প্রাণ সংহারক ও সম্ভ্রম সংহারক এসব কুকীর্তি

রথো রাফি

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৫, ২০২০

যখন লিখছি, তখন ইন্টারনেটে ভেসে আসা ভিডিওটিতে তাকে উলঙ্গ করা হচ্ছে। তার স্তন সে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে যখন, ঠিক তখনই তার মুখের ওপর এসে লাথিটা পড়লো। যখন সে  জাজিমটা টেনে বুকে চেপে ধরার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই তার যোনীতে মনে হলো টর্চ বা লাঠি ঠেসে ধরা হলো।

মনে পড়ছে, বন্দুকের নলের মুখে মানুষের পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা। মনে পড়ছে, ভূ-মধ্য সাগরের নৌকাডুবে শত শত মানুষের মৃত্যু। আমাদের চোখে এসব নতুন কিছু নয়, তাই তা সেসময় আমাদের আলোড়িত করেনি ততটা।

কিন্তু সেই লাল শার্ট পরা শিশুটি, সেই আইনাল কুর্দির সাগরের তীরে উবু হয়ে মৃত পড়ে থাকা দৃশ্যটি ছিল নতুন। তা আমাদের বিপুল বিহ্বল করেছিল। কিন্তু শত শত রক্তাক্ত ফিলিস্তিনী শিশুর মুখ কোনো নতুন দৃশ্য ছিল না। ফলে তা আমাদের আলোড়িত করেনি।

বাস্তবতার কী পরিহাস! আমাকে আলোড়িত করে না বলে ভিখেরির ক্ষুধা যেন ততটা নির্মম নয়! রবি বাবু আজও বোঝানোর চেষ্টা করছেন, প্রেমের আঘাতে হৃদয় যে কাঁদে, তাতে আকবর বাদশা ও হরিপদ কেরানির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আকবর বাদশার হৃদয় আহত হওয়ার সুযোগই পায় না। দৈবাৎ যদি পায়, তাহলে তা অনুভবের সুযোগও হয় না, কতজন এসে সে শূন্যতা পলকেই পূরণ করে ফেলে! কোনো আকবর বাদশার হৃদয় ভাঙলে আমাদের তা কত না চমকিত করে, কারণ তা কী যে দুর্লভ! আর হরিপদ কেরানির হৃদয় ভাঙা কোনো চমকই জাগায় না! কারণ সেই একই, এ বড়ো সুলভ ঘটনা!

আলোড়িত করে না বলে হরিপদর বিরহ-ব্যথা কি কম হয়! আরও সত্য, রবি বাবুও কখনও উপবাস থাকেননি, আমারও অনেকদিন হলো উপবাস থাকতে হয়নি, আর ভিখেরিরও বলতে গেলে মনে পড়ে না কোনো ভর পেটের স্মৃতি!  

আর অন্যান্য বছরের মতো এ দেশে এ বছরেও কত না নারী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হলো! আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এসবের বেশির ভাগ ঘটনার দৃশ্যমানতায় অশালীন নতুনত্বের থাবা ও নখরনিকৃষ্টতা ছিল না। স্রেফ এ কারণেই কিনা প্রাণ সংহারক ও সম্ভ্রম সংহারক এসব কুকীর্তির বেশির ভাগই আমাদের বিবেকে যেন কোনো পীড়া সৃষ্টি করতে পারেনি। আমরা ভুলে গেছি আরও কত হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার রোমহর্ষক খবর। ধর্ষকের লিঙ্গ নারী দেখে যত সহজে জেগে ওঠে, এত হত্যা, ধর্ষণ, আতঙ্ক ও আর্তনাদের পরও আমাদের বিবেকবোধ, গ্লানিবোধ আর অধিকার বোধ তত সহজে আজও জেগে ওঠে না!

যখন লিখছি, তখন ওই নারীকে উলঙ্গ করার ভিডিওটি আমার চোখে পড়লো, ইন্টারনেটে, ইউটিউবে। এলাকাবাসীর তরফে বলা হচ্ছে, ঘটনার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্মান বাঁচাতে নয়, কারণ সে সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই। হয়তোবা এলাকা ছেড়ে তার পালাতে হয়েছে স্রেফ প্রাণটুকু বাঁচাতেই!

ধরা যাক, ভিডিওটা বানানো! না হলে এ রাতে কিভাবে ঘুমোবো! কিংবা এমন কত দৃশ্যের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমাদের ঘুমোতে হয়, সঙ্গম ও স্বপ্ন দেখতে হয়। আর ভাবতে হয়, সঙ্গম, না ধর্ষণে আছি আমরা।

কেননা সম্পদ অসমতা আর ক্ষমতা অসমতার মাঝে দুজনের মধ্যে যে বেশি সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী, তার উপস্থিতিতে যখন তার চেয়ে দুর্বল কেউ প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে, আর বিছানায় এগিয়ে আসে, সেই দুজনের মাঝে কি আসলেই সঙ্গম জায়গা পায়? কে জানে! শক্তিশালী চুম্বকের নৈকট্যে খুব দুর্বল চুম্বকের এমনকি মেরু পর্যন্ত পাল্টে যেতে দেখি আমরা। এ কিভাবে অস্বীকার করবো! এ কি স্বতঃস্ফূর্ততা!

সকল প্রকার অসমতার মাঝে আমার কাছে ভালোবাসা শব্দটির উচ্চারণ প্রতারণার মতো মনে হয়। যেন তা ধর্ষণের প্রস্তাব দেওয়া! আমি যে কী করি!

যখন লেখাটি লিখছি, তখন ওই ভিডিওতে প্রায় এক মাস আগে ঘটা যৌন নিপীড়নের এই ঘটনা গতকাল প্রকাশের পর, একজন আটক হয়েছে বলে পুলিশ জানায় গণমাধ্যমকে। আটক ওইজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষমতাচক্রের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার পরিচয় সেঁটে রেখেছে এ ঘটনার অনেক অনেক আগে থেকেই। তার এ দাবি হতে পারে সত্য, কিংবা মিথ্যা। কিন্তু সে ও তার সাঙপাঙ্গরা যখন ওই নারীর পোশাক টেনে খুলে নিল, উলঙ্গ হয়ে পড়েছে গোটা জনপদ, গোটা দেশ!  এ আর কী করে মিথ্যে হবে!

নিপীড়নের শিকার ওই নারীকে গতকাল উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এই এই সতি আসক্ত অসৎ সমাজে আইন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্র কারই বা ক্ষমতা আছে তার সম্ভ্রম ফিরিয়ে দেওয়ার!

এই লেখাটি যখন লিখছি, এর মাসখানেক আগেই সবার চোখের পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে! তবে তা আমরা অনুভব করেছি মাত্র একদিন হলো, ভিডিওটি ইন্টারনেটে ভেসে আসার পর! এরপর ঘুমের কথা পাড়া, কিভাবে সম্ভব! তবু ঘুমাবে সবাই, আমিও ঘুমোব, হ্যাঁ, এই এমন নির্লজ্জ রাতে!

লেখক: কবি