প্রাচ্য তাহেরের প্রবন্ধ ‘মিরাজের প্রকৃত শিক্ষা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২২

নিশ্চয়ই মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহর কাছে বারো মাস আল্লাহর গ্রন্থে, আল্লাহর জমিন ও আসমানগুলো সৃষ্টি করার দিন থেকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে চারটি মাস সম্মানিত। সূরা তাওবা ৩৬
এই চারটি মাস হচ্ছে: মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ্ব। এ মাসগুলোয় হত্যাকাণ্ড ও ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হারাম। রজব মাসে রাসূল (স.) মিরাজ গমন করেন। মিরাজকে উপলক্ষ করে মুসলিম সমাজে নানারকম আয়োজন করতে দ্যাখা যায়। এতে করে নতুন নতুন নানা বিদআত ও কুসংস্কার তৈরি হয়। বলা দরকার, উদযাপনের জন্য মিরাজ নয়। মিরাজের ঘটনা কেন ঘটেছিল এবং তা থেকে আমাদের শেখার কি আছে, এটা উপলব্ধি করাই মুসলমানের কর্তব্য।

আল্লাহ বলছেন, পরম পবিত্র ও মহিমান্বিত সত্তা তিনি, যিনি তার বান্দাকে একরাতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করালেন, যার চারদিকে আমার রহমত ও বরকত ঘিরে রয়েছে। যেন আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। তিনি সবকিছু শোনেন ও দ্যাখেন। বনি ইসরাঈল ১
কী, বোঝা গেল কিছু? একটু ভেঙে বলি। আভিধানিকভাবে মিরাজ মানে ওপরে যাওয়া। পারিভাষিক মানে, নবুয়তের মহান দায়িত্ব ঠিকঠাক পালনের জন্য রাসূলকে (স.) প্রশিক্ষণ দিতে আল্লাহ তার রাসূলকে নিজের কাছে উপস্থিত করেন। এ মিরাজ প্রায় সকল নবিরই হয়েছিল। তবে সবার মিরাজ একই স্থানে বা একই রকম হয়নি। আদমের (আ.) মিরাজ হয়েছিল বেহেস্তে। মূসার (আ.) মিরাজ হয়েছিল তূর পাহাড়ে। ইবরাহিমের (আ.) হয়েছিল মরুভূমির ভেতর। সবশেষে হযরত মুহাম্মদের (স.) মিরাজ হয় সাত আসমান পেরিয়ে আরশে মুয়াল্লায়। দ্যাখা যাচ্ছে, সকল নবির মধ্যে শেষনবির মিরাজ সবচে গুরুত্বপূর্ণ।

মিরাজ সম্পর্কে সাধারণত যেসব কথা আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে শুনি তাতে শুধুই অলৌকিক ঘটনা রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করা হয়। যেন মিরাজ ওই অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে বাংলাদেশ থেকে একজন যুক্তরাষ্ট্রে গেল। পড়াশোনা শেষ করে সে দেশে ফিরে যদি তার যাতায়াতের কাহিনি শোনায়, তা কি তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল? নিশ্চয়ই নয়। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে সে যে জ্ঞান অর্জন করেছে সে জ্ঞান দেশবাসীর ভেতর ছড়িয়ে দেয়াই তার আসল উদ্দেশ্য। একইভাবে, মহানবির মিরাজ গমনের অলৌকিক কাহিনি মিরাজের আসল উদ্দেশ্য নয়। মিরাজের আসল শিক্ষা বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহানবি মিরাজে গিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের জন্য কি কি বিধান নিয়ে এসেছেন, সেটা। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, ওইসব বিধান ঠিকঠাকভাবে পালন করা।

মিরাজ থেকে পাওয়া দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। রমজান মাসের রোজা রাখা। এখন যদি আমরা মিরাজের শিক্ষাগুলো যাপিতজীবনে পালন না করে মিরাজকে শুধুই অলৌকিক কর্মকাণ্ড ভেবে নিয়ে বিস্মিত হই আর উদযাপন করি, তবে মিরাজের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।

মিরাজে মহানবি নিজ শরীরে ও জেগে থাকা অবস্থায় গমন করেন। কোরআনে আল্লাহ আবদ বা বান্দা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শব্দটি পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করে আত্মা ও শরীরের সমষ্টিকে। ফলে, সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই যে, মহানবি নিজ শরীরে ও জেগে থাকা অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন।

মুহম্মদ (স.) মিরাজে গিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে যেসব বিধিবিধান নিয়ে এলেন এবং সমাজে তা বাস্তবায়ন করলেন, তা মূলত প্রকৃতির বিধান। বিশ্বপ্রকৃতি একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। মানুষ যেন সে নিয়মের বাইরে গিয়ে বিশৃঙ্খলতা তৈরি না করে, এজন্য আল্লাহ ওইসব বিধিবিধান মহানবিকে শিখিয়ে দ্যান। ওই বিধিবিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করলে প্রকৃতির বিধানের সাথে মানুষ একাত্ম হয়। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলতা তৈরি হয় না। এরই ফলে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শৃঙ্খলা তৈরি হয়। এ শৃঙ্খলা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে। ব্যক্তিজীবনকে করে শান্তিময়।

আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করার দরকার ছিল তা অবতীর্ণ করলেন। সূরা নাজম ১০
এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, মিরাজের পুরো ঘটনা আমাদেরকে জানানো হয়নি। যতটুকুর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে কেবল ততটুকুই আমাদেরকে জানানো হয়েছে। তো চলুন, মিরাজের ঘটনায় আমাদের জন্য কী কী শিক্ষা রয়েছে সেগুলো জেনে নিই:
১. তোমার প্রভুর সিদ্ধান্ত যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব, আনুগত্য ও ইবাদত করো না। সূরা বনি ইসরাঈল
২. পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। যদি তাদের যে কোনো একজন অথবা দুজন বৃদ্ধ অবস্থায় বেঁচে থাকেন, তবে তাদের সামনে উহ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করবে না। তাদেরকে তুচ্ছ মনে করবে না। তাদের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলবে। তাদের সামনে যাবে বিনম্র ও দয়ার্দ্রচিত্তে। আর বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, তাদেরকে আপনি সেভাবে প্রতিপালন করুন যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন। সূরা বনি ইসরাঈল
৩. আত্মীয়-স্বজনের পাওনা বুঝিয়ে দাও। মিসকিন ও পথিকদের অধিকার বুঝিয়ে দাও, আর অন্যায়ভাবে অর্থ খরচ করো না। সূরা বনি ইসরাঈল
৪. অপচয়কারী শয়তানের ভাই। নিশ্চয়ই শয়তান তার প্রভুর সাথে বিদ্রোহকারী। সূরা বনি ইসরাঈল
৫. তুমি বদ্ধমুষ্ঠি হয়ো না। একেবাওর মুক্ত হাতও হয়ো না। হলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হবে। সূরা বনি ইসরাঈল
৬. তোমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছে করেন তার জীবন উপকরণ বাড়িয়ে দেন। এবং যার জন্য ইচ্ছে তা কমিয়ে দেন। তিনি তার বান্দাদেরকে ভালোভাবে জানেন ও দ্যাখেন। সূরা বনি ইসরাঈল
৭. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদেরকে তোমরা হত্যা করো না। তাদেরকে ও তোমাদেরকে আমিই জীবন উপকরণ দিয়ে থাকি। তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ। সূরা বনি ইসরাঈল
৮. তোমরা অবৈধ যৌন সংযোগের কাছাকাছি হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। সূরা বনি ইসরাঈল
৯. আল্লাহ যাদেরকে হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথাযথ কারণ ছাড়া তাদেরকে হত্যা করো না। কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি। কিন্তু হত্যার ব্যাপারে যেন বাড়াবাড়ি না করে। সে তো সাহায্য পেয়েছেই। সূরা বনি ইসরাঈল
১০. এতিমের সম্পদ কখনো স্পর্শ করো না। যতক্ষণ জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার মতো বয়সে না পৌঁছায় ততদিন পর্যন্ত তার সম্পত্তি দেখাশোনা করা উত্তম। সূরা বনি ইসরাঈল
১১. অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণ করবে। নিশ্চয়ই চুক্তি সম্পর্কে তাদেরকে জিগেশ করা হবে।
১২. যখন ওজন করবে তখন ঠিকমতো করবে এবং সঠিক পাল্লায় ঠিকভাবে ওজন করবে। বণ্টনব্যবস্থা ন্যায়ভিত্তিক করবে। এটাই সঠিক পদ্ধতি। আর এ ব্যবস্থা খুবই ভালো। সূরা বনি ইসরাঈল
১৩. যে বিষয়ে তোমার জানা নেই তার ওপর অমূলক ধারণার করে কোনো কাজ করবে না। নিশ্চয়ই তোমার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তির ব্যাপারে তোমাকে জিগেশ করা হবে।
১৪. জমিনের ওপর দিয়ে কখনো গর্বনিয়ে চলাফেরা করো না। গর্বে তোমরা জমিনকে ফাড়তে পারবে না এবং পাহাড়ের চেয়ে উঁচুও হতে পারবে না।
২৬ রজব দিবাগত রাতে মিরাজ হওয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আল্লামা নববি (রা.) বলেন, নবুয়ত পাওয়ার দশ বছর তিন মাস পর মিরাজ সংঘটিত হয়। কারো মতে, পাঁচ বা ছয় বছর পর। এসব মতভেদের কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, ২৬ রজব রাতেই মিরাজ সংঘটিত হয়। অথচ নির্দিষ্ট ওইদিনকেই আমরা মিরাজের দিন হিশেবে পালন করে থাকি। এটা কতটা যৌক্তিক সেটা একটি হাদিস দিয়ে মীমাংসা করে যেতে পারে। মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ইসলামে যে মনগড়া কিছু আবিষ্কার করবে যা কোরআন-হাদিসে নেই, তা অবশ্যই প্রত্যাখান করতে হবে। (বোখারি ও মুসলিম)

দ্যাখা যায় যে, মিরাজ কিংবা রজব মাস উপলক্ষে আজমির শরিফসহ বিভিন্ন মাজারের লোকজন লালসালু টানিয়ে চাঁদা আদায় করে। এরপর বড় বড় ডেগ বসিয়ে রান্না করে নিজেরা খায় ও ভক্তদের মাঝে বিতরণ করে। হাদিস অনুযায়ী, এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিদআত। আবার দ্যাখা যায়, মিরাজের রাতকে পুন্যময় রাত মনে করে অনেকে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া দরুদ পাঠ করতে মসজিদে জড়ো হয়। মিরাজ সম্পর্কিত কোনো হাদিসে পাওয়া যায় না, মহানবি (স.) বেঁচে থাকতে কখনো এ রকম ইবাদত করেছেন। তার মৃত্যুর পর কোনো সাহাবি, তাবেয়িন কিংবা তাবে তাবেয়িনরা মিরাজ পালন করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। মনে রাখতে হবে, মিরাজের রাত একটি ঐতিহাসিক রাত, ইবাদতের কোনো বিশেষ রাত নয়।

লিখতে কষ্ট হচ্ছে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মসজিদগুলোর ঈমামদের কোরআন ও হাদিস বিষয়ে তেমন পড়াশোনা নেই। এ কারণে মিরাজের রাতে যখন কোনো অজ্ঞ আবেগি মুসলমান তাদের কাছে ছুটে এসে জানতে চায়, শবে মিরাজে কয় রাকাত নফল নামাজ? কিভাবে পড়তে হয়? কোন কোন সূরা দিয়ে পড়তে হয়? তখন ঈমামরা নিজেদের ঠাঁট বজায় রাখতে ভুলভাল কিছু একটা বলে দ্যায়। এতে করে সাধারণ মুসলমানের ভেতর বিদআত ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ সত্য হচ্ছে, শবে মিরাজে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ ও রোজা নেই। এ বিষয়ে যত হাদিসের উল্লেখ করা করা হয় তার সবগুলোই জাল।

অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আবেগ দেখিয়ে মিরাজ রজনী পালন না করে আমাদের উচিত, মিরাজের শিক্ষাকে জীবনযাপনে পালন করা। মিরাজের প্রতিটি শিক্ষাকেই জীবনে বেশি বেশি প্রতিফলিত করা। এটাই আল্লাহ চান। মিরাজের রাতে মসজিদে লাইটিং কিংবা হালুয়া-রুটি বিতরণ আল্লাহ চান না।