পুপি আসিবার পূর্বেই এনআই খান মরিয়া গেল

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০২০

এনআই খান স্যার সকাল সাতটায় আসতেন আমাদের বাসায়, আর আমি তখনো ঘুমে। তন্দ্রার মধ্যে শুনতাম চিকন গলায় ডাকতেছেন উনি, পুপি... পু... পি, ও পু...পি। করিডোরে আইসা আমার মামিদের (আম্মুরে না পাইলে) কাউরে বলতেন, ও বউ একটু সইর্ষার ত্যাল দে, বাটিতে দে। তারপর উনি আমারে এক ঝটকায় ড্যানা ধইরা টান দিতেন। আমি ব্যথায় কানতাম, আর উনি আমার মাথার তালুতে সেই ত্যাল মালিশ করতেন, ত্যালপানি দেস না তুই? ওই পুপি!

পুরা নাম নুরুল ইসলাম খান, মুন্সীগঞ্জ বয়েজ হাইস্কুলের টিচার। সাদা পায়জামা, হাঁটুর একটু উপর পর্যন্ত সাদা টেট্রনের পাঞ্জাবি, তাতে একটা বুকপকেট। শীত-গ্রীষ্ম-শরৎ সবসময় তার হাতে কাঠের ডাণ্ডিঅলা ছাতা। সকাল সাতটা থেকে নয়টা উনার কাছে পড়তাম, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্রাশ করতাম, বাথরুমে যাইতাম। সকালের নাস্তা করতাম উনার সাথেই, দুইটা আটার রুটি, আগুনগরম ডিমসিদ্ধ আর ভাজি। শীতের সময় উনি আমারে ঘুমের মধ্যে পায়ের তলায় মালিশ করতেন, কানি আঙুল দিয়া কানের ফুটায় তেল দিতেন। পড়ার টেবিলে বসার আগে ঘুম ভাঙাইতে এই অদ্ভুত সেশনের মধ্যে দিয়া আমারে যাইতে হইত। তখন খুব কান্না পাইত আমার, অথচ এখন মনে হয়, এত সুন্দর সকাল আর জীবনেও আসবে না।

উনি আমারে ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত বাংলা ব্যাকরণ আর ইংরেজি পড়াইছেন। সেই ব্যাকরণের সাথে পাঠ্যবইয়ের যোগাযোগ ছিল না। ক্লাশের পড়ার সাথে উনার পড়ার কোনোই মিল ছিল না। ক্লাশ এইটে গিয়া বুঝতে পারলাম যে, এই সেই উপমান আর উপমিত কর্মধারয়। উনি আমারে ক্লাশ টেনের গ্রামার ক্লাস ফোরে পড়াইতেন। এনআই খান স্যার ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমার সাথে সেইম রুটিন মেইনটেইন করছেন। উনি তখন আমারে আর পড়াইতেন না। সকাল সাতটায় আসতেন, তিনবার তিন সুরে ডাকতে ডাকতে করিডোর দিয়া ঢুকতেন, পুপি, পু... পি, ও পু... পি। উঠস না, ওই চুল্লা বুড়ি, তুই বড় হইছস, তরে তো টাইনা তুলতে পারি না।

আমি মহা বিরক্ত হইতাম, বাধ্য হইয়া উঠতাম, মাথায় তেল-পানি দিবে এই ভয়ে আগেই দৌড় দিয়া ব্রাশ করতে যাইতাম। উনার সামনে বসে বসে স্কুলের পড়াগুলি শেষ করতাম, উনি ডিকশনারিতে ডুব দিয়া থাকতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম মানুষটারে, কী আছে এই ডিকশনারিতে! চোখের পাতা ঝুইকা আছে, সাদাসাদা পাপড়ি, চুলগুলিও সাদা, কপালে শতবর্ষী ভাঁজ। হঠাৎ উত্তেজিত হয়া বলতেছেন, eel মানে জানস্? ডাবল ই এল! বাইম মাছ!

উনি আমার বিরক্তি ধরতে পারতেন। বলতেন, বড় হইছস তো, আমার আর যোগ্যতা নাই পড়ানোর তোরে। উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন, তারপর আবার ডুব দিতেন ডিকশনারিতে। আম্মু নাস্তা পাঠানোর সাথে সাথেই উনি নড়াচড়া দিয়া উঠতেন। গরম ডিমটা গালে নিয়া বইসা থাকতেন, চাবান দিতেন না, মুখ সরু করে একটা সুরুৎ সুরুৎ আওয়াজ করতেন। এই দৃশ্যে আমি আরো বিরক্ত হইতাম। একসময় উনার আসা বন্ধ হইল, আর আমার আরামের ঘুম শুরু হইল। উনারে ভুলে গেছিলাম প্রায়।

তার বহুদিন পর খবর পাইলাম, স্যার মারা যাইতেছেন। আম্মু আর বাসার অন্যরা সবাই দেখে আসছে উনারে। শুনলাম উনি আমারে দেখতে চান একবার। আমি যাব, এর আগেই উনি মারা গেলেন। আমার বারবার মনে হইল তখন, পুপি আসিবার পূর্বেই এনআই খান মরিয়া গেল, পুপি আসিবার পূর্বেই এনআই খান মরিয়া গেল। The patient had died before the doctor came! এইটারে সে নানান ভাবে পড়াইতে গিয়া খাতায় লেখতেন... পুপি আসিবার পূর্বেই এনআই খান মরিয়া গেল।..মরিয়া গেল! আমি কানতে পারলাম না, টানা একমাস ঘুমাইতে পারলাম না রাত্রে। খালি একটা লাইন মাথায় ঘুরপাক খাইত... পুপি আসিবার পূর্বে...

জানি, গভীর ঘুমে মানুষের মাঝেমধ্যে দেশকাল হারায়ে যায়। এখনো আমি মাঝে মাঝে হুড়মুড় কইরা ঘুম থেকে উইঠা বসি, কিছুক্ষণ বুঝতে পারি না কই আছি!... মনে হয়, আমারে স্যার ডাকতেছে, পুপি, পু...পি, ও.. পুপি। ঘড়ির দিকে তাকায়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। দেখি, পাশে আমার শিশু দুইটা বেভোর ঘুমে, সাথে এদের বাবা।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী