বাংলা সাহিত্য এবং সাম্প্রদায়িকতার উৎস সন্ধান

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২৩

সন্দেহ নেই, ব্রিটিশ শাসনে বাংলা সাহিত্য অনেক দ্রুত বিকশিত হয়েছিল। বহু সৃষ্টিশীল মানুষ ঊনিশ শতকে এ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার দ্বারা নতুন পরিমণ্ডল তৈরি করেছিলেন। ইংরেজদের সহযোগিতায় বসানো ছাপাখানা ছিল তার একটি অন্যতম কারণ। বলতে গেলে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ঊনিশ শতকের বিশের দশক থেকেই সাহিত্য নতুন পথে চলতে আরম্ভ করে। বাংলা ভাষা নতুন রূপ লাভ করে। নাটক কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস প্রহসন পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি মিলিয়ে এক মহীরুহ কাণ্ড ঘটতে থাকে। সেসব নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ঊনিশ শতকের মধ্য গগন থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধের উপন্যাস নিয়ে কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছা হলো।

 

বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর মানিক কত বড়মাপের উপন্যাসিক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সবার রচনা পাঠ করে আমরা মুগ্ধ। প্রথম দিকে মুসলমানদের কাছ থেকে উপন্যাস পাওয়া যায়নি। যারা উপন্যাস লিখেছেন সবাই বলতে গেলে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। বাকি সব সাহিত্য থেকে উপন্যাসের পার্থক্য হলো, যখনকার পটভূমিতে উপন্যাস লেখা হবে সেখানে সেই সমাজের সমাজচিত্র ফুটে উঠতে হবে। বাংলা উপন্যাসের বেলায় প্রশ্নটা সেখানেই, সেখানে আমরা সত্যিকারের সমাজচিত্র পাই কিনা। সমাজের সকল পেশা শ্রেণির মানুষকে সাহিত্যে পাই কিনা।

 

বাংলা ভাষায় যখন উপন্যাস লেখা শুরু হয়, তখন বাংলার মানুষ ধর্মীয়ভাবে প্রায় অর্ধেক মুসলমান। বিশেষ করে এরা ছিলেন বেশির ভাগ কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বাংলার উপন্যাসগুলো প্রায় গ্রামের পটভূমিতে রচিত। মুসলমান কৃষকরা গ্রামেই থাকতেন। কিন্তু প্রথম একশো বছরের বাংলা উপন্যাসে সেই মুসলমানদের কি খুঁজে পাওয়া যায়? বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস হিসেবে যা লিখেছেন সেগুলোকে আমি উপন্যাস বলে মানতেই রাজি না। বলা যেতে পারে বড় গল্প, তিনি সেখানে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দর্শন প্রচার করেছেন যা এখন বিজেপির মূলমন্ত্র। যদি বঙ্কিমের সে লেখাগুলোকে উপন্যাস ধরে নেই, সেখানে বাংলার মুসলমানদের চিত্র কি?

 

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে মুসলমানরা কীভাবে কতটুকু স্থান পেয়েছে? বঙ্কিমচন্দ্র শেষদিকের সাহিত্যচর্চায় আনন্দমঠ থেকে আরম্ভ করে যতগুলো রচনায় মুসলমানদের প্রসঙ্গ এনেছেন, তা এনেছেন খুব খারাপভাবে। খুব বিকৃত ইতিহাস তা। ব্রিটিশ শাসনে ঊনিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলার সাহিত্য এবং ইতিহাস চর্চার বড় দিকটাই হলো হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকলে সেই পথেই হেঁটেছিলেন। বাংলা উপন্যাস পর্যালোচনা করলো সেটাই নানাভাবে ধরা পড়বে। বাংলা উপন্যাসের ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার একটা ইতিহাস বা পথ পরিক্রমা আছে।

 

বাংলার ভদ্রলোক বাবুদের হাতেই ব্রিটিশ শাসনে অভিজাত সাহিত্যধারা গড়ে ওঠে। সে সাহিত্যচর্চায় মুসলমান নেই বললেই চলে। মুসলমানরা সাহিত্যচর্চা করেছেন, কিন্তু অভিজাত ঘরানা থেকে তারা ছিলেন বহু দূরে। শুধু মুসলমানরা নন, নিম্নবর্গের হিন্দুরা পর্যন্ত বাবুদের অভিজাত সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাননি। মুসলমানরা সেখানে সার্বিকভাবে বাবুদের ইতিবাচক চিন্তা চেতনা আলোচনার বাইরে থেকেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শলিপি বা অন্যান্য পাঠ্যপুস্তক পড়লে বাংলায় মুসলমান বলে অর্ধেক জনগোষ্ঠী যে ছিল, তার উল্লেখই পাওয়া যাবে না। যদি বাংলার সেসময়ের সাহিত্য জড়ো করা যায়, সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলায় যে মুসলমান জনগোষ্ঠী বলে কিছু ছিল, বুঝবার উপায় নেই।

 

বলতে গেলে বাবুদের সৃষ্ট সাহিত্য মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নাই করে দিয়েছিল। মুসলমান প্রসঙ্গ যখন এসেছে, মুসলিম শাসকদের কথাই এসেছে খুব নেতিবাচকভাবে বা ঘৃণার সঙ্গে। তৎকালীন সাহিত্যে তার বহু উদাহরণ মিলবে। সেখানে হিন্দু শাসকরা ঋষি সমতুল্য আর মুসলমান শাসকরা শুধুই অত্যাচারী। ধরা যাক সম্রাট অশোক বহু ভ্রাতাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসে। তবুও সে ঋষি তুল্য তাদের রচনায়। ভিন্ন দিকে আওরঙ্গজেব তিন ভাইকে হত্যা করার জন্য শুধুই পাষণ্ড। কিন্তু অশোকা সম্পর্কে বলা হয় শত ভাইকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছে, তবুও সে পাষণ্ড নয়। বাবু সাহিত্যে হিন্দু মুসলমানরা কীভাবে চিহ্নিত হয়েছে সেটা এখন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।

 

সন্দেহ নেই, বাবুদের অনেকের রচনার মান খুব উচ্চ ধারার। বাংলা সাহিত্যের একটা শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে বাবুদের হাতে। কিন্তু বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে মুসলমান জনগোষ্ঠী অবহেলিত ছিল তাদের কাছে, কখনো তারা নিজেরাই ঘৃণা ছড়িয়েছে। ধরা যাক, তিতুমীরের মতো একজন কৃষক নেতার চরিত্র তারা এঁকেছে খুবই বিকৃত করে। সংবাদপত্রে তিতুমীর সম্পর্কে মিথ্যাচার ভরা, ভিন্ন দিকে ইংরেজ শাসক আর জমিদারদের প্রশংসা সবরকম চাটুকারিতাকে ছাড়িয়ে গেছে। যদি সেই সংবাদগুলোই মনোযোগের সঙ্গে এখন বিশ্লেষণ করা হয়, দেখা যাবে যা তারা নিন্দা হিসেবে দেখিয়েছে, সেটাই আসলে সাধারণ মানুষের কাছে আজ মনে হবে তিতুমীরের বীরত্ব।

 

যাদের কথা বলছি, এরাই ভারতীয় মহাবিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কলম ধরে ইংরেজ শাসকদের প্রশংসা করেছেন। ঝাঁসির রাণীকে নিয়ে নোংরা ভাষায় কবিতা লিখেছেন স্বয়ং ঈশ্বর গুপ্ত। মহাবিদ্রোহের কালে বাবুদের বড় অংশটাই ছিল একদিকে ইংরেজদের পদলেহনকারী, অন্য দিকে মুসলিম বিদ্বেষী। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম সেখানে মধুসূদন দত্ত। মধুসূদন সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন ইংরেজি ভাষায়। ভারতের নারীরা যখন হিন্দুধর্মের শৃঙ্খলে বন্দী, তখন নারীর স্বাধীনতা এবং নারীর স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী মধুসূদন সুলতানা রাজিয়ার মতো ভারতের ইতিহাসে একজন নারীকে শাসকের ভূমিকায় দেখে খুব উৎফুল্ল হয়েছিলেন। তিনি সুলতানা রাজিয়াকে প্রধান করে বাংলাভাষায় একটা নাটক লেখার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বাংলার নাট্য জগতের হিন্দুত্ববাদী মহারথীরা তা মঞ্চস্থ করতে রাজি না হলে, তিনি নাটকটি লিখতে আর উৎসাহ পাননি।

 

মধুসূদনের যুগ পার হয়ে যখন বঙ্কিমের যুগ এবং আরো পরে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের যুগ এলো, তখন হিন্দুত্ববাদী ধারণা হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণায় রূপ পেল বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে, রবীন্দ্রনাথের পিতা, কাকা আর বড় ভাইদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মুধুসূদন দত্তের বন্ধু রাজনারায়ণ সেখানে বিরাট ভূমিকা পালন করেন তার কাজে আর নানা রচনার মাধ্যমে। বিবেকানন্দ সর্বধর্মের ভেকধারী সেজে হিন্দুত্ববাদী প্রচারে মাতিয়ে তুললেন ভারতের বিরাট এক জনগোষ্ঠীকে। বিবেকনন্দ প্রথমে তা ছিলেন না। বঙ্কিম আর রাজনারায়ণের প্রভাবে তিনি মনুর বিধান প্রচার করলেন একদিকে, ভিন্ন দিকে মাঝেমধ্যে ধর্মের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালেন। বিবেকানন্দ খুব মেধাবী মানুষ ছিলেন সন্দেহ নেই, তাঁর লেখা পড়লে তাঁর মেধা দেখে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু বাংলার সব মেধাবী ব্রাহ্মণ সন্তানের মতো তিনিও হিন্দুত্বের পক্ষে প্রচার চালালেন। স্পষ্টই বললেন হিন্দুধর্মই বিশ্বের শ্রেষ্ঠধর্ম।

 

রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের এ ধরনের কাজ কতটা পছন্দ করেছিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন। দুজনের সম্পর্ক আর ভালো ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দকে এড়িয়ে চলতেন। রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের জীবিতাবস্থায় তার পক্ষে একটা কথাও লেখেননি। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এটা একটা ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বঙ্গভঙ্গের কিছুদিন পরেই পরিবারের মতাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি হিন্দুত্ববাদী ধারণা থেকে সরে আসতে থাকেন আর মুসলমানদের পক্ষে কলম ধরেন স্বদেশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। কালান্তরে আছে তার সেসব প্রবন্ধ। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সমালোচনা করে লিখলেন ঘরেবাইরে উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখন আর একজনকে পাওয়া গেল, তিনি হলেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। যিনি রাখঢাক না করে ব্রিটিশদের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। সরাসরি আক্রমণ করলেন ব্রিটিশ আর ইউরোপীয় শক্তিকে।

 

বহুদিন ধরে নবাব সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছিলো তিনিই প্রথম তার বিপক্ষে দাঁড়ালেন। সিরাজদৌলা আর মীরকাশিমকে খলনায়ক থেকে রাতারাতি নায়ক বানিয়ে দিলেন। মুসলমান শাসকদের সম্পর্কে কিছু মানুষের অতিরিক্ত ভুল ধারণা তখন থেকে পাল্টাতে আরম্ভ করে। কিন্তু সার্বিকভাবে অবস্থা পাল্টায় না।

 

পরবর্তী বাবুদের সাহিত্যেও মুসলমানদের প্রতি তেমন মনোযোগ নেই। মানুষ কার প্রতি মনোযোগ দেয় না? যাকে সে অবহেলা করে, যাকে নীচু চোখে দেখে। ফলে রবীন্দ্রনাথ আর অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র পর যারা উপন্যাস লিখেছেন তাঁদের কাছে মুসলমানরা উপেক্ষিত থেকেছে, মানিক সেখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শঙ্কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ প্রমুখ সবার ক্ষেত্রে একই কথা বলা যায়। বাংলায় যে কখনো মুসলমান ছিল, বা বাংলার গ্রামে যে মুসলমান আছে কিংবা অবিভক্ত বাংলার অর্ধেক মানুষ মুসলমান তাদের উপন্যাস দেখে বুঝবার উপায় নেই। সুনীলের ‘সেই সময়’ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস। এখানে মুসলমানরা কতটুকু জায়গা পেয়েছে? পূর্ব বাংলার বিরাট সংখ্যক মুসলমান কৃষকরা স্থান পায়নি সেদিনের মহারথীদের সাহিত্যে যেমন, পরেও তেমন।

 

মুসলমানরা বাইরে থেকে আসা জনগোষ্ঠী নয়, এই মাটিরই মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে। বাবু সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের চোখে তারা অবহেলার পাত্র হয়ে থাকলো কেন? সারা বাংলার বাবু জমিদাররা কি তাদের সেবা নেননি? বাবু জমিদারদের সকল আয়ের প্রধান উৎস কারা ছিল? বাংলার নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমান কৃষকরাই। যাঁদের বাবুরা তাঁদের সাহিত্যে স্থান দেননি, তাঁদের কি হৃদয়ে স্থান দিয়াছিলেন? মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা কোথা থেকে শুরু হয়, হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম কোথা থেকে হয়েছে তা গত দুই শতকের বাংলা সাহিত্য পাঠ করলেই খুব টের পাওয়া যাবে।

 

বাংলার মুসলমানরা বিশেষ করে বিরাট সংখ্যক ভূমিপুত্র কৃষক বা নিম্নবর্গের মুসলমানরা উনিশ শতক পর্যন্ত না ছিল ধর্মীয়ভাবে কট্টর, না ছিল হিন্দু বিদ্বেষী না ছিল সাম্প্রদায়িক । ঠিক একইভাবে বিরাট সংখ্যক হিন্দু কৃষক বা নিম্নবর্গের হিন্দুরা না ছিল মুসলিম বিদ্বেষী, না ছিল সাম্প্রদায়িক। বরং নিম্নবর্গের হিন্দু আর নিম্নবর্গের মুসলমানরা ছিল পরস্পরের সত্যিকারের প্রতিবেশী। হিন্দু মুসলিম প্রশ্নগুলো সবার আগে সামনে আনে ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে দেয়ার জন্য যা মূঘল শাসকদের সময়ে ছিল না। ব্রিটিশদের সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্রিটিশ শাসকদের দালাল এবং মধ্যসত্ত্বভোগী বাবু সম্প্রদায় এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদাররা। ব্রিটিশ শাসকদের চেয়ে আরো এগিয়ে গিয়ে তারা মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে তরুণদের বিভ্রান্ত করে, যার বড় উদাহরণ আনন্দমঠ উপন্যাসের জনপ্রিয়তা।

 

খুব স্পষ্টভাবে আনন্দমঠে বঙ্কিম মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার কথা বলেন। বঙ্কিমের মতে হিন্দু সমাজের তরুণদের প্রধান দায়িত্ব সেখানে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিটিশ শাসকরা কিন্তু এই উপন্যাস নিষিদ্ধ করেনি। হিন্দু শিক্ষিত সমাজ কিন্তু এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। বরং আনন্দমঠকে হিন্দু শিক্ষিত সমাজ আর শিক্ষিত তরুণরা ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে। বঙ্কিম মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিধান দিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যে, পরের জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম নিধনের কথা বলেননি। কিন্তু মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। বৃহত্তর সাধারণ হিন্দুরা কিন্তু তাদের সঙ্গে ছিল না। হিন্দুত্ববাদী সেদিনকার তরুণ শিক্ষিতরা বঙ্কিম এবং অন্য বাবুদের রচিত সাহিত্যের প্রভাবে নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমান দুপক্ষকে বাদ দিয়ে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যা আজকের বিজেপির চিন্তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।

 

রবীন্দ্রনাথসহ কয়েকজন সেদিন তাদের সাহিত্য দিয়ে সেধারার মধ্যে খানিকটা ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সেখানে সাফল্য লাভের একটা বড় দিক ছিল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া। স্বদেশি আন্দোলনের সমালোচনা করে এবং মুসলমান কৃষকদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের রচনা বাবুরা সবাই ভালোভাবে নেননি। অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে চলছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ায় তাঁদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পর যারা তাকে সম্বর্ধনা দিতে যান তাদের মধ্যে তারাও ছিলেন। দলিলপত্রে এসব তথ্য পাওয়া যাবে।

 

সাহিত্য কী করে সাম্প্রদায়িকতার উৎস হয়ে উঠতে পারে এ নিয়ে খানিকটা কথা বলা গেল। যখন বাবুদের সাহিত্য মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ায়, তখন মুসলমানরা কি সেই বাবুদের ভালো মনে গ্রহণ করবে? ভুল বুঝাবুঝি বা হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ বা ভাঙনের শুরু সেখান থেকে। ফলে দায়টা প্রধানত কাদের? শিক্ষিত আর অগ্রণীদের সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হয় সঠিক সমাজ গঠনে। বাবুরাই বাংলায় সবক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন। সেই এগিয়ে থাকা বাবুরা কি সঠিকভাবে তাদের পালন করেছিলেন? বিশ শতকের শুরুতে আনন্দমঠকে কেন্দ্র করে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে হিন্দু অভিজাতরা, মুসলমানদের তখনকার মনোবেদনা কি কখনো উপলব্ধি করার চেষ্টা করা হয়েছে? কখনো কি সেই ঘটনার খেসারত দিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন কেউ। বরং সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির দায়ভার মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বার বার। পরে বিশ শতকের সাহিত্যে কি হিন্দু মুসলিম মিলনের গান গেয়েছেন কখনো বাবুরা? মুসলমানরা কি যথাযোগ্য স্থান পেয়েছেন তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে?

 

ব্যতিক্রম আছে, ব্যতিক্রম নিয়ে আলোচনা নয়। ফলে বিপরীতে বহু পরে যখন মুসলমান শিক্ষিতরা সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করে, তখন অভিজাত মুসলিমদের সাহিত্য ঠিক একই পথে এগিয়েছে। বৃহত্তর হিন্দু সমাজের দুঃখ বেদনা, তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের কৃষ্টি মুসলমান রচয়িতাদের সাহিত্যেও স্থান পায়নি।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ