খন্দকার সোহেল

খন্দকার সোহেল

প্রকাশকের ডায়েরী

পর্ব ১

খন্দকার সোহেল

প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০২০

গল্পটা ২০০৮ সালের জানুয়ারির। যদিও তার আগে `টিমওয়ার্ক` নামের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু `ভাষাচিত্র` নামটি তখনও আসেনি। ইংরেজি নামে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করতে চাইনি বলে একটি বাংলা নাম খুঁজছিলাম। একটা নাম ঠিকও করেছিলাম। সেই নামেই প্রথম বইয়ের ট্রেসিং দেয়া শেষ। প্রচ্ছদ রেডি হচ্ছে। একসময়ের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের তীর্থস্থান আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় টিমওয়ার্কের ছোট্ট অফিসক ক্ষটিতে আমরা তিনজন। আমি, শিল্পী সব্যসাচী হাজরা আর শাহরিয়ার ভাই। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার।

হঠাৎ বাংলাবাজার থেকে সাহিত্য বিকাশ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, সজ্জন ও বইবান্ধব প্রকাশক ফজলু ভাইয়ের ফোন শাহরিয়ার ভাইয়ের মোবাইলে। ফোন শেষে শাহরিয়ার ভাই বললেন, `সোহেল ট্রেসিং পাল্টাতে হবে কয়েকটা।`
`কেন শাহরিয়ার ভাই?`
ফজলু ভাই বলেছেন, `পাণ্ডুলিপি` নামে বাংলাবাজারে একটি অনিয়মিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে। তাই এই নাম রাখা যাবে না।`

তিনজনই চিন্তায় পড়ে গেলাম। সব্যসাচী হাজরা ততক্ষণে বইয়ের প্রচ্ছদ আউটপুটের জন্য রেডি করে ফেলেছেন। চিন্তার ভাঁজ তার কপালেও। শাহরিয়ার ভাই অভয় দিলেন। অর্ডার দিলেন স্বভাবভঙ্গিতে, নিনচ থেকে আমার জন্য সিগারেট আর সব্য`র (সব্যসাচী হাজরা) জন্য মার্কার পেন নিয়ে আসতে বলো।

অফিস সহকারীকে বিলম্ব না করে মার্কেটের নিচে পাঠালাম। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে সে ফিরে এলো এক প্যাকেট সিগারেট আর মার্কার পেন নিয়ে। সিগারেট ধরালেন শাহরিয়ার ভাই। সিগারেট মুখে নিয়ে এক টান দেন, অন্যহাত এলোমেলো নাড়াচাড়া করেন। আবার সিগারেটে টান দেন, অন্যহাতে তার এলোমেলো চুলে আঙুল চালনা করেন। মাঝেমধ্যে জাদুকরদের মতো দুই হাত সামনে নিয়ে বিড়বিড় করেন আর হাঁটাচলা করেন। মিনিট কয়েক চলল এভাবে।

রুমের অন্যরা তখন শুধুই দর্শক। অন্যরা বলতে আমি আর শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। হঠাৎ তার মুখে আওয়াজ, `সব্য কলম নাও` নাম পেয়ে গেছি। সোহেলের প্রকাশনীর নাম হবে, `ভাষাচিত্র।

ভাষাচিত্র! বাহ! আমি তখন নির্বাক। এতটাই পছন্দ হয়েছিল নামটা ,জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল শাহরিয়ার ভাইকে। পারিনি। আমরা মধ্যবিত্তরা আমাদের ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি গোপন করি। লুকিয়ে থাকে আমাদের না বলা অনেক ভালোবাসা কিংবা আবেগগুলো।

সব্যসাচী হাজরা তৎক্ষণাৎ সাদা কাগজে ঘষে ঘষে ভাষাচিত্র ফন্ট তৈরি করা শুরু করে দিলেন। সঙ্গে সিম্বল হিসেবে একটি খোলা ডানা। তারপর আকিঁবুকি, স্ক্যান, পাথ এবং ফটোশপ-ইলাস্ট্রেটরের ঘষামাজায় কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘পাণ্ডুলিপি’ হয়ে গেল ‘ভাষাচিত্র’।

আমি নির্বাক তাকিয়ে দেখলাম একজন কবি আরেকজন শিল্পীর ক্ষণিকের শিল্পমগ্নতা আর শিল্পসৃজন। দুজনই আমাদের সময়ের সেরা দুই কারিগর, কবিতা আর প্রচ্ছদশিল্পের। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের পথচলায় যত জায়গায় যত লেখক-পাঠক-প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে `ভাষাচিত্র` নামটির প্রশংসা করেননি এমন মানুষ আমি এখনও খুঁজে পাইনি। আর নামের সঙ্গে মানানসই নামলিপি আর একটি ছোট্ট সিম্বল সম্বলিত লোগো... এখনও মনে হয় ভাগ্যগুণেই একইসঙ্গে অমন পাওয়া।

আমি ভাগ্যবান প্রকাশক। প্রকাশনা জীবনের শুরুতে আবু হাসান শাহরিয়ারের মতো অগ্রজ মেধাবী কবি আর সব্যসাচী হাজরার মতো মেধাবী একজন শিল্পীর ভালোবাসা পেয়েছিলাম। ভাষাচিত্রের পথচলায় এই দুজনের নাম তাই আমরা কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করি প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্তে।

ভাষাচিত্রের প্রথম বইটির নাম `যাইত্যাছি যাইত্যাছি কই যাইত্যাছি জানি না`। লেখক আবু হাসান শাহরিয়ার, প্রচ্ছদশিল্পী সব্যসাচী হাজরা। বইটির জন্য আলাদাভাবে সুদৃশ্য একটি খাম প্রিন্ট করেছিলাম আমরা। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে পেশাদার প্রকাশক হবো, এমন একটি স্বপ্ন নিয়েই প্রকাশনা শুরু করেছিলাম। বই প্রকাশের ভাবনা-বিনিময় পর্বেই লেখকের হাতে কিছু আগাম লেখক সম্মানি তুলে দিয়েছিলাম প্রথম বই প্রকাশের আগে। যদিও এই স্বপ্নযাত্রা আর ঠিক থাকেনি। বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছি বই প্রকাশনাকালে। একসময় মনে হতো, প্রকাশনা আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু হাল ছাড়িনি। স্বপ্নটা মরতে দিইনি।

প্রথম বইটি প্রকাশকালে দেশ ছিল সেনাশাসনের অধীনে। দৈনিক আমাদের সময়ে শাহরিয়ার ভাই সে সময় সাহসী কিছু গদ্য লিখেছিলেন। সেইসব গদ্য নিয়ে প্রথম বই `যাইত্যাছি যাইত্যাছি কই যাইত্যাছি জানি না`। কোথায় যাচ্ছে আমাদের দেশ, সমাজ? আর আমাদের গন্তব্য? সমকালীন সাহসী গদ্য নিয়েই ছিল আমাদের প্রথম বই। চলবে