা আমাকে কেঁদে কেঁদে বলেছিল! আমি এখনো বুঝি না। না বললেও তো পারতো। এদিকে আমাকে জন্ম দেয়া রাত ক্রমে ভোর হচ্ছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে দিনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মধুর ঘরে প্রথম ছেলের খবরও সূর্যের আলোতে ছড়িয়ে পড়ল! আমার মায়ের সে কি আনন্দ! আব্বাও সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে। ছেলের বাবা হয়েছে ও। আব্বাকে নাকি আমি কয়েকবার কাঁদিয়েছি। তাছাড়া তাকে কেউ কাঁদতে দেখেছে এমন ইতিহাস নেই! আমার জন্মের পর। আর যেবার এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ গ্রেড’-এ পাস করলাম। বাচ্চার মতো কাঁদলেন। আব্বার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। নতুন লুঙ্গি কিনতে পারিনি তাতে কি? আমি বাড়ি গিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে তার হাতে একমুঠো টাকা দিবো। শিমুলতুলোয় আতর মাখিয়ে কানে গুজে দিবো। নতুন গেঞ্জিটা যেই বের করতে দেখলেই বলবে, তুমি এতো টাকা খরচ করো কেন? আমার তো অনেকগুলো গেঞ্জি। আহ! আমি কি বাড়ি যেতে পারব? মেয়ের মুখ দেখলেও মায়ের মুখ কীভাবে দেখব? ঈদের নামাজ পড়ে আমি দাদির কবরে যেতে চাই মাবুদ। পিতার মনে যে ভ্রমণ গুণগুণ করে গাইছে গান, বিষাদের মধু পান করে আমাকে করো পরিভ্রাণ!