খন্দকার সোহেল

খন্দকার সোহেল

প্রকাশকের ডায়েরি

পর্ব ২

খন্দকার সোহেল

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২০

লেখকের নাম নয়, বইয়ের বিষয় খোঁজার চেষ্টা করেছি আর খুঁজেছি তারুণ্য

সবাই যা করে, আমিও তা করবো কেন? পথ চলতে চলতে জেনেছি, সময়ের দাবি নতুন কিছু। তাই নতুন কিছু করার তাড়না আমাকে ভাবিয়েছে সেই শুরু থেকে। সমসাময়িক প্রকাশকরা যখন সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ, হাসান আজিজুল হক, বেলাল চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ অন্যান্য ব্র্যান্ড লেখকদের দুয়ারে দুয়ারে কড়া নেড়ে ক্লান্ত, আমি তখন ভাবতাম নতুন ব্র্যান্ড কীভাবে তৈরি করা সম্ভব? বন্ধুদের অনেকের খোঁজ-খবর রেখেছি। বন্ধুরা অনেকেই ব্র্যান্ড লেখকদের বই প্রকাশের অনুমতি পেয়ে ঝাঁ চকচকে মুখ নিয়ে যখন প্রেসমুখী, আমি তখনও অন্যকিছু নিয়েই ভেবেছি। তবে খোঁজ-খবরটা রেখেছি। কী প্রকাশে ব্যস্ত তারা? উত্তরে যা পেয়েছি ব্র্যান্ড লেখকদের প্রকাশিত পুরনো কোনো বই নতুন করে প্রকাশের অনুমতি পেয়েই তাদের আনন্দের সীমা নেই! ভালো লাগেনি এই পলিসি। পরে জেনেছি, এমন ঘটনাও ঘটেছে একই লেখকের একই বই ছেপে বসে আছে পাঁচ-ছয়জন প্রকাশক! হেসেছি। কিন্তু ওই পথে পা বাড়াইনি। অথচ বন্ধু প্রকাশকরা তখনও সেই পথে ব্যস্ত। কারণ কী? অনুসন্ধান করলাম। উত্তরও পেয়ে গেলাম।

কিছু ঘটনা বলি। ২০১২ সাল। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মহাশয় আমার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। কারণ বেশি কিছুই নয়। আমি নাকি বাংলা একাডেমির সমালোচনা বেশি করি। বইমেলার ক’দিন আগে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার বইমেলাবিষয়ক একটি গোলটেবিল আলোচনায় মহাপরিচালক মহোদয় এই ক্ষোভ বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারেননি। অগ্রজ প্রকাশক ওসমান গনির একটি মন্তব্যের উত্তরে বলেই ফেললেন দাঁত চেপে চেপে কথা সেই শক্তিধর মহাপরিচালক, `ওসমান গনি সাহেব এক কাজ করেন। আপনারা যখন বাংলা একাডেমিতে কোনো নতুন কোনো মহাপরিচালকই চাচ্ছেন ভাষাচিত্রের তরুণ প্রকাশক খন্দকার মনিরুল ইসলামকেই বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন।`

তখন ভেবেছিলাম মজা করছেন। কিন্তু ক’দিন বাদেই টের পেলাম মজা কত প্রকার ও কী কী? ২০১১ সালে দুই ইউনিট নিয়ে বইমেলায় স্টল থাকলেও ২০১২ সালে স্টল কেটে এক ইউনিট বানিয়ে দেয়া হয়। একে ধরি, ওকে ধরি, এর কাছে যাই ওর কাছে যাই, কাজ আর হয় না। অগ্রজ প্রকাশকদের একটি বড়ে প্রতিনিধি দল পর্যন্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে বৈঠক করেছেন। তাও কাজ হয়নি। পরামর্শের জন্য ফোন দিয়েছিলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী ভাইকে। তিনিই একটি উপায় বাতলে দিলেন তখন। বললেন, তুমি রামেন্দু দা`কে ধরো। দাদা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন হয়তো। তৎক্ষণাৎ ফোন দিলাম থিয়েটার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতার সূত্রে পরিচিত রামেন্দু মজুমদারকে। বিস্তারিত বললাম। তিনি আমাকে আমার প্রকাশিত ভালো ২০টি বই নিয়ে যেতে বললেন বাংলা একাডেমিতে। এই দিনটি ভোলার নয়। কারণ পরেরদিনই ওনার ফ্লাইট, বিদেশে চলে যাবেন! ফোনটা একদিন পরে দিলেই হয়তো ঘটনা অন্যরকম হতে পারতো।

সেই সময়গুলোতে বাংলা একাডেমি চত্বরে অন্য প্রকাশকরা যখন স্টল বানাতে ব্যস্ত, হাতুরি-পেরেকের শব্দগুলো তখন মনে হতো আমার শরীরেই বিদ্ধ হচ্ছে ক্রমাগত। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইতো মাঝে-মধ্যে। মেলার জন্য বাছাইকৃত নতুন পাণ্ডুলিপিগুলো তখন বই হতে উদগ্রীব। লেখকরা অস্থির। অথচ আমি তখন বাংলা একাডেমিতে কড়া নাড়ছি এই দরজা, ওই দরজায়। অন্যান্য প্রকাশকদের স্টল নাম্বারে ফেসবুক সয়লাব। কিন্তু আমাদের স্টল নাম্বার পাইনি তখনও। কেউ কেউ বলতে চায়, ভাষাচিত্র কি তবে এবার মেলায় স্টল পাবে না? বুঝতে পারি, কোনো কোনো লেখক অন্য প্রকাশনীতে উঁকিঝুঁকি মারতে প্রস্তুত! শেষ পর্যন্ত যদি স্টল না মেলে!

রামেন্দু দা একাডেমিতে এলেন। মহাপরিচালকের রুম থেকে আমাকে ফোন করলেন, কোথায় তুমি? আসো।
আমি তখন আমার কিছু বই নিয়ে মহাপরিচালকের রুমে। বইগুলো টেবিলে রাখতে রামেন্দু দা একটা একটা করে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। এই ফাঁকে শক্তিমান মহাপরিচালক তখন আমাকে জেরা করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রশ্ন করছেন একটার পর একটা, তুমি বড়ো কোন কোন লেখকের বই করেছ?

আমতা আমতা করে দুয়েকজনের নাম বললাম। কিন্তু কোনো নামই পছন্দ হয়নি। পরে সরাসরি জানতে চাইলেন, তুমি হাসান আজিজুল হকের বই করেছ?
না।
নির্মলেন্দু গুণের বই করেছ?
না।
সৈয়দ শামসুল হক?
না।
সেলিনা হোসেন?
না।
বেলাল চৌধুরী?
না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী?
না।

এরপর মহাকর্তা খুবই ক্ষেপে গেলেন। রেগে বললেন, কীসের প্রকাশক তুমি? কাদের বই ছাপো? উত্তরে বললাম, আমি আসলে তথাকথিত বড় লেখকদের বই ছাপি না। আমি কিছু বিষয় ধরে বই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। যেমন: সাংবাদিকতা, নাটক, চলচ্চিত্র, তথ্যপ্রযুক্তি। আর আমি আসলে তরুণ ও ভালো লেখকদের বই প্রকাশেরও চেষ্টা করি।

কিন্তু মনোপুত হয়নি আমার উত্তর। সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলেন রামেন্দু দা। দাদা বললেন, বাহ্ ওর প্রোডাকগুলোতে সুন্দর। আর বিষয়গুলোও ভালো। নাটক, চলচ্চিত্র, তথ্যপ্রযুক্তি, আইনকানুনসহ কয়েকটি অনুবাদ ননফিকশন ছিল বইয়ের তালিকায়। দাদার অনুরোধে দুই ইউনিটের স্টল জুটে যায় সে বছর। সহযোগিতা পেয়েছিলাম বইমেলা কমিটির সদস্যসচিব শাহিদা খাতুন আপারও। কিন্তু হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন সেই শক্তিধর মহাপরিচালক। ভবিষ্যতে বড় লেখকদের বই প্রকাশ করবে। নতুবা বাংলা একাডেমিতে স্টল পাবে না।

বড় লেখকের ঝক্কি কি এখানেই শেষ? না। বাংলাদেশের সৃজনশীল বই প্রকাশনা আর আমাদের বই প্রকাশের সংস্কৃতিতে বড় লেখক শব্দটা আমাদের মগজে ঢুকে গেছে। এই শব্দবন্ধ শুনতে হয় মিডিয়ায় কথা বলতে গেলেও। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে এলে মুখোমুখি হতে হয় একই প্রশ্নের।
আপনারা বড়ো কোন লেখকের বই করেছেন?

বইমেলাজুড়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর মিডিয়ার সাংবাদিকরা প্রচ্ছদ খুঁজতে স্টলে স্টলে ঘোরেন। তাদের প্রায় সবারই একই প্রশ্ন, আজকে আপনাদের প্রকাশনা থেকে বড় কোন লেখকের বই প্রকাশ হয়েছে? প্রচ্ছদ দিন। পত্রিকায় প্রকাশ করবো।
আমরা দিতে পারতাম না বড়ো লেখকের প্রচ্ছদ। দুয়েকটা দেখালেও পছন্দ হতো না সাংবাদিকদের।

না, তারপরও বড়ো সাইনবোর্ডের পেছনে ছোটা হয়নি। ঘটনাও এখানেই শেষ হয়নি। পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও— কোথাও আমাদের প্রকাশিত লেখকদের বই সাপ্লাইয়ের জন্য মনোনীত হতো না। অনেকবারই জানতে চাইতাম এইসব সাপ্লাই কমিটিতে থাকা অগ্রজ প্রকাশকদের কাছে বইয়ের সাপ্লাই বিষয়ে।

সাপ্লাইয়ে আমাদের বই এত কম কেন? উত্তরে বলতেন, তোমাদের লেখকদের কেউ চেনে না।
অমর একুশে বইমেলা শেষ মানেই তখনকার দিনগুলোতে আমরা কেবলই অন্য একটি একুশে বইমেলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কারণ বইমেলা ছাড়া আমাদের প্রকাশিত তথাকথিত নতুন লেখকদের বইগুলো বিক্রির তেমন কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না তখনও। ঢাকার আজিজ মার্কেট, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট এবং চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল ও ফরিদপুরের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে অনুরোধ করে করে বই পাঠাতাম বাকির স্লিপ দিয়ে। খুব কম নামই বলতে পারবো যারা স্লিপের বইগুলো বিক্রি করে মূল্য পরিশোধ করেছেন।

পরবর্তীতে বইগুলো অনেকেই নিতেই চাইতেন না। কারণ বড়ো লেখকের বই নেই। আমাদের প্রকাশনার সংস্কৃতি তখনও পর্যন্ত বড়ো লেখকের বই প্রকাশের সংস্কৃতি। তবুও আমরা পিছপা হইনি। আমাদের স্বপ্ন, প্রত্যাশা ছিল নতুন লেখকদের নিয়েই। শ্লোগান ছিল প্রতিষ্ঠা থেকেই, ‘প্রজন্মের হাত ধরে আগামীর স্বপ্ন।’

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পেছনে যে শ্রম, মেধা, অর্থ আর সময়গুলো যাপন করেছি তা কেবল পরিবার আর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু-সহযাত্রী-স্বজনেরই জানা। আমাদের তথাকথিত তরুণ লেখকদের অনেকেই এই ইতিহাস জানেন না। কিংবা অনেকেই হয়তো ইতিহাস জানার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিংবা এটাই হয়তো বই প্রকাশনার সংস্কৃতি।

কষ্টগুলো, যুদ্ধযাত্রার সময়গুলো কাটিয়ে হয়তো উঠেছি। এবং এই যাত্রাপথে সেইসব তরুণের অনেকেই হয়তো আমাদের যাত্রাসঙ্গ থেকে অন্য নতুন কোনো পথে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু থেমে থাকেনি ভাষাচিত্রের তারুণ্যনির্ভর স্বপ্নযাত্রা। প্রকাশনার অনেক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়গুলো কাটিয়ে উঠেছি হয়তো। কিন্তু স্রোতের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করতে গিয়ে যে অমানবিক, অমানুষিক হৃদয়ক্ষরণ হয়েছে তা কেবল নিজেরই জানা। তবুও মাথা নত করিনি কোথাও। যাত্রাপথটাও পরিবর্তন করিনি।

ভাষাচিত্রের চোখ এখনও তরুণে-তারুণ্যে। আমাদের চোখ নতুন, সবুজ আর সজীবে। আমরা সজীব বাতাসেই নিঃশ্বাসটুকু নিতে চাই পরের পথচলাতেও। কিন্তু প্রকাশনা জগতে এতদিনের পথচলায় অনেক প্রশ্ন আর উত্তরগুলোও জানা হয়ে গেছে। এখন জানি, কেন বন্ধু প্রকাশকরা বড়ো লেখকদের পাণ্ডুলিপি পেতে মরিয়া ছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলায় স্টল পেতে কেন তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কেন আমাদের দেশের সাপ্লাইগুলো নিয়ে ওদের কোনো আক্ষেপ নেই। কেন পত্র-পত্রিকায় ওদের বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপা হতো বইমেলা চলাকালে।

তবে এক যুগের যুদ্ধযাত্রায় প্রাপ্তি কি নেই? হিসেব করে দেখেছি। সেদিন একজন লেখক আমাকে প্রশ্ন করছিলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য প্রকাশকের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কোথায়? উত্তরে বলেছি, বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুঁজে খুঁজে বড়ো লেখক, সফল লেখক, বাণিজ্যিক লেখকের বই প্রকাশ করে। বড়ো ও সফল লেখকের খোঁজ করে। ইদানীং কিছু কিছু প্রকাশক ভাষাচিত্র প্রকাশিত লেখকদের বই প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করে। ভাষাচিত্র প্রকাশিত লেখকের খোঁজ করে। চলবে