বাঙালির নববর্ষ

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৩, ২০১৯

একদল আছেন, যারা বৈশাখ এলেই প্রশ্ন তোলেন, পান্তাভাত খাওয়া কি বাংলা নববর্ষের সংস্কৃতি? হাজার বছরে বাঙালি কি নববর্ষে পান্তা খেত? তাদের কাছে ব্যাপারটা এমন যে, পয়লা বৈশাখে পান্তা খাওয়া যেন অবৈধ কাজ, একটি পাপাচার, একটি হারাম কাজ। পান্তা খেলেই বাঙালিত্ব থেকে বহিষ্কার হয়ে যাবে। আচ্ছা, পান্তা খেলে সমস্যাটা কোথায়? হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তা খাওয়া থাকতেই হবে, এমন কোনো শর্ত আছে? শর্তটা কে দিয়েছে? সংস্কৃতির সব উপাদান কি হাজার বছরের গর্ভে খুঁজতে হবে? মোটেই না। সংস্কৃতি কোনো খনি নয় যে, সেই খনি থেকে সংস্কৃতির উপাদানগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে হবে। বের করে চর্চা করতে হবে, লালন করতে হবে, পালন করতে হবে।

বর্তমান বঙ্গাব্দও তো বাঙালি সংস্কৃতিতে ছিল না। বঙ্গাব্দের বয়স তো মাত্র সাড়ে তিন শ বছর। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায় করা হতো শস্যের বিনিময়ে। নতুন শস্য ঘরে উঠলে রাজকর্মচারীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাজনা আদায় করত। তারা যেত হিজরি সনের একটি নির্দিষ্ট তারিখে। বিপত্তিটা বাঁধল সেখানেই। প্রতি বছর হিজরি সন সৌরবর্ষ থেকে এগারো দিন বেড়ে যায়। এ ক’দিনের ব্যবধানে অনেক কৃষকের ফসল ঘরে উঠত না। তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হতো খাজনা আদায়কারীদের। এতে খাজনা আদায়ে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। চিন্তিত হয়ে পড়লেন সম্রাট। কী করা যায়? ডাকলেন ইরানের সিরাজ নগরীর জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ্উল্লাহ্ সিরাজীকে। জ্যোতির্বিদ সিরাজী ৯৬৩ হিজরি সনের পাশাপাশি প্রণয়ন করলেন একটি সৌর সন, ৯৬৩ বঙ্গাব্দ। খ্রিস্টাব্দ হিসেবে হিজরি সনের ভিত্তি ৬২২ অর্থাৎ ইসলামের নবী যেদিন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। আর বঙ্গাব্দের ভিত্তি ধরা হলো ৬২৮। তাই বলে হিজরি ও বঙ্গাব্দের মধ্যে তফাৎ যে নেই তা নয়। প্রতি ৩৩ বছরে হিজরি সাল এক বছর করে বঙ্গাব্দের চেয়ে এগিয়ে আসে আর বঙ্গাব্দ পিছিয়ে যায় এক বছর। সুতরাং হিজরি জঠরজাত হলেও চান্দ্র ও সৌর সনের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে।

আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বয়স তো একশো বছরও হয়নি। স্বৈরশাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতিতে ছিল না বলে এটিকে আমরা পরিহার করব? মোটেই না। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সংযোজন নব্বইয়ের দশকে। তখন ইলিশ খাওয়াটা দোষের কিছু ছিল না। কারণ ইলিশের চাহিদা তখন বর্তমানের মতো এত ব্যাপক ছিল না। জনসংখ্যাও ছিল কম। এখন জনসংখ্যা বেড়েছে। ইলিশের চাহিদাও বেড়েছে। তাই চাহিদা পুরণের জন্য বেশি বেশি ইলিশ প্রয়োজন। বৈশাখ ইলিশের প্রজনন মৌসুম। বৈশাখে ইলিশ ধরলে প্রজনন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জাতীয় স্বার্থে তাই আমরা ইলিশ খাব না।

কিন্তু পান্তায় সমস্যা কোথায়? পান্তা খেলে কি সংস্কৃতির অপমান হবে? বাঙালিত্বের অপমান হবে? গ্রামবাংলার মানুষকে উপহাস করা হবে? মোটেই না। সংস্কৃতির ভাঙা-গড়া আছে, উত্থান-পতন আছে, জন্ম-পুনর্জন্ম আছে। সংস্কৃতি নদীর মতো। সে গ্রহণ যেমন করে, তেমনি বর্জনও করে। পান্তাকে বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। পয়লা বৈশাখে শহুরে নাগরিকরা পান্তা খায়। পান্তা খাওয়াটা সংস্কৃতির নবজন্ম। নবজাগরণ। সংস্কৃতির নতুন সংযোজিত উপাদান। তাই পয়লা বৈশাখে পান্তা খাব। নানা রকমের ভর্তা দিয়ে পেট ভরে পান্তা খাব। পান্তার প্রদর্শন করব। পান্তার বহর দেখেই বাঙালি বিরোধীরা যেন ঘাবড়ে যায়। কারণ যা বাঙলি সংস্কৃতির চিহ্নবাহী, তাতেই তাদের ভয়।

অপরদিকে, আরেকটি দল আছে, যারা বলে থাকেন, নববর্ষ তো এখন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে গেছে। এ নিয়ে তাঁদের হা-হুতাশের সীমা নেই। এ নিয়ে তাঁরা পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করেন। কেন রে ভাই? কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে বর্ষবরণের উৎসব হলে সমস্যাটা কোথায়? তাতে কি বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গহানি ঘটে? সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যায়? মোটেই না। বাঙালি সংস্কৃতি এত ঠুনকো নয় যে কথায় কথায় ধ্বংস হয়ে যাবে, এর অপমান হবে, এর অঙ্গহানি ঘটে যাবে। যে যার মতো করে নববর্ষ উৎসব পালন করুক, আয়োজন করুক, স্পন্সর করুক, উদযাপন করুক । তাতে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে করি না। ব্যক্তি এবং সরকারি, বেসরকারি, কর্পোরেট...সব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগ, সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বরং বর্ষবরণ উৎসব আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে, আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে। এর সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ খুব প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশে বাস করে নানা সম্প্রদায় ও নানা জাতির মানুষ। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা উৎসব। নেই কোনো সার্বজনীন উৎসব, যেখানে মিলিত হবে সব সম্প্রদায় ও সব জাতির মানুষ। নববর্ষ এমন এক উৎসব, যেখানে অংশ নেয় বাংলাদেশে বাসরত সব সম্প্রদায় ও জাতির মানুষ। এটিই আমাদের সত্যিকারের সার্বজনীন উৎসব।

এই করণেই বর্ষবরণ উৎসবকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য বাঙালি-বিরোধীরা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পয়লা বৈশাখকে হারাম ঘোষণা দিয়ে অসহিষ্ণু উগ্র ধর্মান্ধরা গলা ফাটিয়ে ফেলছে। তাদের কথা বলে লাভ নেই। তারা তো চিরকালের বাঙালি বিরোধী। তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের খোঁজটা পর্যন্ত রাখে না। বঙ্গাব্দ প্রচলন করেছিলেন সম্রাট আকবর। তিনিও মুসলমান সম্প্রদায়ের। পশ্চাদপদ ধর্মান্ধরা হয়ত ইতিহাসটা জানে না। জানলে তারাও বাংলা নববর্ষ উদযাপন করত। কিংবা জেনেও না জানার ভান করে। তারা হয়ত শত্রুরাষ্ট্রের এজেন্ট। তারা হয়ত শত্রুরাষ্ট্রের পারপাস সার্ভ করে। কিংবা পয়লা বৈশাখের উৎসবে তাদের কোনো ব্যবসা হয় না বলে তারা বিরোধিতা করে। কারণ পয়লা বৈশাখ একটি অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসব। ব্যবসা নেই তো বিরোধিতা তো করবেই।

আমরা তাদের বিরোধিতা বা হুংকারকে পাত্তা দেব না। আমরা পান্তা খাবই, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবই, মনের আনন্দে উৎসব করবই, নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করবই। আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্যই জারি রাখতে হবে এই উৎসব। এবং আমরা জারি রাখবই।

সবাইকে চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

টুকে রাখা কথামালা
৩০ চৈত্র, ১৪২৫