প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ফাতেমা বিনতু কায়েস: নারীর সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক অথরিটি

শেষ পর্ব

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

হযরত ফাতেমার এই হাদিসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের জবাবও ইমাম ও ফকিহগণ দিছেন। ওনার এই হাদিসের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি আমরা আগে দেখছি। এই অভিযোগগুলি মোটমাট চার ধরনের:

১. এই হাদিসের বর্ণনাকারী একজনমাত্র নারী। সুতরাং, এই হাদিসের সত্যায়নের জন্য দুইজন সাক্ষী লাগবে (যেমন, সাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে দুইজন নারীর সাক্ষী লাগে)। এই মতামতের বিশেষ কোনো ভিত্তি নাই। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনুল কায়্যিম তার `যাদুল মা`আদ`-এ এবং ড. আকরাম নদভি তার `মুহাদ্দিসাত`-এ বিস্তারিত আলাপ করছেন। আগ্রহীরা দেইখা নিতে পারেন।

২. তার হাদিস কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। ওয়েল, এই অভিযোগের উত্তর উনি নিজেই দিছেন।

৩. তার হাদিস হযরত উমরের হাদিসের বিরোধী। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত উমর এও বলছেন যে, আমি রাসুলকে বলতে শুনছি যে, তালাকপ্রাপ্তা নারী থাকা-খাওয়ার খরচ পাবে। ইমাম ইবনুল কায়্যিম তার `যাদুল মা`আদ`-এ নানান তথ্য-যুক্তির ভিত্তিতে বলতেছেন, হযরত উমর থেকে এরকম কোনও বর্ণনার প্রমাণই নাই। এবং এই হাদিসের রাবি হাম্মাদ ইবনু সালামহ, হাম্মাদ ইবনু আবি সুলাইমান এবং ইবরাহিম নাখয়ির কড়া সমালোচনা করছেন। তিনি এদেরকে `ফেরকাবাজি করা উচিত না` বলে তিরষ্কারও করছেন।

৪. হযরত ফাতেমার মুখ খারাপ ছিল, এইজন্য তাকে স্বামীর ঘর থেকে বিশেষভাবে বের করে দেওয়া হইছে। এ ব্যাপারে ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যা বলেন, `কী নোংরা কথাবার্তা! এই নারী একজন বিশিষ্ট, সম্মানিত সাহাবি; প্রথম মুহাজিরদের একজন; এই নারীর তাকওয়া ও দ্বীনদারিতে এমন কমতি কীভাবে থাকতে পারে, যার কারণে তিনি এতটা মুখ খারাপ করবেন যে, তারে স্বামীর ঘরে থাকার আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে?!` এরপরে তিনি আরো অনেক যুক্তিপ্রমাণ দিয়া এই অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা করেন।

এত বড় ঘটনা কেন লিখলাম? এই পুরা ঘটনায় আমাদের জন্য চিন্তা ও কুচিন্তা— সবকিছুর খোরাকই আছে। কুচিন্তার দরজাগুলি আগে বন্ধ করি। এই লেখায় আমি কোনও মাজহাবরে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করি নাই। যেহেতু হযরত ফাতেমা বিনতু কায়েস রা. সম্পর্কে এই লেখা, ফলে ওনার মতামত পুরো সোসাইটির মতামতের উপরেও কীভাবে প্রাধান্য পাইছিল, অন্তত ওনার মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকারটা যে ওনারে দেওয়া হইছিল, সেইটা বলাই আমার উদ্দেশ্য। আমি নিজে হানাফি মাজহাবের একজন অ্যাডমায়ারার; ফলে, এইখানে যদি কেউ সালাফিদের ষড়যন্ত্র খুঁইজা পান, তা একান্তই আপনার ব্যাপার।

ওকে, লেটস মি ক্লিয়ার সাম পয়েন্টস:

১. হযরত ফাতেমা বিনতু কায়েস একজন নারী। এই হাদিস উনি একা বর্ণনা করছেন, এবং ব্যাখ্যা করে আপাতঃসাংঘর্ষিক কোরআনের আয়াতের সাথে মিলাইছেন। প্রায় সকল ফকিহ সাহাবি ওনার বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু তবু, সোসাইটিতে এই স্পেশটা ছিল, যেখানে উনি একাই নিজের মতামত বর্ণনা করতে পারেন, এজতেহাদ করতে পারেন। এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়। এইটাই ছিল সে যুগে নারীর পাবলিক অথরিটির নমুনা।

২. ওনার মতামত পছন্দ করেন নাই, এমন অনেকেও ওনার এই হাদিস বয়ান করছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। এইটা ইসলামি অ্যাকাডেমিয়ায় একটা অসাধারণ ব্যাপার, যা আমরা এখন ভুইলা গেছি।

৩. হযরত উমর ফাতেমা বিনতু কায়েস `নারী` বইলা ওনার হাদিসের বিরোধিতা করেন নাই। উনি কোরআনের আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক যুক্তিতে বিরোধিতা করছিলেন। কারণ, একজনমাত্র নারীর হাদিস গ্রহণের মেছাল অগণিত। কোন কোন মুহাদ্দিস পরবর্তীতে এই খোঁড়া যুক্তি দিলেও, মুহাদ্দিস ও ফকিহদের একটা বিরাট অংশ হযরত ফাতেমার এই হাদিসরে গুরুত্ব দিছেন, এবং ইভেনচুয়ালি তার ফতোয়ার ভিত্তিতেই ফতোয়া দিছেন। একজন মাত্র নারীর মেধা ও যোগ্যতাও এই পরিমাণ ইনফ্লুয়েনশিয়াল ছিল তাদের কাছে।

৪. এইখানে একটা ডিলেমা দেখা দেয়। সাধারণত, যারা পশ্চিমা নারীবাদ মুখস্ত কইরা নারীর অধিকার নিয়া কথা বলেন, তারা এই ডিলেমায় পড়বেন। হযরত ফাতেমার মত, না হযরত উমর ও আয়েশার মত, কোনটা নারীর জন্য বেশি উপকারী ও নারী অধিকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? কঠিন সওয়াল। মাসালার আলাপটা একটু সরায়ে রাখি।

ধরা যাক, হযরত ফাতেমার মতটা নারীর জন্য খুব ক্ষতিকর। স্বামী তালাক দিল, এখন ঘরে থাকতে দেবে না, খাওয়ার খরচও দেবে না— এ কেমন অনাচার! কিন্তু ভাবেন, হযরত ফাতেমার এই হাদিস বর্ণনা করা, ব্যাখ্যা করা, অন্যান্য সোশাল অথরিটিরে চ্যালেঞ্জ করা, `মুখ খারাপের কারণে` স্বামীর ঘরে থাকতে পারে নাই শোনা— এতকিছুর পরেও সোসাইটিতে উনি যে স্বাধীনভাবে ওনার এই মতের চর্চা করতে পারছিলেন, এবং ইভেনচুয়ালি, এইটা ইসলামের জ্ঞানের ইতিহাসে একজন নারীর বিরাট ইম্প্যাক্টের সাক্ষ্য হিশাবে হাজির আছে, অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা, জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতার জায়গা থেকে এইটারে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

কনভেনশনাল নারীবাদীরা এই জায়গাগুলাতে ফোকাস করতে পারবেন না। ওনারা নারী অধিকার দেখেন কেবল নারী কী পাইল আর কী হারাইল—এর মধ্যে। স্বামীর কাছে কিছু পাওয়াই যেন নারীর একমাত্র অধিকার। আর সব নির্যাতন। অথচ, হযরত ফাতেমার পুরা কাহিনী পড়ার পরে ওনার এবং সেই ধর্মীয় সোসাইটিতে নারীদের সোশাল স্পেশের প্রতি আমাদের রীতিমত ঈর্ষা হওয়ার কথা।

৫. আগেই বলছি, আমি হযরত ফাতেমার মতামতরে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য এই লেখা লেখি নাই। ওনার অ্যাকাডেমিক জার্নি, চিন্তার সক্ষমতা ও সোশাল অথরিটির ইতিহাসটারেই সামনে আনতে চাইছি। এই মাসালায় আমি ইমাম আবু হানিফাসহ জমহুর সাহাবার মতামতরেই, সার্বিক বিবেচনায়, নারীদের জন্য ভাল মনে করি।

উপরে একটা ঘটনা লেখছি। ইয়াহইয়া ইবনু সাইদ তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের কইরা দেন। এই `বের করে দেওয়া`র যুক্তি হিশাবে তারা হযরত ফাতেমার হাদিস সামনে আনেন। কিন্তু, এইভাবে ফোর্সফুলি বের কইরা দেওয়া, এইটা সব সোসাইটির জন্য উপযুক্ত না। বিশেষত দুর্নীতিগ্রস্ত অপরাধগ্রস্ত নষ্ট সমাজের জন্য। অনেক নারীই এতে নিজের অধিকার ও মর্যাদা হারাবেন। ফলে, সার্বিক বিবেচনায়, হযরত উমর ও হযরত আয়েশার মতটাই গ্রহণীয়।

কিন্তু, হযরত ফাতেমার পয়েন্ট কী ছিল, ভুইলা গেলে হবে না। হযরত ফাতেমা বলছিলেন, যদি তিন তালাক দিয়ে দেন, এরপরে তো আর `আল্লাহ হয়ত এরপরে ভাল কিছু ঘটাবেন`, এই সম্ভাবনা নাই। তাইলে, তিন তালাকের পরে তো স্বামীর ঘরে থাকারও কোনও মানে নাই। একজন নারী, যার স্বামীর সাথে চিরদিনের বিচ্ছেদ হইছে, তার জন্য আরো চার মাস দশ দিন স্বামীর আত্মীয়দের সাথে একই বাড়িতে থাকা কতটা কষ্টের, এইটা আমাদের দেশের নারীরা চোখ বুজলেই ইমাজিন করতে পারবেন। তালাকের পরে স্বামীর দয়ামায়ায় একটা চাকরানির চাইতে ভালভাবে বাঁচা অসম্ভব। ফলে হযরত ফাতেমা নারীদের আত্মমর্যাদা ও কমফোর্টের দিকটারে গুরুত্ব দিছেন। এক হিশাবে চিন্তা করলে হযরত ফাতেমার মতটারেই বেশি নারীবাদী লাগার কথা, কারণ এই মত তালাকের পরে পরে নারীকে স্বামীর ঘরে থাকা, তার খাওয়া, তার পরা ইত্যাদি থেকে স্বাধীন কইরা দেয়, যা সাধারণত উন্নত সমাজে নারীদের পাওয়ার প্রাক্টিসের লক্ষণ।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখা যাইতে পারে, কোনও কোনও সাহাবি গর্ভবতী নারী ছাড়া অন্যদের খাওয়া-পরার ব্যয় স্বামী বহন করবে না মর্মে মত দিছিলেন। হযরত ফাতেমা সেই মতামতের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়া বলছিলেন, তাদের খাওয়া পরার ব্যয় যদি বহন না কর, তাইলে তাদের `আটকে রাখ` কোন যুক্তিতে? এইখানে `আটকে রাখা` শব্দটাই অনেক কিছু বইলা দেয় মনে হয়।

যাহোক, এই আলাপটা করলাম একথা বোঝানোর জন্য যে, আপনি কোন নির্দিষ্ট নারীবাদী দৃষ্টি দিয়া এই ঘটনারে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। এর কারণ হইল, সাহাবায়ে কেরাম নারীবাদটাইপের কোন ইডিওলজি সামনে রাইখা এই ফয়সালা করেন নাই। ওনারা কোরআন-হাদিস ও সোসাইটির নানারকম প্র্যাক্টিক্যাল নিড সামনে রাইখা ফয়সালা করছেন। ফলে, পরস্পরবিরোধী মতের চর্চা ওনারা সোসাইটিতে করতে পারছেন, একজন নারীও সোসাইটির মতের বিরুদ্ধে, এবং অ্যাপারেন্টলি `নারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে` অথরিটি হইতে পারছেন। ওনার কাছে `নারীর স্বার্থ`টা ছিল অন্যরকম এবং সেই অন্যরকম স্বার্থচিন্তাটা উনি করতে পারছেন। নারীবাদী পুলিশিংয়ের বা পলিটিকাল কারেক্টনেসের মুখে পড়েন নাই।

যদিও নসের পাশাপাশি, ওনাদের সবারই ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিজনিং বা যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা ও ইজতেহাদ ছিল। হযরত ফাতেমার মতামত থেকেই বোঝা যায়, কেন উনি আবু আমরের ঘর ছাড়ছিলেন। উনি চাইতেন না, তালাকের পরে নারীরা স্বামীর ঘরে মিজারেবল জীবনযাপন করুক। হযরত ফাতেমা বিনতু কায়েস। আমরা হয়ত আপনার সাথে একমত না, কিন্তু আপনারে সালাম। ইসলামে নারীর সোশাল ও অ্যাকাডেমিক অথরিটি কীভাবে চর্চা করতে হয়, আপনি তা দেখাইছেন। দেখাইছেন— সবসময় খালি পাওয়ার মধ্যেই না, মাঝেমাঝে কিছু ছাইড়া দেওয়ার মধ্যেও নারীর মর্যাদা ও সম্মান থাকে। রাযি আল্লাহু আনহা।

তথ্যসূত্র:
১. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, মুহাম্মদ আব্দুল মাবুদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড।
২. যাদুল মা`আদ, ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যা, পৃ. ৯৪১-৯৫০।
৩. আল মুহাদ্দিসাত, ড. আকরাম নদভি।