বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ২

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯

গণিত ও কবিতা উভয়েরই যে ব্যাপারে মিল আছে তাহলো, ভাষার মাধ্যমে পরিমাপ ও আঙ্গিকের প্রতি তাদের নিখুঁত হবার প্রচেষ্টা; মাত্রা বা সংখ্যানিরূপণ; সমানতা; ছন্দ; প্রণালি; পুনরাবৃত্তি; অনুক্রম এবং পরিণতি; পৃষ্ঠার ওপরে আঙ্গিক ও লেআউট, এবং প্রকাশের সংক্ষেপণ, ঘণীভূত করার ইন্দ্রজাল। স্বকীয় মর্মার্থ থেকে পৃথক করার জন্য শব্দ (সংখ্যা) ও প্রতীকের একাত্মতাকে একটি স্তরে মান্যতা দিয়ে সংখ্যাবিন্যাস অথবা বাকবিন্যাসের নিরীক্ষা করে গণিত ও কবিতা উভয়ই। জ্ঞান ও বোধ-অভিজ্ঞতার একটি আদর্শ অথচ বিমূর্ত এলাকা গড়ে তোলে উভয়ই, যেখানে সত্য ও মর্মার্থের প্রকৃতি, এবং কেমন করে তাদের সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্কায়িত করা যেতে পারে, তার অন্বেষন করে। উভয়ই কল্পনা ও আবিষ্কারের  ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে অক্ষর এবং সংখ্যা শেখার উপায় হলো ছন্দের মাধ্যমে মুখস্ত করা। সেই বয়স থেকেই অক্ষর ও নামতা মনে রাখার চেষ্টা করানো হয় একইভাবে তাদের জন্য রচিত কবিতাগুলো গণিত মেনে লেখা হয় যাতে তাদের মনে থাকে। চন্দন ভট্টাচার্যকে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “ছন্দে ও অন্তমিলে লিখলে সে-কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায়। কাজেই পাঠকের স্মৃতিতে কবিতা সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি।”

বেদের শ্লোকগুলো, যা ছন্দে রচিত, তাতে গণিতের সংযোজন করেছিলেন অপস্তম্ব, বৌধায়ন, মানব, কাত্যায়ন, বরাহ, হিরণ্যকেশিন— ধর্মাচরণের বিষয়গুলো জ্যামিতিক ছক দিয়ে এবং সেগুলো ছন্দের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। অশ্বমেধ-হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির সময়ে সেই জ্যামিতিক ছকগুলো আঁকা হতো। এখনও পুরোহিতরা অনেকে পুজো, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির সময়ে মাটিতে নকশা আঁকেন, জল দিয়ে, কুশকাঠি দিয়ে, বালির ওপর আঙুল দিয়ে, সিঁদুর দিয়ে। বর্তমান কালখণ্ডে পৌঁছে আমরা শূন্য ও এক-এর বাইনারি কবিতায় পৌঁছেছি। গণিতের ক্ষমতার অংশিদার হলো কবিতা, এই তর্কে যে ভাবকল্প যতো ব্যাপকই হোক না কেন, গণিত ও কবিতা তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাপ্রণালী অথবা বাকপ্রণালীতে আঁটিয়ে দিতে পারে— এমনকি বিশাল ব্রহ্মাণ্ডকে অত্যন্ত ছোট ফর্মে ভরে ফেলতে পারে।

কিংবদন্তি অনুযায়ী, ঋষি বৃহস্পতির সাতটি মুখগহ্বর থেকে সাত রকমের ছন্দ নিঃসৃত হয়েছিল, এবং প্রতিটির গণিত-কাঠামো সুস্পষ্ট। সংস্কৃত কাব্যরচনার জন্য গণিত নির্দেশিত ছিল। ছন্দের গণিত বর্ণিত আছে বেদাঙ্গতে, যথা গায়ত্রীঃছন্দ (৬ x ৪), উশ্নীঃছন্দ (৭ x ৪), অনুষ্টুভছন্দ (৮x ৪), বৃহতীঃছন্দ (৯x ৪), ত্রিষ্টুভছন্দ (১১x৪) ইত্যাদি। পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্র’ গ্রন্থে গণিতের সঙ্গে মাত্রা ও শব্দের সম্পর্কনিয়ম আলোচনা করা হয়েছে। ‘নাট্যশাস্ত্র’তে বলা হয়েছে মাত্রার গণিতবর্জিত শব্দ হয় না; শব্দের গণিতহীন মাত্রা হয় না। ছান্দস বিষয়ে গাণিতিক নিয়মগুলি আলোচিত হয়েছে অগ্নিপূরাণ, নাট্যশাস্ত্র, বৃহৎসংহিতা ও মানসোল্লাস-এ। ‘মহাভারত’-এর ছন্দের গণিত মূলত অনুষ্টুভ ও ত্রিষ্টুভ।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে বিনয় মজুমদার বটানিকাল গার্ডেনে প্রায়ই যেতেন; গঙ্গার ধারের দৃশ্যাবলি দেখতেন। পরে যখন শিমুলপুর গ্রামে বসবাস করতে গেলেন তখন আরও কাছ থেকে প্রতিদিন পুকুরের মাছ গাছপালা ফুলফলের জন্ম ও বিকাশ দেখার অফুরন্ত সময় পেতেন। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি গণিতের ফিবোনাচ্চি রাশিমালার বিস্ময়কে বকুলফুল এবং বিভিন্ন গাছের শাখা-প্রশাখার প্রসারণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এই রাশিমালা আবিষ্কার করেছিলেন ত্রয়োদশ শতকের গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি, যিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির মূল রহস্য তার বর্ণিত রাশিমালা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এই রাশিমালা শুরু হয় শূন্যতে এবং সিরিজের পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রতিটি তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফল। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়িবিন্যাস, শামুকের খোলের ওপরকার ডোরা, ফুলকপির ছড়িয়ে পড়ার বিন্যাস, মৌমাছির পরিবারতন্ত্র, বিভিন্ন গাছের শাখাবিন্যাস, আনারসের বাইরের বিন্যাস ইত্যাদিতে পাওয়া যাবে প্রকৃতির এই নান্দনিক-গাণিতিক খেলা।

গণিতে ‘ফিবোনাচ্চি সিরিজ’ নিয়ে বিনয় এই কবিতাটি লিখেছিলেন:

অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিতশাস্ত্র নয়
লিখিত বিশ্লিষ্টরূপ গণিতের অআকখময়
হয় না, সে-সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতশাস্ত্রের
নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ করেই বিশ্লেষণ
করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয় ।
সেহেতু ঈশ্বরী দ্যাখো গণিতের ইউনিট
পাউণ্ড সেকেণ্ড ফুট থেমে থাকে চুপে

এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনতস্ত্বে বর্তমান ইউনিটরূপে আলোকিত করে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী চিন্ত্যনীয় বিষয়গুলিকে আগামীর দিকে। পোল্যাণ্ডের কবি উইসলাভা সিমবোরস্কা, যিনি ১৯৬৬ সালে কবিতায় গণিত ও জৈবজীবনের রহস্যকে একীভূত করার জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তাঁর ‘পাই’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে, যে-কবিরা গণিতকে ভালোবাসেন তাঁদের কবিতা কীভাবে রূপায়িত হয়েছে। আমি ইংরেজি অনুবাদটিই এখানে তুলে দিচ্ছি:

The admirable number pi
three point one four one.
All the following digits are also initial,
five nine two because it never ends.
It can not be comprehended six five three five at a glance,
eight nine by calculation,
seven nine or imagination,
not even three two three eight by wit, that is, by comparison,
four six to anything else
two six four three in the world.
The longest snake on earth calls it quits at about forty feet.
Likewise, snakes of myth and legend, though they may  hold
out a bit longer.
The pageant of digits comprising the number pi
does not stop at the page’s edge.
It goes on across the table, through the air,
over a wall, a leaf, a bird’s nest, clouds, straight into the sky,
through all the bottomless, bloated heavens.
Oh how brief — a mouse tail, a pigtail — is the tail of the comet !
How feeble the star’s ray, bent by bumping up against space !
While here we have two three fifteen three hundred nineteen
my phone number your shirt size the year
nineteen hundred and seventy-three the sixth floor
the number of inhabitants the sixty five cents
hip measurement two fingers a charade, a code,
in which we find hail to thee blithe spirit, bird thou never
were
alongside ladies and gentlemen, no cause for alarm,
as well as heaven and earth shall pass away,
but not the number pi, oh no, nothing doing,
it keeps right on with its rather remarkable five,
in uncommonly five eight,
its far from final seven,
nudging, always nudging a sluggish eternity
to continue.

গণিতের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা ইউরোপ আমেরিকায় বহুকাল যাবত লেখা হচ্ছে। যেমন মারিয়ান মুর-এর ‘দি আইকোস্যাসফিয়ার’, কার্ল স্যাণ্ডবার্গের ‘অ্যারিথম্যাটিক’, ওয়ালেস স্টিভেন্সের ‘ল্যাণ্ডস্কেপ ফাইভ’, ভ্যাচেল লিন্ডসের ‘ইউক্লিড’ ইত্যাদি। আল মাহমুদ যথার্থই বলেছিলেন, “বিনয় অগোছালো একজন কবি আর আমি খুব গোছানো কবি।” তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মে, যখন কিনা বিনয় মজুমদার ধর্মকে ছোঁয়াচে-রোগের মতো পরিহার করে গণিতের আশ্রয় নিয়েছেন, এবং গণিত যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের মতন বিনয় মজুমদার একজন বেপরোয়া কবি।

বিনয়ের এই গাণিতিক কবিতার মতো আল মাহমুদ কোনোদিন রহস্যময় কবিতা লেখেননি, লেখা সম্ভব ছিল না তাঁর শেষ পর্যায়ের মৌলবাদী জীবন পরিসরে। বিনয় মজুমদার লিখিত একটি গণিতাশ্রিত গান:

একটি গান

X = 0
এবং Y = 0
বা X = 0 = Y
বা X = Y
শূন্য  0 থেকে প্রাণী X ও Y সৃষ্টি হলো
এভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুরু হয়েছিল ।

এবং একটি গাণিতিক কবিতা:

X, Y ও  Z
দুটো ভ্যারিয়েবল X ও  Y
X ও Y থেকে তৃতীয় একটি ভ্যারিয়েবল বানাতে চাই
আমরা। তৃতীয় ভ্যারিয়েবল ‘Z’  সহজেই বানানো যায়
ক্যালকুলাসের দ্বারা।

একমাত্র ঐ ক্যালকুলাসের জন্যই ময়ূরীর সন্তান আরেকটি
ময়ূরীই হয় — ডিম থেকে ময়ূর হয়, তারপরে
‘Z’ হয়। Y আর X
Y ইজ আ ফাংশন অফ X
ঠিক ডিমটাও হয় সেইরকম। ডিমের ভিতরে
‘Y’- ও আছে ‘X’ -ও আছে । সুতরাং ‘Z’ সহজেই
হয় Y নতুবা X -এর মতন হয়ে । ময়ূরীর ডিম
তার ভিতরে ময়ূরীও আছে ময়ূরও আছে ।
সুতরাং ডেরিভেটিভ হয় ময়ূর হবে নয়তো ময়ূরী হবে ।

বিনয় লিখেছেন, এবং এখানে সত্য কথাটার ওপর আমি জোর দিতে চাই:
ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি ।
যে-কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়। চলবে