বায়ু ও বায়ুর কয়েকটি ধর্ম

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২২

বায়ু আমরা দেখতে পাই না ঠিকই, তবে তার অস্তিত্ব সবসময় অনুভব করি। প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইছে। সেই দাপটে বড় বড় গাছ লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। ভেঙে পড়ছে টিনের ঘরবাড়ি। বায়ুর এই দাপট দেখে আমরা ভীত হয়ে উঠি। কখন না জানি কী ঘটে! আবার দ্যাখো, গরমের দিনের ঝিমধরা দুপুর। দরদর ঘাম ঝরছে গা বেয়ে। গাছপালার পাতাও নড়ছে না। হঠাৎ কোত্থেকে এক ঝলক ঝিরঝির বায়ু ছুটে এলো। নড়ে উঠল গাছের পাতা। ঘামে ভিজে ওঠা দেহে যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে গেল।

কাচ স্বচ্ছ পদার্থ। চোখের সামনে ঝকঝকে পরিষ্কার এক টুকরো কাচ নিয়ে সামনে তাকাও। মনেই হবে না যে, তোমার চোখের সামনে কাচ আছে। মনে হবে, বাগানের গাছপালা রোদের উজ্জ্বলতা তুমি সরাসরি দেখছ। কাচের চেয়েও স্বচ্ছ পদার্থ বায়ু। এ কারণে তা আমরা চোখে দেখতে পাই না।

বায়ু তৈরি হয়েছে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলীয় বাষ্পের একসঙ্গে মিলনের মধ্যদিয়ে। এখানে মৌলিক পদার্থ দুটি। অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। আর কার্বন ডাইঅক্সাইড হচ্ছে একটি যৌগিক পদার্থ। এটি তৈরি হয়েছে অক্সিজেন ও কার্বনের একসঙ্গে মিলনের মধ্যদিয়ে। জলীয় বাষ্প হচ্ছে পানির বায়বীয় বা গ্যাসীয় রূপ। পানিও যৌগিক পদার্থ। যেসব মৌলিক পদার্থ দিয়ে পানি তৈরি সেগুলো হচ্ছে, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুটি মৌলিক পদার্থ এবং দুটি যৌগিক পদার্থ একসঙ্গে মিলিত হয়ে বায়ু তৈরি হয়েছে।

লোহার তৈরি কোনো জিনিস কিছু দিন ফেলে রাখলে তার গায়ে লালচে আবরণ পড়ে। একে মরিচা বলে। ভেজা জায়গায় রাখলে মরিচার আবরণ বেশি পড়ে। মরিচা পড়তে পড়তে একটা সময় দেখা যায়, লোহার তৈরি ওই জিনিসটি ক্ষয় হয়ে গেছে। বায়ুতে থাকা অক্সিজেন লোহার গায়ে এই মরিচা তৈরি করে। কি কি উপাদান দিয়ে বায়ু তৈরি, আগের দিনের পণ্ডিতরা এটা জানতেন না। বায়ুর স্পর্শে কতগুলো ধাতুর গায়ে মরিচা পড়ে, এটা দেখেই তারা বায়ুর উপাদান বিষয়ে জানতে পারেন। কাচের একটি পাত্রে কয়েক খণ্ড লোহা রেখে পাত্রের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়েক দিন পর দেখা গেল, লোহায় মরিচা পড়েছে। এছাড়া পাত্রের ভেতরকার বায়ুর পরিমাণ কমে গেছে। বায়ুর যে অংশ মরিচা তৈরি করতে ব্যয় হয়, বিজ্ঞানীরা তাকে অক্সিজেন নাম দেন। মরিচায় ব্যয় হওয়ার পরও পাত্রের ভেতর বায়ুর যে অংশ থাকে, বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন নাইট্রোজেন। পাঁচ ভাগ বায়ুর মধ্যে এক ভাগ অক্সিজেন আর চার ভাগ নাইট্রোজেন পাওয়া যায়।

বাতাসে অক্সিজেন না থাকলে আগুন জ্বলত না। মোমবাতি জ্বালালে মোমবাতির নানা উপাদানের সঙ্গে মিশে অক্সিজেন তাপ উৎপন্ন করে। এই তাপশক্তি মোমবাতিকে জ্বালিয়ে রাখে। যেখানে বায়ু নেই সেখানে কোনো পদার্থকে আগুন দিয়ে জ্বালানো যায় না। একটি পাত্রে জ্বলন্ত মোমবাতি রেখে যদি পাত্রটাকে বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে কিছু সময় জ্বলে মোমবাতিটি নিভে যাবে। এর কারণ, বদ্ধ ওই পাত্রে যতক্ষণ অক্সিজেন ছিল, ততক্ষণ তা মোমবাতিকে জ্বলতে সাহায্য করেছে। এরপর অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে মোমবাতি আর জ্বলতে পারেনি।

কোথাও আগুন ধরে গেছে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। পানি ছিটিয়ে আমরা সেই আগুন নেভাতে চেষ্টা করি। নাইট্রোজেন এই পানির মতোই আগুন নেভাতে সাহায্য করে। বায়ুতে যদি শুধুই অক্সিজেন থাকত তাহলে যে কোনো জিনিস এতই দ্রুত জ্বলে ছাই হয়ে যেত যে, আমরা কোনো কাজেই আগুন ব্যবহার করতে পারতাম না। আবার, বায়ুতে যদি শুধুই নাইট্রোজেন থাকত তাহলে কোনো জিনিসই আগুনে জ্বলত না। অক্সিজেন যেমন আগুন জ্বলতে সাহায্য করে, একইভাবে নাইট্রোজেন আগুন নেভাবে সাহায্য করে। বায়ুতে এই দুটি মৌলিক পদার্থ আছে বলেই যে কোনো জিনিস আগুনে ধীরে ধীরে পোড়ে। কারণ, অক্সিজেন কোনো জিনিসকে আগুনকে পুড়তে সাহায্য করে, আর নাইট্রোজেন সেই আগুনকে নেভাতে সাহায্য করে।

নাক দিয়ে বায়ু থেকে থেকে প্রতিমুহূর্তে আমরা যে অক্সিজেন টেনে নিচ্ছি, তা আমাদের দেহে এক রকম দহনকাজে সাহায্য করে। যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আগুন জ্বলে ওঠে সেই বিক্রিয়াকে দহন বলে। তবে আমাদের দেহের ভেতর যে দহন তৈরি হয় তাতে আগুন জ্বলে না, তাপ উৎপন্ন হয়। আমরা যখন শ্বাস টেনে নিই তখন অক্সিজেন শ্বাসনালির পথ ধরে ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। এরপর তা ধমনীর রক্তে ঢুকে দেহের কোষগুলোতে পৌঁছায়। কোষে শর্করা থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু একসঙ্গে মিলিত হয়ে শর্করার একটি অণু তৈরি হয়। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কোষের শর্করায় জারণ ঘটে। এর ফলে ডাস্ট বা আবর্জনা হিসেবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এটাই হচ্ছে অক্সিজেনের দহন প্রক্রিয়া। প্রাণিদেহে সবসময় যে তাপ থাকে, সেই তাপ এই দহনের কারণেই উৎপন্ন হয়।

বায়ুতে নাইট্রোজেন না থাকলে আমাদের দেহের তাপ এত বেশি হতো যে, আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম না। আবার, বায়ুতে অক্সিজেন না থাকলে আমরা শ্বাস নিতে পারতাম না। ফলে আমাদের দেহে কোনো তাপ থাকত না। আর দেহে তাপ না থাকলে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কোষের শর্করায় যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয় তা কোষ থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফুসফুসে এসে পৌঁছায়। আমরা যখন শ^াস ছাড়ি তখন কার্বন ডাইঅক্সাইড ফুসফুস থেকে নাক দিয়ে বের হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

জগতের কোনো পদার্থই একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় না। প্রবল ঝড়ে যে গাছটি শেকড় উপড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কয়েক বছর পর হয়তো সে গাছের অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে এটা ভাবা ঠিক নয় যে, গাছটির সব অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। গাছটির একটি অণুও আসলে ধ্বংস হয় না। গাছের জলীয় অংশ বাষ্প হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়, আর কঠিন অংশ নানা আকারে মাটিতে রয়ে যায়। কেবল গাছ নয়, সকল পদার্থের বেলাতেই একই কথা। কোনো জিনিসকে আমরা যখন ধ্বংস হতে দেখি তখন বুঝতে হবে, ওই জিনিসটি এক রূপ থেকে আরেক রূপে বদলে গেছে। ধ্বংস হয়নি। মোমবাতি যখন পোড়ানো হয় তখন বায়ুর অক্সিজেন মোমের সঙ্গে মিলিত হয়ে আগুন বা তাপ উৎপন্ন করে। এরপর গলিত মোমের কার্বন বায়ুর অক্সিজেনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে কার্বন ডাইঅক্সাইড। এরপর তা মিলিয়ে যায় বায়ুতে।

কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রাণিদেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। শ্বাসের মাধ্যমে এই এই গ্যাস প্রাণিদেহে ঢুকলে বিষের মতো কাজ করবে। ফলে প্রাণী মারা যাবে। এখন প্রশ্ন যে, লাখ লাখ বছর ধরে নানা পদার্থ আগুনে পুড়ে কত যে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে মিলিয়ে গেছে, তার তো কোনো হিসেব নেই। অথচ তাতে তো প্রাণীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না! এর কারণ কি? গাছপালা বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেয়। এরপর তা শোধন করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন হিসেবে আবার বায়ুতে ছড়িয়ে দেয়। প্রকৃতিতে এই ব্যবস্থা চালু থাকায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড জমে উঠতে পারে না।

সূর্যের তাপ ও বৃষ্টির জলে পার্বত্য অঞ্চলের শিলা প্রতিমুহূর্তেই চূর্ণ হয়ে মাটিতে পরিণত হচ্ছে। এই নতুন মাটির ঊর্বরতা খুব বেশি। উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে থাকলে এই মাটি আমাদের কোনো কাজেই আসে না। বরং আমাদের অপকারই হয়। কারণ, নিচু স্তরের শিলা উঁচু স্তরের ওই মাটি দিয়ে ঢেকে থাকে। ফলে শিলা চূর্ণ হয়ে আর নতুন মাটি তৈরি হয় না। বৃষ্টির জল চূর্ণ করা শিলা বহন করে নিচু স্তরের শিলা উন্মক্ত করে। এছাড়া বায়ু প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়ে চূর্ণ করা শিলা নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। ফলে নিচু স্তরের শিলা উন্মুক্ত হয়।

বায়ুর কয়েকটি ধর্ম

আকার
বায়বীয় পদার্থের নিজস্ব কোনো আকার নেই। যে পাত্রে তারা থাকে সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।

আয়তন
নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়বীয় পদার্থের আয়তন যে কোনো পাত্রে সবসময় সমান থাকে না। বায়বীয় পদার্থের আয়তন পাত্রের আয়তন অনুসারে পরিবর্তিত হয়। পাত্র বড় হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়বীয় পদার্থের আয়তন ওই পাত্রের আয়তনের মতোই হবে। আবার, পাত্র ছোট হলে একই পরিমাণ বায়বীয় পদার্থের আয়তন হবে ওই পাত্রের আয়তনের মতো। আসলে পাত্রের আয়তন যে রকমই হোক না কেন, বায়বীয় পদার্থ সবসময় পাত্রকে পূর্ণ করে রাখে। বায়বীয় পদার্থের অণুগুলো কঠিন পদার্থের মতো দৃঢ় নয় বলে তারা আশপাশের কোনো অবলম্বন ছাড়া নিজেদের আকার ধরে রাখতে পারে না। পাত্রের যেদিকে আটকা থাকে না বায়বীয় পদার্থ সেদিক দিকে বের হয়ে যায়।

ওজন
দুটি বেলুন সমানভাবে ফুলিয়ে সুতো দিয়ে মুখ বেঁধে দাও। এরপর সরু একটি কাঠির মাঝামাঝি সুতো বেঁধে দুই প্রান্তে বেলুন দুটি ঝুলিয়ে দাও। কাঠির মাঝখানে বাঁধা সুতো ধরে উঁচু করো। সরু কাঠির এই দাঁড়িপাল্লায় দেখা যাবে, বেলুন দুটো সমান ওজনে আছে। মানে, কাঠিটি কোনো একদিকে বাঁকা হয়ে নেই, সমানভাবে রয়েছে। এবার সুঁইয়ের মাথা দিয়ে কোনো একটি বেলুনে খুব সূক্ষ্ম একটি ফুটো করে দাও যেন ধীরে ধীরে বায়ু বের হয়। দেখা যাবে, ওই ফুটো দিয়ে বায়ু বের হচ্ছে আর কাঠিটি ফোলানো বেলুনের দিকে ঝুলে পড়েছে। এর কারণ, ফোলানো বেলুনের ভেতর বায়ু রয়েছে আর অপর প্রান্তের বেলুনের ভেতর বায়ু নেই। তাহলে বোঝা গেল, বায়ুর ওজন আছে।

বায়ুর প্রেষ বা চাপ
যে কোনো তরল ওষুধের সঙ্গে প্লাস্টিকের ছোট্ট ড্রপার থাকে। সেই ড্রপার মুখ দিয়ে শোষণ করে বায়ু বের করে নাও। এরপর তাতে বায়ু ঢোকার আগেই জিভের আগায় লাগিয়ে দাও। দেখা যাবে, ড্রপারটি জিভের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে লেগে আছে। কেন লেগে আছে? লেগে আছে বায়ুর চাপের কারণে।

গোটা পৃথিবীটা বায়ুর মধ্যে ডুবে আছে। পৃথিবী কমলা লেবুর মতো গোল আকৃতির। পৃথিবীর সবদিক ঘিরে বায়ুর যে আবরণ রয়েছে, তার নাম বায়ুমণ্ডল। সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা প্রায় ৩৫ মাইল। ভূপৃষ্ঠকে সবসময় বায়ুমণ্ডলের চাপ বহন করতে হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলের চাপ উঁচু পর্বতশিখরে বায়ুর চাপের থেকে বেশি। এর কারণ, উঁচু পর্বতশিখরে বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা। জলের মতো বায়ুমণ্ডলের মধ্যেও বায়ুর চাপ ওপর, নিচে, পাশে সবদিকে সমানভাবে পড়ে। প্রত্যেক জায়গায় বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বচাপ ও পার্শ্বীয় চাপ বায়ুমণ্ডলের নিম্নচাপের সমান। সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রতি বর্গইঞ্চির ওপর এই চাপের পরিমাণ প্রায় ১৫ পাউন্ড। সাধারণ পূর্ণবয়স্ক মানবদেহের ক্ষেত্রফল প্রায় ২৩০০ বর্গইঞ্চি। সুতরাং ভূপৃষ্ঠে পূর্ণবয়স্ক মানবদেহের ওপর প্রায় ৪২০ মণ বায়ুর চাপ পড়ে। মানবদেহের ভেতরে যে বায়ু আছে তা বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংযুক্ত। এজন্য দেহের ভেতরে ও বাইরে বায়ুর চাপ সমান থাকে। এছাড়া ওপর থেকে নিচে এবং নিচে থেকে ওপরে সমানভাবে বায়ুর চাপ পড়ছে। ফলে আমরা বায়ুমণ্ডলের প্রচণ্ড চাপ অনুভব করতে পারি না। এই চাপ তখনই টের পাওয়া যায় যখন এমন কোনো জায়গায় যায় যেখানে বাতাসের চাপ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কম বা বেশি থাকে।

নদী কিংবা সমুদ্রের গভীরে যদি যাই তাহলে আমাদের দেহের ওপর বাতাসের চাপের সাথে পানির চাপও পড়বে। আর তখন দেহের ভেতরে স্বাভাবিকভাবে রক্ত চলাচল করতে পারবে না। সহজেই আমরা এই চাপ টের পাব। আবার, আকাশযানে চড়ে পৃথিবীর অনেক ওপরে উঠে গেলে বাতাসের চাপ পড়বে খুবই কম। কেননা, সেখানে বাতাসের পরিমাণ খুবই কম। এ অবস্থায় আমাদের দেহের রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে রক্তের ধারা।

বায়ুর ওপর চাপ প্রয়োগ করলে বায়ু বাধা দেয়। প্রমাণ চাও? তাহলে ফোলানো ও চুপসানো দুটো ফুটবল নাও। হাত দিয়ে প্রথমে ফোলানো বলে চাপ দাও। বলের দিক থেকেও বিপরীতমুখি চাপ টের পাবে। কেন এ রকম হচ্ছে? এর কারণ, ফুটবলের ভেতর বায়ু বলটিকে চুপসে যেতে বাধা দিচ্ছে। এবার হাত দিয়ে চুপসানো বলে চাপ দাও। এবার কিন্তু বিপরীতমুখি চাপ অনুভব করবে না। এর কারণ, বলটিতে বায়ু নেই।

বায়ুর চাপ যে খুবই প্রচণ্ড, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ। বিষয়টি হাতেনাতে পরীক্ষা করেছিলেন প্রুশিয়ার ম্যাগডেবার্গ শহরে গোয়েরিক নামের একজন বিজ্ঞানী। সময়টা ১৭০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি। দুই ফুট ব্যাস বিশিষ্ট সমান আয়তনের তামার তৈরি দুটি ফাঁপা অর্ধগোলক দিয়ে তিনি লোকজনকে বায়ুর প্রচণ্ড চাপের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখান। একটি অর্ধগোলকের সঙ্গে স্টপককসহ একটি নল লাগানো ছিল। অর্ধগোলক দুটির প্রান্তে চামড়ার একটি বলয় ও চর্বি লাগিয়ে তাদেরকে যুক্ত করে দেন। এরপর পাম্পের সাহায্যে নলের ভেতর দিয়ে গোলকের মধ্য থেকে বায়ু টেনে বের করে স্টপকক বন্ধ করে দেন। অর্ধগোলক দুটি এমনভাবে তৈরি করা যে, তাদের সংযোগস্থল কিংবা অন্য কোনো জায়গা দিয়ে গোলকের মধ্যে বায়ু ঢুকতে না পারে। গোলকের দু’দিকে কয়েকটি বলয় লাগানো ছিল। প্রত্যেক গোলকার্ধের সঙ্গে গোয়েরিক ছয়টি ঘোড়া জুড়ে দেন। বারোটি ঘোড়া একসঙ্গে বিপরীত দিকে টেনে যুক্ত গোলকার্ধ দুটোকে আলাদা করতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। গোয়েরিক এবার ঘোড়াগুলোকে খুলে দিলেন। এরপর স্টপকক ঘুরিয়ে গোলকের মধ্যে বায়ু ঢুকতে দিলেন। এবং গোলকার্ধ দুটোকে সামান্য জোরে টান দিয়েই আলাদা করে ফেললেন।

গোলকের ভেতর যখন বায়ু ছিল তখন তার ভেতরে ও বাইরে বায়ুমণ্ডলের চাপ সমান ছিল। এজন্য সহজেই তাদেরকে আলাদা করতে পারলেন। কিন্তু গোলকটি যখন বায়ুশূন্য তখন কেবল গোলকের বাইরে বায়ুমণ্ডলের চাপ পড়ছে। এই চাপ এতই বেশি যে, বারোটি ঘোড়ার শক্তিও তার কাছে কিছুই নয়।

ব্যারোমিটার দিয়ে বায়ুমণ্ডলের চাপের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। তিন ফুট লম্বা এক প্রান্ত বন্ধ কাচের একটি নল পারদে পূর্ণ করতে হবে। এরপর নলের খোলা প্রান্ত এক বাটি পারদের ভেতর এমনভাবে ডোবাতে হবে যেন নলের মধ্যে বায়ু ঢুকতে না পারে। নলটি খাড়াভাবে ধরলে দেখা যাবে, নলটির বেশিরভাগ অংশ পারদে পূর্ণ। কেবল নলের ওপরের কিছু অংশ শূন্য। বাটির পারদপৃষ্ঠে প্রত্যেক সমবর্গপরিমাণ স্থানের ওপর চাপ সমান। বাটির প্রত্যেক স্থানে বায়ুমণ্ডলের চাপ পড়ছে। কেবল যে অংশে নল বেষ্টিত তার ওপর নলের ভেতরকার পারদের চাপ পড়ছে। সমবর্গপরিমাণ স্থানে বাটির পারদের ওপর বায়ুমণ্ডলের চাপ নলের ভেতরকার পারদের চাপের সমান। বাটির পারদপৃষ্ঠ থেকে নলের পারদপৃষ্ঠের উচ্চতা অনুসারে বায়ুমণ্ডলের চাপ জানানো হয়। যেমন, ঢাকায় দুপুর ১২টায় বায়ুমণ্ডলের চাপ ৪৬ ইঞ্চি। মানে, ব্যারোমিটারে বাটির পারদপৃষ্ঠ থেকে নলের পারদপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৬ ইঞ্চি। প্রতি ৯০০ ফুট ওপরে উঠলে ব্যারোমিটারে নলের পারদের উচ্চতা ১ ইঞ্চি করে কম হয়। গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে বায়ুমণ্ডলের চাপ বেশি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গের উচ্চতা প্রায় ৫ মাইল। সেখানে বায়ুমণ্ডলের চাপ প্রায় ৮ ইঞ্চি।