প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ফাতেমা বিনতু কায়েস: নারীর সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক অথরিটি

পর্ব ৩

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২০

শুধু কি হযরত উমর? হযরত আয়েশাও সমালোচনা করছেন এই হাদিস বর্ণনার জন্য। আব্দুর রহমান ইবনুল হাকামের মেয়ের বিয়ে হইছিল ইয়াহইয়া ইবনু সাইদ ইবনুল আসের সাথে। ইয়াহইয়া তারে তালাক দেন, এবং ঘর থেকে বের করে দেন। এইটা হযরত উরওয়ার ভাল লাগল না। উনি ইয়াহইয়ার ফ্যামিলির কাছে গিয়া ব্যাপারটা জানাইলেন। তারা বলল, হযরত ফাতেমাও বের হয়ে গেছিলেন তালাকের পর। উরওয়া এই পুরা ঘটনা হযরত আয়েশার কাছে বলার পরে, উনি বলেন, `এই হাদিস বর্ণনা কইরা ফাতেমা ভাল কিছু করতেছে না।` এরপরে উনি মদিনার গভর্নর মারওয়ানের কাছে খবর পাঠান, `আল্লাহকে ভয় করো, ওই মহিলারে তার স্বামীর ঘরে ফেরত পাঠাও।`

আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হযরত আয়েশা বলতেন, `ফাতেমার সমস্যা কী? এই হাদিস বলার সময় আল্লাহর ভয় তার মনে জাগে না?` হযরত আয়েশা ফাতেমার বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যাও দেন। উনি বলেন, ফাতেমার সাথে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ঝামেলা ছিল। এই কারণেই তার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ওই হুকুম দিছিলেন রাসুল সা.। হযরত আয়েশা হযরত ফাতেমারে আরো বলছিলেন, `তোমার এই জিহবার কারণেই তুমি স্বামীর ঘরে থাকতে পারো নাই`।

তাবেঈ সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব সম্ভবত হযরত আয়েশার এই কথার সূত্রেই বলছিলেন, `এই মহিলা লোকজনরে ফেতনায় ফেলে দিছে। ওনার মুখ খুব চলত। এইজন্যেই ওনারে ইবনু উম্মে মাকতুমের ঘরে পাঠানো হইছে।` হযরত ফাতেমার মনে পড়ে, ওনার প্রাণপ্রিয় স্বামী হযরত উসামা ইবনু যায়েদও এই হাদিস বর্ণনার কারণে ওনারে তিরষ্কার করতেন। যখনই হযরত ফাতেমা এই ঘটনা বলতেন, হযরত উসামা উনার দিকে কিছু না কিছু ছুঁইড়া মারতেন। (এই বর্ণনাটা দুর্বল)

এছাড়া মদিনার গভর্নর মারওয়ান, সুলাইমান ইবনু ইয়াসার, আসওয়াদ ইবনু ইয়াযিদ, আবু সালামাহ ইবনু আব্দির রহমানসহ আরো অনেকেই হযরত ফাতেমার বর্ণিত এই হাদিসের সমালোচনা করছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার, এত মানুষের ভিন্নমত ও বিরোধিতা সত্ত্বেও, হযরত ফাতেমা এই হাদিস বর্ণনা কইরা গেছেন, এবং সাহাবিদের মধ্যে অধিকাংশই তার বিপক্ষে গেলেও, কেউ তার জ্ঞানচর্চা এবং এজতেহাদের এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন নাই।

হযরত ফাতেমার এই সব স্মৃতি মনে পড়ে, জীবনের পড়ন্তবেলায়, কুফার একটা ঘরে শুয়ে। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের শাসনামলে উনি মারা যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। উসদুল গাবাহ গ্রন্থকার লিখছেন, `তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধা, বুদ্ধিমত্তা, উন্নত সাংস্কৃতিক রুচি, সঠিক মতামত ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন একজন নারী।` হযরত ফাতেমার মৃত্যুর পরে, ইসলামি আইনশাস্ত্রের ইতিহাসে এই হাদিসের অবস্থান কী হইছিল? এত এত সমালোচকের ভিড়ে মুহাদ্দিস ও ফকিহরা কি একজন মাত্র নারীর বর্ণিত এই হাদিসটারে তুচ্ছজ্ঞানে ভুলে গেছিলেন? না।

হযরত ফাতেমার সূত্রে এই হাদিসটা শা`বি, উরওয়াসহ প্রায় ১০ জন রাবি আলাদা আলাদা সূত্রে বর্ণনা করছিলেন। ফলে, সিহাহ সিত্তাসহ মুসনাদে আহমদ, সুনানে দারেমি, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, ইমামা তাহাবির `শারহু মা`আনিল আছার`, মুসতাদরাকে হাকিমসহ আরো বহু হাদিসের কিতাবে এই হাদিসটা সংকলিত হয়। এবং একজন মাত্র নারীর বর্ণনা সত্ত্বেও, মুহাদ্দিসদের সাধারণ মেথড অনুযায়ী, পুরাপুরি সহিহ হাদিস হিশাবে স্বীকৃতি পায়। যেহেতু সহিহ হাদিস, ফলে ইসলামি আইনশাস্ত্রে এই মাসালার রায়ে, হযরত ফাতেমার হাদিসটা নিয়া বিশেষ ও বিস্তারিত বিতর্ক শুরু হয়।

ফকিহদের মধ্যে অনেকেই এই হাদিস আর সুরা তালাকের আয়াতের মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করেন। হযরত ফাতেমার বর্ণিত এই একটামাত্র সহিহ হাদিসের ভিত্তিতে, এই মাসালায় কয়েকটা মতামত তৈয়ার হয়:

১. কোরআনের আয়াতটা তালাকে রজঈ বা সাময়িক তালাকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে, তালাকে রজঈ হইলে ইদ্দতের সময়ে বউরে থাকা খাওয়ার খরচ দিতে হবে। কিন্তু তিন তালাকের ক্ষেত্রে দুইটার কোনটাই দিতে হবে না। এইটা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (ফকিহ সাহাবিদের মধ্যে একমাত্র উনিই হযরত ফাতেমার মত অনুযায়ী ফতোয়া দিছেন), হাসান বসরি, ইকরিমা, আতা ইবনু আবি রাবাহ, আমির আল শা`বি, ইসহাক ইবনু রাওয়াহা এবং আহমদ ইবনু হাম্বলের মতামত। হযরত ফাতেমার নিজের মতও এইটাই। সুতরাং বলা যায়, এই ইমামেরা ওনার ফতোয়া অনুযায়ীই ফতোয়া দিছেন।

২. কেউ কেউ হযরত ফাতেমার হাদিসটা আমলে নিছেন, কিন্তু হুবহু ওনার মত অনুযায়ী ফতোয়া দেন নাই। এদের মতে, তালাকের পরে, কোরআনের আয়াতের কারণে বউরে থাকার জায়গা দেওয়া স্বামীর জন্য জরুরি, আর হযরর ফাতেমার হাদিসের কারণে খাওয়া-পরার খরচ দেওয়া জরুরি না। এইটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর, উরওয়া ইবনু যুবাইর, ইমাম মালেক, লাইছ বিন সা`দ ও ইমাম শাফির মতামত।

৩. যেকোন অবস্থায় তালাকের পরে ইদ্দত চলাকালীন বউরে থাকা-খাওয়া-পরার খরচ দেওয়া জামাইর জন্য অবশ্য কর্তব্য। ফকিহ সাহাবাদের একটা বিরাট অংশ— হযরত উমর, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ, হযরত আয়েশা, হযরত উসামা ইবনু যায়েদসহ অসংখ্য তাবেঈ, যথা: আসওয়াদ ইবনু ইয়াযিদ, সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবরাহিম নাখঈ, ইমামা আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ইবনু হাসান শাইবানি প্রমুখের মতামত এইরকম। চলবে