অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

পাপিয়া জেরীনের গল্প ‘কলমিলতা’

প্রকাশিত : মে ২৩, ২০১৯

দয়াময়ী মোড়েই আছিলো ওই গলি। সুরুজ মিয়া প্রায় দশবছর আগে আইছিলো এইখানে, কিন্তু সব কেমন পাল্টায়ে গেছে। এই সেই বুড়িমার মিষ্টির দোকান। গায়ের চাদ্দরটা ভালো কইরা প্যাঁচ মারে সুরুজ, দোকানে গিয়া স্পেশাল দইয়ের অর্ডার দেয়। এইখানে আরো পনের মিনিট দেরি কইরা সেই গলিতে ঢুকবো সে। অনেকদিন পর এমন একটা জায়গায় যাইতে একটু বুক ধড়ফড় করাডাই তো স্বাভাবিক। তাছাড়াও মনের মইধ্যে একটা খচখচ, বাপজানের চাঁদর পইরা পাড়ায় যাওয়া ঠিক হইতেছে কিনা, আবার কোমরের বেল্টটাও তার। সুরুজের বাপ মরছে একবছর। বাপজান কোনোদিনই সুরুজের এই বাউলা স্বভাব ভালো চোখে দেখে নাই। গাতক-কবি ছিল তার দুই চোখের বিষ। তবু বাপ বাপই, সুরুজ জানে সেইটা।

গলির কাছে যাইতেই গলা শুকায়া যায় সুরুজের। পাড়ার মাইয়াগো সাজ দেখলেই কেমন জানি লাগে অর। সব কিছু স্বাভাবিক মনে হইলেও ওগোর চোখের কাজলের ঢেউ দেখলেই মেজাজটা বিগড়াইয়া যায়। এগোর আচার আচরণও তিরিক্ষি, হাত ধইরা টাইনা নিয়া যাইবো— বিশ্রী কিছু শরীরের ভঙ্গি করবো আর গালাগালি তো আছেই। এই সব মেয়েছেলের দিকে সুরুজের কোনো আগ্রহ নাই। এগোরে দেখলে মনে হয় যন্ত্রের পুতুল, যন্ত্রে টেকা ঢুকাইলে যন্ত্র হাসে-খেলে— যেই টেকার টাইম শেষ, ওমনেই আবার পুতুল। টেকা দিলে জান আহে আবার টেকার মেয়াদ শেষ তো জান নাই।

`এই যে নাগর, আমার লগে আসো` আশ্চর্য এক মাইয়া, বয়স কতো হইবো, পনের কী ষোল্লো। সুরুজ মিয়ার হাত কইষা ধইরা টাইনা নিয়া যাইতেছে। একঢাল চুল মাথায়, শইলের চাইতে চুলের ওজন বেশি।

বসো এইখানে। জীবনে পরথম আইলা?
না। কেন? আইচ্ছা তোর বয়স কত হইবো?
তুই কইরা কও ক্যা? বয়স আঠারই হইছে। ক্যা সমস্যা কি? তুমি কি কামে আইছো নাকি...! ও বুজছি, গাঞ্জা কিনতে আইছো। শোনো ঘরে যখন ঢুকছো, ভাড়া দিতে হইবই, আর মদ-গাঞ্জার লাইগা এক্সট্রা চার্জ।
বাপরে! এই বয়সে কথা তো ভালোই শিখছছ্... এক্সট্রা চার্জ। হাহাহা।
বাত্তি প্যাঁচাল কম। কামের কথা কও।
কামের কথা হইলো, তুই যখন হাত ধইরা টাইনা আনতেছিলি, তহন গলার একটা সুর ভাজতেছিলি। ওইটা কুন গান?
ধুর! ওই গান শুইনা কী করবা। দুইশো টাকা বেশি দিলে শীলা কি জওয়ানীর লগে ডেন্স দেখামু। কী কও!
না, তর ওই গানটা শুনা।
শুনো মিয়া, এই গান আমার নিজের। সুরও নিজের। এইসব গান শুনাইতে আধা ঘণ্টায় আমি এক হাজার ট্যাকা নেই। আগে টেকা ফালাও।

সুরুজ মিয়া চোখ বন্ধ কইরা গান শুনতেছে, একটু ভাঙা ভাঙা মিষ্টি গলা—
রঙ্গিলা নাগর, কেন দূরে দূরে রও
পিরীত জাগায়া কেন দূরে দূরে রও
দূরে রাখিলে বন্দু চান্দ হয়্যা যামু
নিশি রাইতে মুখ দেখাইয়া তোমারে কান্দামু...

ধুর ছেড়ি, এইডা কী গাইলি! তর্ লেখা এইডা?
হ, আমার লেখা। ক্যান ভালো হয় নাই? নেও এইডা শুনো...

আমার সোনার কলসী ভাসে
রূপালী ঢেউয়ে, তোমার রূপার নদে
আমি কেমনে পরাণ রাখি গো—
কেমনে পরাণ রাখি,
কলমিলতার মতো আমি জল ছুঁইয়া থাকি
উজান গাঙের দিকে গো চাইয়া পরাণ পাখি!

সুরুজ মিয়ার চোখ দিয়া দরদরাইয়া পানি নামতেছে। ক্যামনে গাইতে পারে এইটুকুন মাইয়া, এত সুন্দর! গানের ঝোক উইঠা গেছে মাইয়ার, একের পর এক গান চলতেছে। জানালা দিয়া উঁকি মারতেছে কেউ কেউ—

যে অসুখ, অসুখরে বাউলা
চান্দ দেখিলে বাড়ে রে— চান্দ দেখিলে বাড়ে
সে অসুখ, অসুখ রে বাউলা
ধরছে গো আমারে...

তিনহাজার টেকা হাতে দিয়া সুরুজ ঘর থেইকা বাইর হইয়া আসে। সে পাড়ায় আসছিলো পুষ্প নামের একটা মাইয়ারে খুঁজতে। প্রায় দশ বছর আগে আইসা এখানে পুষ্পর লগে দেখা। তখন পরপর তিনদিন ওই মাইয়ার চালে আইসা সুরুজ দেওয়ানা হইয়া গেছিলো— কথা দিছিলো, জামালপুর যদি আর কোনোদিন আসে তাইলে পুষ্পের লগে অবশ্যই দেখা করবো। ওরে খুঁজতে আইসা কলমির লগে দেখা আইজ। কলমিরে জিগাইতেই মুচকি হাইসা কয়, এই পাড়ার অর্ধেক মাইয়ার নামই পুষ্প আর বাকি মাইয়াগো নাম ফুলের নামে— জবা, শিউলী, পদ্ম, কামিনী, কলি, কেয়া।

সুরুজ দশ বছর আগে যে ভুল করছে, এইবার তা করবো না। একলাখ টেকা লাগলেও এই মাইয়ারে তার চাই। বিসিকে সে এক গাতক দল নিয়া আসছে, সেইখানে পাইবো তিরিশ হাজার। লগেও টেকা আছে, আর বন্ধু শামছু তো আছেই। ফাল্গুনের আউলা বাতাসে সুরুজের গায়ের চাদ্দর ফড়ফড় কইরা উড়তাছে, চোখ লাল। হলুদ চান্দের আলোতে তারে দেখা যাইতেছে ঘরছাড়া সন্ন্যাসীগো মতন।

বন্ধু! কনু গ্যাছিল্যা? দয়াময়ী মোড়ো?
শামছু জরুরি কথা। এই নে পঞ্চাশ হাজার। তুই বাকিটা ভইরা পাড়ায় গিয়া কলমি নামে মাইয়ার লগে দেখা করবি। সর্দারনী রুনু খালার লগে কথা ফাইনাল। তুই জামাল আর দীদাররে নিয়া গিয়া মাইয়াটারে নিয়া আইবি।
এল্ল্যা! তুই পাগলা হইছস্?
বেশি কথা কইলে বন্ধু হারাবি তুই। তুই যাবি কী না ক। তোর মতো নেতা বন্ধু কবে কামে দিবো বেডা! আইচ্ছা গেলাম আমি।
তুই টেহা দে ছ্যা। বয় তুই। তুই যেমনে কবি ন্যা... তেমনেই হইবো, বুজলি?

বিকালে পদ্মায় কইরা সুরুজ মিয়া ঢাকায় রওনা দিছে। গাতক দল রওনা দিবো কাইলকা। কলমির মন বেজার। এই ট্রেনে ট্রেনে বাপের লগে ঘুরতো আর গান গাইয়া ভিক্ষা করতো সে। গফরগাঁও বাড়ি ওগো। তহন বয়স কত হইবো, ছয় মনে হয়। ইস্টিশনে বাপের কাছে শুয়া আছিলো, হেরপর ঘুম থেইকা উইঠা দেহে একটা আজব পরিবেশ। পাড়ার জীবনের কথা ভুইলা যাইতে চায় সে। কিন্তু পাশের চালের বিথীর কথা শুইনা ওর কান্দন আইতাছে, বিথীর কথা হইলো, সুরুজ মিয়া মাইয়াগো দালাল, ঢাকায় গিয়া নাকি তারে বেইচা দিবো।

আইচ্ছা শুনেন! আমি এমনে ক্যান যামু আপনের লগে? আমারে আপনের বাড়িতে নিবেন কইলাম। অন্য কুথাও যামুনা আমি।
আরে ব্বাপ! আপনে কইরা কইতাছোস ক্যান? হ বাড়িতেই নিমু তরে। ডরাস কেন? বিশ্বাস পাছ্ না!
আপনে যে বাসায় নিবেন... কী পরিচয়ে? ট্রেন থিকা নাইমা আগে বিয়া করবেন আমারে।
ওই ছেড়ি, তর বিয়ার বয়স হইছে? আর জানস আমার বয়স কত? একচল্লিশ!
আমার আঠারো হইছেই। একচল্লিশ হউক আর সত্তুরই হোউক। আপনেই সই।
একদম প্যাঁচাল পারবি না। আর কান্দোস ক্যা তুই? মাইনশে তো শেষে আমারে গণপিডানী দিবো।
আগে কন বিয়া করবেন। নাইলে এহনই ট্রেন থেইকা ঝাঁপ দিয়া পড়ুম।
করুম করুম। তরেই বিয়া করুম। যাহ্। এইবার একটা গান শুনা, শুনা দেখি।

কলমি চোখ মুইছা গান ধরে। মিহিন বাতাসে ওর কালা চুল আইসা মুখের উপর পড়ে। গান গাইতে গাইতে মনে হয়, তার ছয় বছর বয়স। অন্ধ বাপের হাত ধইরা এই কামরা থেইকা ওই কামরা ঘুরতাছে—

আমার বন্ধু গুণধর
আর কতদিন থাকবা তুমি পর
জলের উপর তোমার লগে বান্ধুম আমি ঘর
আকাশের উপর...

কলমির লগে সুরুজের বিয়ার কাজ শেষ। কলমি লাল শাড়ি পইরা শুইয়া, চুল ঝুইলা গিয়া পড়ছে মাইঝালে। কেরিকাটা চুলের ভিতর লাল জবা ফুল। সুরুজ আধশোয়া হইয়া কলমির চুলের সুবাস লয়, আবার বিলি কাটে। সুরুজ কলমিরে বুকে টাইনা নিয়া দরাজ গলায় গাইয়া ওঠে। কলমি হা কইরা গান শুনে। এত সুন্দর! এত সুন্দর কইরা কেমনে গায় এই মানুষ!

ভাইসা যাইতেছ কই কচুরিফুল মিহিন ঢেউয়ে
বাতাসেরা প্রেম জানে না সই
জল তোমারে বুঝে—
তারও একটা প্রেমিক ছিল তোমার মতোই
বাতাসেরা প্রেম জানেনা সই!