পাপিয়া জেরীনের গপ্পোসপ্পো

পর্ব ১

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৯

আম্মু-আব্বুর সেপারেশনের পর আমার আর কোথাও যাওয়া হইতো না। পার্মানেন্টলি নানাবাড়িতে রইয়া গেলাম। দোতালার মাঝখানের রুমে একটা পালঙ্ক আর একটা খাট ছিল। খাটে আমি, আম্মু, আর ছোটখালা শুইতাম। পালঙ্কে নানুমণি আর নানাভাই। পুরানা আমলের রাজবাড়ির আদলে এই বিল্ডিং। বিশাল বিশাল দুইটা ভেন্টিলেটরে স্টেইনগ্লাস। সূর্যের আলো পড়তেই মেঝেতে লালনীল জিউমেট্রিক আলপনা ছড়ায়া যাইতো। আমি আর মো সূর্যের বিপরীতে দাঁড়ায়া শরীরে লাল নীল নকশা নিতাম। বারান্দায় কাঠের কার্নিশ থিকা প্রতিদিনই টুপটাপ চড়ুইয়ের বাচ্চা পড়ত। ডাইনিং টেবিলের উপর জলচকি ফিট কইরা তার উপর পিঁড়ি বসায়া একজন ধইরা রাখতাম— আরেকজন উইঠা বাসায় বাচ্চা উঠায়ে দিতাম।

মা আর বাচ্চাদের আমরা খাইতাম না। বাচ্চাগুলি একটু উড়তে শিখলে আমরা পুরুষ চড়ুই ধরতাম। পুরুষ চড়ুইয়ের মাথা পিঠ কালো, শরীরে মাংস বেশি। ২০-২৫টা চড়ুইয়ের মাথা কাইটা চামড়া ছুললে মিনি-মুরগির মতো হয়া যায়। এই চড়ুই ভাইজা বিরানি রান্না হইতো। এক্সট্রা কড়কড়া ভাজা চড়ুই অনেকটা পিঁয়াজুর মতো। এই চড়ুই নিধনে ওই বিশাল পাল কমতে দেখি নাই।

নানু-বাসায় কেবল চড়ুইয়ের না, হাঁস-মুরগির পাল দেখতাম। শীতের শেষদিকে বিশাল টেবিল, খাঠ আর ওই পালঙ্কের নিচে ডিম বসানো হইতো। আমরা অপেক্ষা করতাম কখন বাচ্চা ফুটবো। রাতের বেলা চিউ চিউ শব্দ শুইনা খাটের তলায় ঢুকতাম, আলগোছে মুরগি তুইলা দেখতাম বাচ্চা ফুটে নাই। খুবই অবাক হইতাম, বাচ্চাগুলি ডিমের ভিতর থিকা ডাকতেছে! একদিন প্রায় সবগুলি বাচ্চা নিয়া মুরগিটা নামতো। আর সারা বাড়িতে ছড়ায়া যাইতো উমাইল্লা পোক। এই উমাইল্লা পোকের জ্বালায় আমরা সবাই পাগল হইতে বাকি। সবচাইতে সমস্যা হইতো, বাসায় পড়াইতে আসা হুজুরের। উনার পায়ের কাছে টেবিলের নিচে ডিম বসানো। হুজুর খালি উহ্ উহ্ করতো আর আমাগো বেত মারতো। তার বেতের বাড়িতে আমরা শরীরে উমাইল্লা পোকের কামড় ভুইলা যাইতাম।

মুরগি শরীর ঝাড়া দিয়া বাচ্চাসমেত উঠানে গেলে আমরা খোঁজ করতাম সবচাইতে শেষে পাড়া ডিম ফুটছে কি ফুটে নাই। সেইটারে ফুটানের দায়িত্ব নিতাম আমরা, একটা কাঁচের বাক্সে তুলা নিয়া লাইট জ্বালায়া সেইটারে ফুটাইতাম। দুইদিন পর মা-মুরগিরে ওই বাচ্চাটা দিতে গেলেই মাটা ঠোক্কর দিয়া বাচ্চারে সরায়ে দিতো। শেষে বাচ্চাটারে আমরাই কোলে পিঠে কইরা মানুষ (মুরগি) করতাম।

একটা সময় মো`রা চইলা গেল গ্রীনরোড পাকাপাকি। আমরাও নানুবাসায় নিচে একটা নতুন রুম, মানে এক্সটেনশনে আইসা উঠলাম। আম্মু নতুন উদ্যমে আলাদা কইরা মুরগি পালা শুরু করল। আম্মুর মোরগগুলি ছিল গাউচ্ছা টাইপ। এরা গাছের পোকঝোক, ফলফ্রুট খাইতো। চলাফেরাও করতো উড়াল দিয়া এক গাছ থেকে আরেক গাছে। একটাা ঘটনা খুব অদ্ভুত ঘটছিল তখন। এক বাচ্চাওয়ালা মা-মুরগি বাচ্চা বাঁচাইতে বেজির সাথে ফাইট দিয়া মরল, তখন ৯টা শিশুবাচ্চা এতিম। এই এতিম বাচ্চাগুলিরে পাখার নিচে ওম দিতে শুরু করল একটা রাতা মোরগ। চোখের সামনে মোরগটা মুরগির আচরণ শুরু করল, ওর লেজের পাখনা পইড়া ছোট হইয়া গেল— লালঝুঁটি নুইয়া পড়ল। আমি কাণ্ডকারখানা দেখতাম। বাচ্চাগুলি বড় হওয়ার পর ওই মা-মোরগটারে সব মোরগ- মুরগি মিল্লা মারতো। কেউ দলে নিতো না। ও ঘুমাইতো ঘরে, স্টিলের আলমারির উপর।

একদিন আম্মু হাঁসের ডিম দিয়া মুরগি বসাইলো। সেই বাচ্চা একসময় ফুটলো, কী যে সুন্দর! হলুদ-কালো ছোপ ছোপ। আমি পুকুর থিকা ছোটছোট পানা আইনা পানির বোলে ছাড়লাম, সেইখানে হাঁসের বাচ্চারে ভাসাইলাম। এই দৃশ্য দেইখা হাঁসেদের মুরগি-মা মাথা ঘুইরা পইড়া গেল। আম্মু সেই মুরগির মাথায় পানি দিয়া, কুলা দিয়া বাতাস দিতে লাগলো। এরপর ওদের জন্য উঠান লেবেলে একটা হাউজ বানায় দেওয়া হইল। বাড়তে বাড়তে হাঁসের সংখ্যা দাঁড়াইলো পঞ্চাশে। আম্মু প্রতিটা ডিমে তারিখ লিখা রাখতো সিগনেচার পেন দিয়া। এইটা যারা দেখতো হাইসা মইরা যাইতো। কিন্তু আম্মু এদের পাত্তা দিতো না, কারণ আগের ডিম আগে খাওয়াটা ভালো, এইটাই তার যুক্তি।

সবশেষে আম্মু যখন বাড়ি করল, তখন তার এই হাঁস-মুরগি পালন বন্ধ হয় হয় অবস্থা। হাঁস খাইয়া, দিয়া শেষ করা হইল। বিশটা মুরগিরে ছাদে খোপ বানায়া দেয়া হইল। এই মোরগ-মুরগি সারাদিন উঠানে-বাগানে ঘুইরা মাগরিবের ওয়াক্তে কলাপ্সেবল গেইটের ফাঁক দিয়া ঢুইকা সিঁড়ি বাইয়া তিনতালার ছাদে উইঠা আসতো। সবগুলি মুরগি টুকটুক কইরা লাফায়া ছাদে উঠতেছে— দেখার মতো দৃশ্য ছিল। ২০টা মুরগির মধ্যে একটা মুরগির নাম ছিল, নানুমনি (সবগুলা মুরগিরই নাম ছিল), সেইটা ছিল সাদায় কালো ফোটফোট আর স্বাস্থ্যবতী। সে গেইটের ফাঁক দিয়া ঢুকতে পারতো না। সে গেইটে দাঁড়ায়া ডাকতো, কক্ কক্ কক্ কক্। তখন আমরা গিয়া গেইট খুলতাম। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আস্তে আস্তে উঠান, বাগান, জঙ্গল, পুকুর ভরাট হইয়া গেল। এক ইঞ্চি মাটি নাই। মুরগির জন্য খোলা জায়গা কই? আমরা এখন আর মুরগি-হাঁস পালতে পারি না। কিন্তু, আম্মু প্রায়ই ঘুমের মধ্যে চিৎকার কইরা ওঠে, আয় আয় আয়! আয় চৈ চৈ চৈ। আমরা এই ঘর থিকা শুনতে পাই। মনে মনে ভাবি, আম্মু সকালে উইঠাই বলব, পুপ্পুরে, রাত্রে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, হাঁসের পালটা দুইলা দুইলা উঠানে আসছে, আমি কুড়া মাইখা দিতেছি। মুরগিগুলি পালে পালে বাচ্চা ফুটাইছে আর আমি আটা গোলায়ে ছোঠ ছোট সেমাই কুইটা দিতেছি হাতের তালুতে।

আমি আম্মুরে তাকায়ে দেখি, আম্মু বলতে বলতে আঙুল দিয়া তালুতে ঘষতেছে— সেমাই ভাঙার মতো। তার চোখে দীঘি, দীঘিতে এক পাল হাঁস— চোখের পানি ঘোলা করতেছে।

লেখক: কবি ও চিত্রশিল্পী