পাঠকের সঙ্গে জাকির তালুকদার

পাঠকের সঙ্গে জাকির তালুকদার

বই তাদের কাছে বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০

ভাই, আপনার সবগুলো বই কিনতে চাই। কিন্তু টাকা তো বেশি নাই। তাই একটা কিনলাম, দুইটা কিনলাম। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ব্রাক্ষ্ণণবাড়িয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, জয়পুরহাট, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, গাইবান্ধা, রংপুর থেকে মেলায় আসা পাঠকদের প্রায় সবারই একই রকম কথা।

আজ গাজীপুরের একজন পাঠক দুইটা বই কিনেছেন। বললেন, তিনি মেলায় ঢুকেছিলেন পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে। কিন্তু পকেটমার হয়েছে। তবু দুইটি বই কিনেছেন। আমি কুণ্ঠিতভাবে জিগ্যেস করলাম, আপনার বাড়ি ফেরার টাকা আছে তো? তিনি বললেন, আছে।
এরা হচ্ছেন আমার পাঠক।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তারা আছেন। সবাইকে আমি দেখিনি। সম্ভবও নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি তারা কারা। তারা হচ্ছেন সেইসব পাঠক, যারা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ, অসুস্থ সমাজে বাস করেও নিজেরা সৎ জীবন যাপন করার চেষ্টা করেন আপ্রাণ, তাই তাদের হাতে অতিরিক্ত টাকা জমা থাকে না। বই কিনতে হয় অনেক হিসাব করে। তারপরেও হয়তো বই কেনার কারণে টান পড়ে বাড়ির প্রতিদিনের বাজার-খরচে, হয়তো সন্তানের ট্যুইশন ফি-তে, পরিবারের কারো সখ পূরণের স্বপ্নে। তবু তারা বই কেনেন। কারণ বই তাদের কাছে বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান। যে বইতে সমাজের এবং জীবনের চিত্র উঠে আসে শিল্পিতভাবে, সেইসব বই তারা কেনেন। আমার বইকেও সেই তালিকাতে স্থান দিয়েছেন তারা। আমি কৃতজ্ঞ। এই ক্রেতাদের একটি বিশেষ মনোভঙ্গি আছে। তারা নিজেরা বইটা কিনে শুধু নিজেরাই পড়ে ক্ষান্ত হন না। ভালো লাগলে সেই বই পড়াতে চেষ্টা করেন কাছের মানুষদের, বন্ধুদের, সমচিন্তার মানুষদের। এইভাবে আমার বইয়ের একটি কপি বিক্রি হলেও সেটির পাঠক হয়ে যান একাধিক। এই ক্রেতারা বই শোকেসে সাজিয়ে নিজেকে বিদ্বান প্রমাণ করার চেষ্টা করেন না।

সারাদেশের লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা আমার বইয়ের পাঠক এবং স্বেচ্ছা-প্রচারক। একসময় প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ছিল ভালো বইয়ের প্রধান ক্রেতা। এখন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির ধারাটি খুব ক্ষীণ। তবু সেই ধারার ছেলেমেয়েরা আমার বইয়ের ক্রেতা। তারা ট্যুইশনির টাকায় বই কেনে, বাসভাড়া এবং খাওয়ার খরচ বাচিয়ে বই কেনে, মেসের ভাড়ার টাকা বাকি রেখে বই কেনে। বড় ছাত্র সংগঠনটির মধ্যকার প্রগতিশীল এবং পড়ুয়া অংশটিও আমার বই সম্মানের সাথেই পাঠ করে।

একসময় বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, এখন তারা রাজনীতি থেকে বিযুক্ত, কিন্তু ভালো বইয়ের সন্ধান করে ফেরেন, তারাও পাঠ্যতালিকায় আমার বইকে স্থান দিয়েছেন। নারী পাঠক সংখ্যার দিক থেকেও আমি ভাগ্যবান। পাঠ প্রতিক্রিয়া থেকে জানতে পারি, পুরুষ পাঠকদের প্রায় সমান সমান আমার নারী পাঠক। আমার ডাক্তার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন; কিন্তু বই তেমন পড়েন বলে মনে হয় না। তবে একটি অংশ তো অবশ্যই পড়েন।

প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ, সেনাবাহিনীর অনেকেই আমার বইয়ের পাঠক। কেউ হয়তো একটি পড়েছেন, কেউ একাধিক। মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ বই পড়ে আমার লেখা সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য করেছেন। অন্যদের মাধ্যমে সেই প্রশংসা শুনেছি আমি। তবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে আমার পাঠক খুব কম। গ্ল্যামার জগৎ এবং সেলিব্রেটিদের মধ্যে আমার কোনো পাঠক নেই। কোনো লেখক পরিচিতিও নেই।

আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পড়ছেন আমার বই। বইমেলাতে এমন কিছু ক্রেতার সাথে কথা হয়। আমাকে সঙ্গী-পরিবেষ্টিত দেখে তারা একটু কুণ্ঠিত থাকেন। কুণ্ঠার সাথেই কেনা বইটা এগিয়ে দেন অটোগ্রাফের জন্য। আমি তাদের কাছে যাই। জিগ্যেস করি আমার বই এটাই তার প্রথম সংগ্রহ কি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আনন্দিত হয়ে শুনি তারা আমার আরো কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন, যেগুলো তারা পড়েছেন।

যদিও প্রকাশকরা অধিকাংশ বই প্রকাশ করেন মেলাকে সামনে রেখে। কিন্তু আমি তো বইমেলাকেন্দ্রিক লেখক নই। সারা বছর লেখালেখি করি। সুখের বিষয় হচ্ছে, আমার পাঠকরাও কেবল বইমেলাকেন্দ্রিক নন। তারাও সবসময়ের পাঠক। আমার সকল পাঠকের জন্য শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক