ফাতেমা বিনতু কায়েস: নারীর সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক অথরিটি

পর্ব ১

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ১৪, ২০২০

হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েস কুফায় ভাই দাহহাকের ঘরে শুয়ে আছেন। দাহহাক এখন শুধু কুফার না, পুরা ইরাকের গভর্নর। ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া তারে এই পদে নিয়োগ দিছেন। ইয়াযিদ, মুয়াবিয়ার ছেলে। সেই মুয়াবিয়া, আজ থেকে বহু বছর আগে যে লোকটা ফাতেমারে বিয়ের প্রস্তাব দিছিলেন। শুধু কি মুয়াবিয়া? আবু জাহমও তো প্রস্তাব পাঠাইছিলেন। রাসুল সা. দুইটা প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, `মুয়াবিয়া তো গরিব মানুষ, টাকা-পয়সা তেমন নাই। আর আবু জাহম? এই মিয়ার তো বউ পিটানো রোগ আছে।

মনে মনে হাসেন ফাতেমা। দুইটা প্রস্তাব রাসুল নাকচ করে দেওয়ার পরে যে খুশি খুশি ভাবটা মনে জাগছিল তার, এখনও তা টের পান। তবে কি রাসুল সা. নিজেই....? নাহ। ফাতেমার সেই আশা পূরণ হয় নাই। রাসুল সা. তার পালকপুত্র যায়েদ ইবনু ছাবিতের ছেলে উসামা ইবনু যায়েদের পক্ষ থেকে তারে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফাতেমার এখনও মনে পড়ে, রাসুল উসামার নাম বলার সাথে সাথে, হঠাৎ কেমন মন খারাপ হইছিল তার। হাত নেড়ে নেড়ে বলছিলেন, উসামা! উসামা! রাসুল সা. মৃদু হাইসা বললেন, আল্লাহর রাসুলের কথা শোন। তোমার ভাল হবে।

উসামা ইবনু যায়েদের সাথে সংসার কত সুখের ছিল, ভাবতেই চোখে পানি চইলা আসলো ফাতেমার। উসামা মারা গেছেন আজ কত বছর! উসামার পরে আর বিয়ে করতে মনে চায় নাই তার। ভাই দাহহাকের সংসারেই আছেন সেই থেকে। এর মধ্যে তো কতকিছু হয়ে গেল। হযরত উসমানের মৃত্যু, হযরত আলির মৃত্যু, যুদ্ধ, ফিতনা। দাজ্জাল আসার সময় কি তাইলে হয়ে গেল? ভয় পান ফাতেমা। রাসুল সা. থেকে দাজ্জাল-সংক্রান্ত সবচাইতে বড় হাদিসটা তিনিই বর্ণনা করছিলেন, হুবহু। এতবড় হাদিস অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখা চাট্টিখানি কথা না। রূপবতী তো তিনি ছিলেনই, কিন্তু সেই থেকে তার গুণের কথাও ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। কত কত মানুষ তার কাছে হাদিস শুনতে আসত!

কুফার শা`বি আসত। পরবর্তীতে যে হবে বিখ্যাত ইমাম শা`বি (মৃ. ১০৩/৪/৫ হি.)। হযরত ফাতেমার মনে পড়ে, এই ছেলেটা প্রথম যেদিন তার সাথে দেখা করতে আসে, তিনি তারে খুরমা আর ছাতু গোলানো পানি খাইতে দিছিলেন। শা`বি ছেলেটার নম্র-ভদ্র স্বভাবে মুগ্ধ হইছিলেন হযরত ফাতেমা। তারে গুরু মানতেন শা`বি। এমনকি তার বর্ণিত হাদিসের সত্যতা ও যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য হযরত উমরের যুক্তিও খণ্ডন করছিলেন শা`বি। সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব আসত। কাসেম ইবনে মুহাম্মদ আসত। আবু জাহমের ছেলে আবু বকর আসত। হযরত আয়েশার শাগরেদ উরওয়া আসত। আব্দুর রহমান ইবনু সাওবান আসত।

দাজ্জাল বিষয়ে রাসুলের সেই হাদিসের প্রত্যেকটা শব্দ তার আজও মনে আছে। দাজ্জালের আগমন কি তাইলে আসন্ন? ভাই দাহহাক ইয়াযিদের প্রশাসক, কিন্তু এই ইয়াযিদ ছেলেটা কি ঠিকমত দেশ চালাইতে পারবে? রাসুলের পরিবারের সাথে ইয়াযিদের বাহিনী যে জঘন্য আচরণ করছে, তারপরে তার উপর তো আর ভরসা রাখা যায় না। এইসব ভাবেন ফাতেমা। একটু পরেই আবার মনে হয়, আল্লাহ সব ফয়সালা করবেন। ক্ষমতা বা দলাদলি তো তার কাজ না। আল্লাহ তারে আরো বড় দায়িত্ব দিছেন। জ্ঞানের দায়িত্ব। জ্ঞানচর্চার সেই গুরুভার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি অবিচলভাবে আঞ্জাম দিয়া যাবেন।

অনেক কাছ থেকে ক্ষমতারে পর্যবেক্ষণও তো করছেন তিনি। ভাই দাহহাক এখন ইরাকের গভর্নর। মুয়াবিয়ার প্রস্তাব কবুল করলে আমিরুল মুমিনিনের স্ত্রীর মর্যাদা জুটত। কিন্তু হয়ত রাসুলের ফয়সালাই সঠিক ছিল। আলি-মুয়াবিয়ার এই দ্বন্দ্বে মুয়াবিয়ার স্ত্রী হিশাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হইত না। ফাতেমার মন খারাপ হয়ে যায়। হযরত উমরের মৃত্যুর পরে, তার মনোনীত খেলাফত পরিষদের বৈঠক বসত ফাতেমারই বাড়িতে। বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী, বিশ্বস্ত ও সমাজের সবারই শ্রদ্ধার পাত্র হিশাবে, খলিফা নির্ধারণের মত গুরুতর কাজে তার বাড়িই ছিল তুলনামূলক সেফ অপশন। আহা, কত সুন্দর ছিল সেইসব দিন!

হযরত উমরের কথা মনে পড়তেই পুরাতন সব তিক্ত স্মৃতি মনে পড়ে হযরত ফাতেমার। `আল্লাহ উমরকে ক্ষমা করুন!` মনে মনে বলেন উনি। যে আইনি মকদ্দমায় হযরত উমরের সাথে তার বিতর্ক হইছিল, যে মাসালায় প্রায় সব সাহাবি হযরত উমরের পক্ষেই ছিলেন, যে মাসালার কারণে নানারকম কটুকথা শুনতে হইছে হযরত আয়েশার কাছে, এমনকি প্রিয় জীবনসঙ্গী উসামাও যেই মাসালার কারণে মাঝে মাঝে রাগ করতেন তার উপর, সেই মাসালার কারণেই ইসলামের জ্ঞানের ইতিহাসে যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন, কে জানত! নারী হইলেও, হযরত ফাতেমা নিজের জ্ঞান ও ইজতেহাদ থেকে দূরে সরেন নাই। সমাজ এবং ইসলামি আইনশাস্ত্রের ইতিহাসকে নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়া প্রভাবিত করছেন। আর সেই সমাজও ছিল এমন সমাজ, যে সমাজে একজন মাত্র নারীর এজতেহাদ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গেলেও, রাষ্ট্র সেই নারীর জ্ঞানচর্চার অধিকারে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপও করে নাই। চলবে