অলঙ্করণ: তাসনিম বুশরা

অলঙ্করণ: তাসনিম বুশরা

ফায়জুল আরেফীনের গল্প ‘শেষ বিকেলের চা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১

এই গল্পের সকল চরিত্র, স্থান, কাল ও পুরো ঘটনাটি কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়।

লোকাল বাস থেকে নেমেই চমকে ওঠে সুপ্তি, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দিনার। অপলক চেয়ে আছে তার দিকেই। সুপ্তি দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। মনে হচ্ছে, দিনার তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! সুপ্তির বয়স এখন পঞ্চাশ। সে হিসেবে দিনারের বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবার কথা। অথচ এই ছেলেটা ঠিক দিনারের যুবক বয়সের চেহারা নিয়ে তার পিছু নিলো কিভাবে? বাসার কাছে এসে সুপ্তি থেমে যায়। পেছনে ফিরে দেখে, কেউ নেই। মনের ভুলও হতে পারে।

সুপ্তি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল দিনারকে। বিয়ের আগেও দিনার সুপ্তির পেছনে পেছনে আসতো, এইভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের প্রেম। দুই বছর পর চুটিয়ে প্রেম করে একরকম বাবা-মায়ের অমতেই বিয়ে করে। অথচ এক বছরও টেকেনি সেই সংসার। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর আগেই সংসারে পারিবারিক কলহের জেরে বিচ্ছেদের সুর বাজে। শেষ হয় খুব বাজেভাবেই। জেদি ও আপসহীন হিসেবে সুপ্তি নিজেকে শান্ত রাখেনি। মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়। আদালতেই রায় দেয় তিন বছরের জেল। সেদিনই শেষ দেখেছিল দিনারকে। ভেঙে পড়েছিল কান্নায়। সুপ্তির আত্মতুষ্টি দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। নতুন সংসার পেতেছিল সে সময়, পুরনো এক বন্ধুকে নিয়ে। দুই মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে বিয়ে দিতে প্রায় ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ভুলেই গিয়েছিল দিনারকে। অথচ এই ছেলেটাকে দেখেই ভুল করে দিনার ভেবে, দিনারের স্মৃতি মনে পড়ে যায় সুপ্তির।

পরদিন সন্ধ্যায় সুপ্তি আবারো একইভাবে মুখোমুখি হয় ছেলেটার। আসলেই খুব মিল আছে দিনারের সাথে। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চাউনি সবমিলে যায় যুবক দিনারের সাথে। বেশি সময় না নিয়ে বাসার দিকে যেতে থাকে সুপ্তি। বাসার সামনে এসে পেছনে ফিরে দেখে। ছেলেটা উল্টো পথে হেঁটে যাচ্ছে।

পরদিন সন্ধ্যায় ছেলেটার দেখা পায় না সুপ্তি। একটু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, দাঁড়িয়ে আছে কেন অযথা? বাসায় কেউ নেই। মেয়েদের বাবা অফিসের কাজে উত্তরায় গেছে। হয়তো ফেরার পথেই আছে। এসেই খেতে চাইবে। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে এসে চমকে গেল, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। যেন তারই অপেক্ষায় গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তি গেটের কাছে আসতেই ছেলেটা বললো, আমার নাম রফিক। আপনার নাম কি সুপ্তি? সুপ্তির ভেতরটা কেঁপে ওঠে, অবিকল দিনারের কণ্ঠ!

কাঁপা কাঁপা গলায় সুপ্তি বলে, হ্যাঁ আমি সুপ্তি। আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?
ছেলেটা বলে, আমার বাবার নাম রেজাউল করিম দিনার।
সুপ্তির ভেতরটা কেমন অদ্ভুত এক অনূভুতি জেগে ওঠে। আগে কখনও এমন অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়নি তার। দিনারের দিকে তাকিয়ে আছে সুপ্তি। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

দিনার বলে, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। যদি আপনি চান, তাহলে চা খেতে খেতেও বলতে পারি।
সুপ্তি নিজের ভেতরটা গোপন করে শান্ত গলায় বলে, ভেতরে এসো।

সুপ্তির ড্রইংরুমে বসে আছে রফিক। টি-টেবিলে বিস্কিট আর ঘরে বানানো পুডিং। পুডিংয়ের প্লেটটা রফিকের কপালের উপর জমে থাকা ঘামের মতো ঘেমে আছে। বুঝাই যাচ্ছে ফ্রিজ খুলে বের করে আনা। সুপ্তি প্রবেশ করে চায়ের কাপ নিয়ে। সুপ্তি বসতে বসতে বললো, বাবার মতো তোমার কপালেও ঘাম জমে। তারপর নীরবে বসে থাকে দুজনেই।

রফিক বলে, কপালে ঘাম জমে থাকার মতো ছোট বিষয়টিও মনে আছে আপনার?
সুপ্তি হাল্কা হেসে বলে, হ্যাঁ। তুমি তোমার বাবার মতোই হয়েছো। যুবক বয়সে তোমার বাবা তোমার মতোই ছিল।

রফিক বলে বসে, বাবা আপনার স্মৃতিতে ভালোভাবেই আছে, তা নাহলে আপনি আমাকে প্রথম দেখেই চমকে যেতেন না।

সুপ্তি অপ্রস্তুত হয়ে যায় এই কথায়। সামলে নেয় পরমুহূর্তেই সুপ্তি বলে, তুমি কি ভাবছো জানি না, তবে তোমার বাবার প্রতি ক্ষোভ না থাকলেও তিক্ততা রয়েই গেছে এখনো।
রফিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে এখন আপনার রাগ কিংবা ঘৃণার ঊর্ধ্বে।
সুপ্তি অবাক হয়। জানা ছিল না তার দিনারের মৃত্যুর সংবাদ। জানার কথাও না।

রফিক বলতে থাকে, জেল থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরে ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতো বাবা। মা ভাবতো, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। সবকিছু সব সময় ঠিক হয় না। জেলের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে, তিন দিন পর আত্মহত্যা করে বসে বাবা। তখন আমার বয়স আড়াই বছর। এরপর থেকে মা-ই আমাকে বড় করেন। এই অপমৃত্যুর জন্য মা আজীবন আপনাকেই দায়ী করে গেছেন। আজীবন বাবাকে ভালোবেসে গেছেন মা। আমার মা খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ। কখনো রাগ করতে দেখিনি কিন্তু আমৃত্যু আপনাকে ঘৃণা করে গেছেন। আপনাকে কখনোই...

কথা শেষ করতে পারে না রফিক, পাশের ঘর থেকে সুপ্তির ফোন বাজে। সুপ্তি উঠে যায় ফোন ধরতে। ওপাশ থেকে বলে, হ্যালো সুপ্তি! তুমি কি বাসায় এসেছো? সুপ্তি স্বামীর কথার উত্তর দেয়, হ্যাঁ আধাঘণ্টা হলো। ওপাশ থেকে বলে, আমার আসতে আরও সময় লাগবে। মগবাজারে আটকে আছি জ্যামে। সুপ্তি অবাক হয়। উত্তরা থেকে মিরপুর আসতে মগবাজার পেলে কোথায়? ওপাশ থেকে বলে, মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। আজ আমাদের ম্যারেজ ডে, এই কথাটা ভুলে যাবে জানতাম। মগবাজারে একটা জুয়েলারি দোকানে এসেছি। তোমার জন্য একটা গয়নার অর্ডার করেছিলাম সেটা ডেলিভারি নিতে। সারপ্রাইজ দিবো বলে আগে বলিনি।

সুপ্তি বলে, ও আচ্ছা।
ওপাশ থেকে বলে, ও আচ্ছা মানে! কি হয়েছে সুপ্তি?
সুপ্তি বলে, তেমন কিছু না। বাসায় এসো তারপর বলছি।

কথা শেষ করেই ড্রইংরুমে এসে বসে। রফিকের চা এর কাপ যেভাবে দিয়েছিলো সেভাবেই আছে। সুপ্তি তার নিজের চায়ের কাপটায় চুমুক দিতে দিতে বলে, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

রফিক বলে, হ্যাঁ। নিচ্ছি। কিন্তু নেয় না।
রুমের ভেতর পিনপতন নীরবতা। চা শেষ করে টেবিলে কাপটা রাখতে রাখতে সুপ্তি বলে, তুমি তো চা টা খেলে না। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আবার গরম করে দেই...

সুপ্তির কথা শেষ না হতেই রফিক উঠে পড়ে, আমি এখন যাব।
এই কথা বলেই রফিক দরজার দিকে যেতে থাকে। সুপ্তির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্যও অপেক্ষা করে না। রফিক নিজেই দরজা খুলে বের হয়ে সিঁড়ির অর্ধেক নেমে আসে। সুপ্তিও তার পেছন পেছন দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়। রফিককে বলে, তুমি কেন এসেছিলে আমার কাছে?

রফিক দাঁড়িয়ে তার বাবার মতো শান্ত ভংগিমায় সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলে, ত্রিশ বছর আমার বাবার জন্য যে তিক্ততা জমিয়েছেন তা আপনার চায়ের কাপে মিশিয়ে দিতে.... সুপ্তি ভুরু কুঁচকে কথার অর্থটা বুঝতে চেষ্টা করে। মুহূর্তেই অনুভব করে, মুখে লেগে থাকা চায়ের তিক্ত স্বাদ। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাটিতে ঢলে পড়ে সুপ্তি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, এ তুমি কি করলে রফিক! তার ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে রফিকের অবয়ব। সুপ্তির কাছে মনে হয়, দিনার চলে যাচ্ছে তার চোখের সামনে থেকে। সেই যুবক বয়সের দিনার।