পাপিয়া জেরীন
পাপিয়া জেরীনের কবিতাগুচ্ছ
প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২০
ফুল
এক.
প্রাচীনতম মন্দিরের সব আলো নিভে গিয়েছিল; তোমার আলিঙ্গনে শুধু জ্বলছিল রডোডেন্ড্রন চোখ।
সত্যযুগ হলে এখন দেবির অভিশাপে আমাকে হতে হতো কুৎসিত ওক্ গাছ আর তুমি... লিঙ্গচ্ছিন্ন সবুজ দানব!
দুই.
কলকাতার অর্ধেকটা বন পুড়ে ছাই
বাকি অর্ধেক জুড়ে পলিমার প্রগতি;
ট্রামে উঠে বসেছে উদ্বাস্তু বাঘ
তরুণ জিরাফ গেছে শহুরে সার্কাসে
আতপ্ত ব্লাড অর্কিড নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে
চড়ে বসেছে বাসের ভেতর—
উদ্বেল মুণ্ডুতে দুর্দান্ত পরাগ জমে আছে তার
উশখুশ করছে সিলিকন সভ্যতা
উশখুশ করছে কাগজের ফুল...
তিন.
তুমি জায়নামাজের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলে
গোলাপের মতো ফুটেছিল আরক্ত আঙুল
আনত চোখ, ঠোঁটে অজস্র আয়াত;
তুমি জানো না—
তোমার প্রার্থনার পাশে একটা বাসনাবিদ্ধ বকুল ঝরে আছে!
অগস্ত্য
আম্মুকে
এইযে অন্ধকারে অস্পষ্ট গাছেরা দীর্ঘায়িত ছায়া নিয়ে চুপ করে বসে আছে,
পথও চিহ্নহীন, তুমি রেখার মতো নিঃশব্দে বেঁকে গেলে যেদিকে—
আধভাঙা পিরিচের মতো রয়ে গেল চাঁদ;
জট লাগা হিজল নেমে আসে নিচে,
নেমে আসে ঘেমে থাকা মেঘ চিমনির গর্দানে—
কুকুরের মাস, পারিজাত ভোর
বাসন্তি পথ দিকচিহ্নহীন, তুমি রেখার মতো নিঃশব্দে বেঁকে গেলে যেদিকে—
বিচূর্ণ শঙ্খের মতো ধেয়ে গেল বক;
এই যে অহেতুক আলো... সন্ধ্যায় ঢুকে পড়ে মৃতমুখ নিয়ে, নারীর গুটানো চুলের ভিতর দু’একটি রুদ্ধশ্বাস জোনাকি—
ওদেরও পথ নেই পালাবার;
অন্ধকারে অস্পষ্ট গাছেরা দীর্ঘায়িত ছায়া নিয়ে চুপ করে বসে আছে,
পথও চিহ্নহীন, তুমি রেখার মতো নিঃশব্দে বেঁকে গেলে নীরবে
বেঁকে গেলে যেদিকে—
শিমুলের বীজ ফেটে উড়ে গেল তুলো
বিচূর্ণ শঙ্খের মতো ধেয়ে গেল বক
আধভাঙা পিরিচের মতো রয়ে গেল চাঁদ
অথচ, ফিরে এলে না...
যাঁতাকল
এই স্থানকালপাত্রের কোনো মাহাত্ম্য নাই,
হাটের মানুষের ভ্রু তুলে দ্যাখা মেঘ
কোঁচড় মুঠ করে ধরে রাখা হাত
কিংবা বগলের জট লাগা চুল
কাছিমের মতো বাঁক দেয়া পিঠ, মহিমাহীন
গতকাল গত
এখন আছে কেবল চাকায় পিষ্ট হওয়া ফল
আর কিছু মাছি প্রৌঢ়ার বুকে
পর্দা উড়ায়ে দিয়েছে ভটভটি মেঘ, চুল, পাতলুন—
উৎসুক চোখ নাই
আজকে এই দিনে—
সিদ্ধিরগঞ্জে
সারি সারি মানুষ বেচে দিচ্ছে, কিনে নিচ্ছে
যাবতীয় যা
দেখছি হাত, কোঁচড়, পিঠ
তারা বসে, দাঁড়ায়ে, ছুটে যাচ্ছে মাহাত্ম্যহীন
উপরে হন্তারক মেঘ
দৃশ্যত কোথাও কারো কোনো যৌনাঙ্গ নাই।
প্রোষিত
শীতলক্ষ্যার পর নীল বন্দর; সেখানে ঊরু তুলে রাখা সান্দ্র শরীরে বেপরোয়া ঢুকে পড়ি। শরীর থাকে কিছু ঢুকে পড়ার— ঘর নয়, ঘোরের মতো।
ঘোরের মধ্যে মা চলে আসে, মা কাঁদছে—
মা মরে যাচ্ছে প্রতিদিন ঘরে।
ঘর নেই, ঘরে ফিরি তবু। শিশুমুখ, তোমাদের ক্লিষ্ট চোখ দেখি। তুমি চুল খুলে বসে আছ— ঘোর-ঘরহীন উচ্চণ্ড শরীরে। পাশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে থাকি।
মনে পড়ে, বন্দরে ঊরু তুলে আছে কত সান্দ্র শরীরে— ঘরহীন ঘোর।
ফোনসেক্স ৫
এই যে, ঠিক শরীরের এইখানে
হা-করা আছে একটা লাল ডাকবাকসো;
এইখানে ফ্যালো খাম
আর যা কিছু বয়ে এনেছ... সব
দ্রুতগামী লেজ
শুক্র শব্দকীট!
ক্ষয়
আমাদের কেন দেখা হলো?
কী হতো যদি না হতো কোনোদিন!
আমাদের আর কোনো আশা নেই
চলে যাচ্ছি অনিচ্ছায়
টেনে নিচ্ছ
যেখানে গন্তব্য ছিল না
অসাড় একটা হাত কিংবা পায়ের মতো টেনে তুলছি হৃদয়
স্তব্ধ
স্থবির
পড়ে আছে নিচে
এই অন্ধকারে
হাঁটি
ছেঁচড়ে
শরীরের বাইরে কখনো কাঁধে, কখনো পিঠে
তুলে নিই হৃদয়
স্তব্ধ
স্থবির
পড়ে থাকি নিচে
আমাদের কিছুই হবার নেই
উত্থান-বিকাশ কিংবা পতন
অবশেষ নেই—
বাধা বা পূর্বতর টান
এই অন্ধকারে
তবুও টেনে নিচ্ছ
যেখানে গন্তব্য ছিল না
...কেন দেখা হলো আমাদের?
কী হতো যদি না হতো কোনোদিন!
এই জ্বর ঘোরলাগা রাতে
এই জ্বর ঘোরলাগা রাতে
তোমার শরীরে গজাই
কয়েকশো একর কাগজিলেবু বন,
দুধে ভেজা রুটির মতো
শুষে নিতে থাকি অধরান্ত জিভ
আঙুল ডুবায়ে রাখি অতলান্ত গহ্বরে
অপাঙ্গ-জল, জলের আঘাত
রোমে রোমে মন্থিত শ্বেত পারিজাত!
ফের অতিক্রান্ত কালোয়
আবেস্তার পাতায় পাতায় খুঁজি—
শিফা-ই-গুল;
এই জ্বর ঘোরলাগা রাতে
কেন আহরিমান খুলে রাখে বুক
আমি সত্য-শিব ভুলে খুলে দিই গোপন দেরাজ
এই ঘোরলাগা রাতে কুয়াশার হোমকুণ্ড ভাঙে
নামে ধুন্ধুকার পীড়ন,
জন্মান্ধ চোখ নিয়ে দেখি—
আঁধারে ঝরে আছে পারস্য গোলাপ!
























