নুরুল ইসলাম বাবুল

নুরুল ইসলাম বাবুল

বাবুল সাহেব ছিলেন একজন `র ক্যারেক্টার`

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২০

মর্মান্তিক এ খবরটা যখন পেলাম তখন আমি দোহারে। আগেরদিনও সন্ধ্যার আড্ডায় আমার এক স্কুল বন্ধু বলছিল, দেখিস বাবুল সাহেব দোহারের এমপি হবে একদিন। আমি হেসে উল্টো জানতে চাইলাম, বাবুল সাহেব এমপি হতে চেয়েছেন কোনোদিন? যদি ওই পরিবারের কেউ এমপি হন তবে সেই সম্ভাবনা রয়েছে তার ছেলে শামীম ইসলাম কিংবা মনিকা আপার। আমার পছন্দ মনিকা আপাকে।

জানি, এই লেখাটা পড়ার পর অনেকেই হয়তো আমাকে দালাল ভাববেন। তবে এতে আমার তেমন কিছুই এসে যায় না। আমি যা জানি অন্তত সেটুকুকে সত্য হিসেবে মানার বয়স আমার হয়েছে। বাবুল সাহেবের মধ্যে আমার বাবার মতো একটা একগুঁয়ে চরিত্র দেখেছি। প্রচলিত ভাষায় বলতে গেলে তিনি একটা `র ক্যারেক্টার` নিঃসন্দেহে খাঁটি মানুষ। নিজে যা নিঃসঙ্কোচে তা প্রকাশে ওই মানুষটার মাঝে কোনো ভনিতা দেখিনি, ছল দেখিনি। একারণেই তিনি আমার কাছে স্মার্ট মানুষ।

বাবুল সাহেবের পরিবারের একজন মানুষের সাথে আমার শেয়ারিং আছে কিছুটা। সেই সূত্রে আমি জানি, তিনি কতটা মানবিক মানুষ। যমুনা টেলিভিশন যখন অনিশ্চিত হয়ে গেল সে সময়টায় আমি খুব হতাশায় ভুগতাম। নিয়মিত বেতন নিচ্ছি অথচ কোনো কাজ করতে হচ্ছে না। দিনের পর দিন এ অচলাবস্থা এক ধরনের অন্তর্গ্লানি তৈরি করছিল। তিনি সে সময় যেভাবে পেছন থেকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের দৃঢ়তার শিক্ষা আমাকে দিয়েছিলেন তা কোনোদিন ভোলার নয়।

একদিন বললেন, হতাশ না হয়ে এই অলস সময়টায় নিজেকে প্রস্তুত করো যেন আগামীতে আরো ভালো ভালো কাজের চমক দর্শকদের দেয়া যায়। মনে রেখো, যমুনা টিভি আমাদের স্বপ্ন, চিরকাল এভাবে তোমাদেরকে বসে থাকতে হবে না।
অনেকে বাবুল সাহেবকে ভূমিদস্যু বলেন, তাই না?
একটা গল্প শোনেন তাহলে। ২০০৯ সালের কোনো এক বিকেলে যমুনা ফিউচার পার্কের নির্মাণ কাজ তখনো চলছে। আমি কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ফিউচার পার্কের উল্টোদিকের রাস্তা অতিক্রম করে ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে সিগারেট খাচ্ছি। ওই দোকানে পাতা ছোট্ট বেঞ্চিটায় তিনজন বসে আছি আর দুজন সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের তুমুল আড্ডা হচ্ছে। এমন সময় একজন প্রবীন মানুষ এগিয়ে এলেন। হাতে সৌখিন লাঠি, সাদা পাকা লম্বা দাড়ি। দেখে তাকে এলাকার একজন সম্মানিত মানুষই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের যেহেতু আড্ডা জমে গেছে সেহেতু তাকে দেখে আমরা আর বসতে অনুরোধ করিনি। বরং কিছুটা বিব্রতই হচ্ছিলাম। কারণ তিনি আমাদের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন আর আমরা সিগারেট না লুকিয়ে বরং সমানে টেনে যাচ্ছি। কোনোরকম আদব কায়দা না দেখিয়ে। তাছাড়া এ শহরে কে, কাকে গোণে আর আমরাতো তখন উঠতি সাংবাদিক। দ্বিগুণ বেতনে ডাক পেয়ে বাবুল সাহেবের টিভি প্রজেক্টের সারথি হয়েছি। ভাবসাবই আলাদা!

হঠাৎ ফুটপাত দিয়ে ঝাল মুড়িঅলা যাচ্ছিল। মুরব্বী ওই ঝাল মুড়িঅলাকে থামালেন এবং আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই মিয়ারা ঝাল মুড়ি খাইবানি? আমরা বললাম, না চাচা আপনি খান। তখন তিনি বললেন, ওই মিয়া আমার বয়স আছেনি ঝালমুড়ি খাওয়ার? এরপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে ঝালমুড়িঅলাকে দিয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আমরা অবাক হয়ে রইলাম এবং আস্তে করে চাঅলার কাছে জানতে চাইলাম লোকটা কে? চাঅলা জানালো, উনি এই এলাকার পুরনো বাসিন্দা। পরে লোকটা আমারও বাড়ি ঘরের খবর নিলেন এবং জানতে চাইলেন বাড়িতে খেজুর গাছ আছে কিনা? আমি বললাম, আছে। তিনি জানতে চাইলেন, কয়টা? আমি বললাম, ৫৭টা। তিনি বললেন, আমাদের বাড়িতে দুশো ৭০টা।।

এরপরও আমি পাত্তা দিচ্ছি না দেখে আবার জানতে চাইলেন, আম গাছ আছে? আমি এবার বাড়িয়ে বললাম, হ আছে ৮০/৯০টা। তিনি হেসে বললেন, এইবারও তো পারলা না, আমাদের বাড়িতে আমগাছ আছে সাড়ে চাইরশো। এরপর জানতে চাইলেন, কি করো তুমি? আমি কিছুটা ভাব নিয়ে বললাম, সাংবাদিক। তিনি জানতে চাইলেন, বাবুল সাহেবের এখানে নি? আমি বললাম, হ।

তিনি বললেন, বাবুল সাব এখনো রাস্তা দিয়া যাবার সময় আমারে দেখলে গাড়ি থামায়া নাইমা আসে, আমারে সালাম দেয়ার জন্য।
আমি এবার কিছুটা আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম, কেন?
মুরব্বি বললেন, বাবুল সাবরে আমি ১২ বিঘা জাগা দিছি।

ক’দিন আগেও ওই এলাকায় এক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে মিছিল হয়েছে `ভূমিদস্যু বাবুলের বিচার চাই` এমন স্লোগান দিয়ে। এসব নানা কারণে আমরা কিছুটা শঙ্কায় থাকি, এলাকাবাসীর সাথে যেন হঠাৎ কোনো সংঘর্ষ বেঁধে না যায়। সুতরাং আমি ভেতরের খবর নেয়ার ছলে কিছুটা খোঁচা দেয়ার ভঙ্গিতেই জানতে চাইলাম, টাকা পয়সা দিছে কিছু, না শুধু সালামই?

তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানালেন, সব টাকা ক্যাশ দিছে বরং বাজার দরের চাইতেও কাঠাপ্রতি দশ হাজার ট্যাকা বেশি দিছে।

বাবুল সাহেবের নানারকম রূঢ়তার গল্প শোনা যায়। তার সেসব রূঢ়তা নিয়ে একবার আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাংবাদিক শাহ আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এক শ্রমিকরে নাকি বাবুল সাহেব বিড়ি খেয়েছে বলে পেছন থেকে পিঠে এক লাত্থি দিয়ে গর্তে ফেলে দিয়েছে? তখন আলমগীর ভাই জানালেন, ওই শ্রমিকের পেটেতো লাত্থি দেন নাই বা কাজ ছাড়ায়ে দেন নাই তাই না? আমি বললাম, এটা জানা নাই। তিনি বললেন, শোনও, স্কোয়ার গ্রুপের এমডি একবার এক ফ্লোর ম্যানেজারকে সিগারেট খেতে দেখেছিল তারপর তখনই রুমে ডেকে নিয়ে ওই ম্যানেজারের আইডি কার্ড রেখে, ইউনিফর্ম খুলে বিদায় করে দিয়েছিল।

আমার বাবা বলতেন, দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা। বাবুল সাহেবকে আমি কোনোদিন মিষ্টি করে কথা বলতে দেখিনি। দোয়া করি, ওপারে ভালো থাকুন...

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী