
বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ
পর্ব ৬
মলয় রায়চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯
তিন.
১৯৮২ সালে সমর তালুকদারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন যে, “আমার বাবা ১৯৪৮ সালে এখানে (শিমুলপুর) এসে প্রায় এগারো বিঘার মতো জমি কিনে এই ছোট্ট বাড়িটা তৈরি করেন। তখন এক বিঘা জমির দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা। এখানে ঠাকুরনগর স্টেশনটি হয়েছে প্রাক্তন এমপি ঠাকুরবাবুর প্রচেষ্টায়। লোকও বেড়েছে অনেক। স্টেশনের কল্যাণে এখন জমির দাম কুড়ি হাজার টাকা বিঘা। এই তো, সেদিন বাবা দু’বিঘা জমি বিক্রি করে দিলেন।”
১৯৪৯ সালে তাঁকে, বিনয় মজুমদারকে, কলকাতার মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউটের বউবাজার শাখায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৯৫১ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। সেই ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে গণিতে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পান। এরপর বিনয় মজুমদার শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ইঞ্জিনিয়ার হবার পর কিছুকাল চাকরি করেন ইনডিয়ান ইন্সটিউট অফ পাবলিক হেল্হ দপতরে, ইনডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিউটে, অধ্যাপনা করেন ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, এবং ইঞ্জিয়ারের চাকরি করেন দূর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে।
কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবের কারণে এবং কবিতা রচনায় একাগ্র হতে চাইছিলেন বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন। অবশ্য চাকরিস্থলে তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না, সেটাও একটা কারণ। মারুফ হোসেনকে ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “১৯৫৭ সালে আমি ছাত্রাবস্থায় কিছু যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলাম। সে সময়ে আমার সহপাঠী ও শিক্ষকেরা যে ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে তা ভোলবার নয়। তারপর চাকরি করলাম সেখানেও সহকর্মীরা আমার সঙ্গে যা ব্যবহার করলেন, চাকরি ছেড়ে দিলাম। তখন মনে হলো, জীবনে একবার মাছের মতো শ্বাস নিতে জলের ওপরে উঠেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে রেকর্ডস মার্কস পেয়ে।”
তারপর থেকে তিনি নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালিত করেছেন, তাঁর কবিতার স্পেকট্রাম বিশাল হয়ে ওঠে, গণিতবিদ রামানুজম এবং সুফি সন্তের চরিত্রের মিশেলে যে ধরণের প্রতিস্ব গড়ে উঠতে পারে, বিনয় পেয়েছিলেন সেরকমই প্রতিস্ব। এই বিশাল পরিধিতে ধরে রাখা জ্ঞান ও কবিত্বের সময়ানুগ বাঁকবদলগুলো তাঁকে বাংলা কবিতার বোধিবৃক্ষ করে তুলেছে। বলা যায় যে, জীবনানন্দের পর তিনি বাংলা কবিতার প্রধান বাঁকবদলকারী কবি। বিনয় জীবনানন্দের মতন কবিতার একটি জনারেই আটক থাকেননি, চারটি বিভিন্ন সাব-জনারে (sub-genre) কাজ করেছেন। এবং তৃতীয়টি দুঃসাহসিক কাজ, বলা যায় মধ্যবিত্ত ডিসকোর্সকে ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছেন ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামের কাব্যগ্রন্থের সাব-জনারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ কাব্যগ্রন্থের জনার থেকে বেরিয়ে যেতে চাননি, সারা জীবন তাতেই নিজেকে আটক রেখেছিলেন।
বিনয় মজুমদার প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তিনি চাকরি ছেড়ে কবিতা লেখা আরম্ভ করেন বন্ধুদের কথায়— শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, দীপক মজুমদার, শরৎ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের কথায়। অথচ বিনয় যখন ঠাকুরনগরে নিষ্কপর্দক অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন তখন তাঁর বন্ধুরা প্রতিষ্ঠিত, এবং ইচ্ছা করলেই বিনয়কে দিয়ে কোথাও অর্থকরী লেখালিখির ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীমকে বিনয় বলেছিলেন, “চাকরি না করে আমি ছিলামও বটে। ওরা চাঁদা তোলা শুরু করল বটে এবং দিয়েও ছিল বছরখানেক, বছর দেড়েক। তারপরে কিন্তু চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিল। আমি অত্যন্ত, অতিশয় কষ্টে, দিন কাটিয়েছি তারপর। ১৯৬৪ সালের পরে ১৯৭০ সালে আমি আমার বাবার কাছে এখানে চলে আসি। ছয় বছর আমি অত্যন্ত টাকার অভাবে ভুগেছি। টাকার অভাব দেখে বাবা আমাকে ১০০ টাকা করে দিত। আমি প্রতি মাসে পয়লা তারিখে শিমুলপুর এসে টাকা নিয়ে চলে যেতাম কলকাতায়। কলকাতায় ঘর ভাড়া করে ছিলাম।”
বিনয় মজুমদার সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক কবিদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সমর তালুকদারের ১৯৮২ সালের এই ক‘টি কথা থেকে টের পাওয়া যায়, যা সমরবাবু বিনয়ের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কফিহাউসের টেবিলে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে বসলেন শ্রীঅমিতাভ দাশগুপ্ত, বসেই চিৎকার করে হাসতে শুরু করে দিলেন, সে হাসি থামতেই চায় না— আমরা যারা টেবিলে ছিলাম ভেবে নিলাম বোধহয় ক্লাবে (খালাসিটোলায়) প্রচুর হয়েছে। হাসি থামতে বললেন, ‘তোমরা শালারা একেবারেই অপদার্থ। কলকাতায় কী ঘটছে কিছুরই খবর রাখো না।’ সত্তরের দশক— বড়-বড় চোখ করে ওঁর দিকে চেয়ে থাকলুম দুরুদুরু বুকে— এবার কে গেল? কোন শ্রেণিশত্রু! অমিতাভ বললেন, ‘বিনয়দা এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন— গোবরা মানসিক হাসপাতালে আছেন— স্নানটা অন্তত করছেন নিয়মিত— খাওয়া দাওয়াও মন্দ করছেন না। বেশিরভাগ একা-একাই থাকেন, আর কী সব নাকি বিড়বিড় করে বলেই চলেন অনবরত। শুনেছি পাশের ঘরে এসে জুটেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। বাংলা মদের সাপলাইয়ের কোনও অভাব ছিল না। এ যেন একটা এক্সকারশান। ওখানেই ঋত্বিক শেষ করেছেন তাঁর ‘জ্বালা’ নাটক, অভিনয়ও হয়ে গেছে ওই গোবরাতেই— প্রধান ভূমিকায় বিনয় মজুমদার।”
পরে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, “আমি সাম্প্রতিক কালের এক কবির সম্পর্কে আস্থা রাখি, যিনি কবিতার জন্য যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয়, এ-কালে বাংলাদেশে এতবড় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কবি আর জন্মাননি। তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।” প্রৌঢ় বয়সে বিনয়ের স্মৃতি থেকে ঋত্বিক ঘটক মুছে গিয়েছিলেন; বিনয় বলেছিলেন, ঋত্বিকের সম্পর্কে তাঁর কিছুই মনে নেই। আমরা যারা সেই সময়ের অমিতাভ দাশগুপ্তকে খালাসিটোলায় মাতাল অবস্থায় উল্টোপাল্টা আচরণ করতে দেখেছি, বলতুম যে উনি হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিলিপি। সেই সময়ে কলকাতায় মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টদের বাংলা মদ অর্থাৎ শ্রমজীবিদের পানীয় খেয়ে বিশেষ বুদ্ধিজীবি প্রমাণ করার চল ছিল। তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু বাঙালি লেখকদের বদলেয়ার, হেনরি মিলার, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখের জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর অনেকেই এই বিদেশি কবি-লেখকদের জীবনকে আত্মস্থ করার প্রয়াস করেছিলেন সেসময়ে, মদের জমঘট এবং যৌনপল্লীতে সমবেত হই-চইয়ের মাধ্যমে।
বস্তুত বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ ছিল বাংলা কবিতার জগতে, আগেই বলিছি, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ; ওই কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলোর পাশে পঞ্চাশ দশকের কবিদের কাজগুলো জোলো হয়ে যাচ্ছিল, একমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ ছাড়া । শক্তির ছন্দময় অথচ দুর্বোধ্য কবিতার তুলনায় বিনয়ের কবিতা তরুণ কবিদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল, তার কারণ তাঁর কবিতার ক্ল্যারিটি এবং অসাধারণ রূপকল্প। ফলে বিনয়ের বিরোধীদের সংখ্যা এবং ক্ষতিকারক লবি বেড়ে উঠতে সময় লাগেনি। বিনয়ের কবিতার উচ্ছ্বসিত বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্ময় দত্ত ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার পর বিরোধীরা আরও বেশি বিনয়-নিন্দা আরম্ভ করে দিয়েছিল। ‘দি স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্র সেসময়ে বর্তমানকালের আনন্দবাজারের চেয়ে বেশি নজরকাড়া প্ল্যাটফর্ম ছিল। সমসাময়িকদের কার্যকলাপে বিনয়ের ক্রুদ্ধ ও অপমানিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে তিনি গালমন্দ করতেন। একদিন তিনি কফিহাউসের এক বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুণ বেয়ারাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হন আর কুড়ি দিনের জেল-হাজতবাস করতে হয়। সেসময়ে গুজব ছিল যে, তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন কবি তাঁকে উসকেছিলেন।
কলকাতার বিরক্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিনয় মজুমদার ১৯৬৬ সালে পায়ে হেঁটে বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান, ফরিদপুরের নিজেদের গ্রাম তারাইলে, তখন তাঁর বত্রিশ বছর বয়স। গ্রামে গিয়ে আত্মীয় আর পরিচিত লোকজন পেয়ে গেলেন। সেখানকার যুবকেরা দিব্বি তাঁর আদর আপ্যায়ন করল। ভোরবেলা একজনকে ইংরেজি পড়াতেন, দুপুরবেলায় শেখাতেন অঙ্ক। আর রাত্রিবেলা চার-পাঁচজনকে পড়াতেন— ক খ গ ঘ থেকে শুরু করে ক্লাস নাইনের পড়া পর্যন্ত। বাকি সময়টা আড্ডা মেরে বেড়াতেন। থাকা খাওয়া আর সিগারেটের বিনিময়ে। কলকাতা ছেড়ে সেখানে বেশিদিন থাকতে ভালো লাগলো না। একদিন স্থানীয় থানায় গিয়ে জানালেন যে, তিনি অনধিকার প্রবেশকারী ভারতীয় নাগরিক, বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁকে যেন ভারতে ফিরে যেতে বলা না হয়, যদি দরকার হয়, তিনি মুসলমান হয়ে যেতে রাজি, তিনি মুসলমান হয়েই তাঁর গ্রামে থাকবেন যেখানে তাঁর বাবা-মা জন্মেছিলেন, তাঁকে যেন ভারতে পাঠানো না হয়।
বিনয় জানিয়েছেন, “ঢাকা থেকে গোয়েন্দা এলো। আমাকে বলল, কবিতা লেখেন নাকি? কাগজ দিচ্ছি, লিখুন দেখি কী কবিতা লেখেন। ফোটো তুললো আমার। সামনে, দুই পাশে, চুল দাড়িসহ, চুলদাড়ি কামিয়ে ইত্যাদি নানাভাবে ফোটোতোলা হলো।” বিচারাধীন আসামি হিসাবে ছ’মাস জুডিশিয়াল কাস্টডিতে থাকার পর তাঁকে বেকসুর মুক্তি দেয়া হয়। সেই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বিনয় বলেছেন, “আমাদের হাজতের চেয়ে ওদের হাজত অনেক ভালো। লোকগুলো ভদ্র, খাওয়াদাওয়া ভালো। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো কী জানো, যত্ন করে বেশ কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিলে, সঙ্গে দু’পাশে দু’জন এসকর্ট, যারা আমাকে সীমান্ত অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল।”
শামীমুল হক শামীম বিনয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “হঠাৎ মুসলমান হবার আকাঙ্ক্ষা জাগল কেন?” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “তখন এত কষ্টের ভিতরে চলছিল অবস্থা হিন্দুদের নির্যাতনে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাওয়ার যোগাড়। তখন আমি পালিয়ে চলে গেলাম ফরিদপুর। বাল্যকালের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা। আমি বললাম মুসলমান হবো। আমাকে তোমরা তোমাদের ধর্মে নিয়ে নাও। তারপর তারা বহু ভেবে বলল, তোমাকে আমরা মুসলমান করব না, তুমি হিন্দুই থাকো। তোমাকে আমরা মুসলমান করতে রাজি নই।” পরে, ১৯৯৮ সালে ধর্ম নিয়ে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লেখেন (‘কবিতা বুঝিনি আমি’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত):
এই এক
এই এক গুপ্ত রোগ পৃথিবীর সবার হয়েছে।
যদিও গোপন খুব, তবুও সংবাদপত্রে মাঝে-মাঝে ছাপে—
এসব রোগের কথা নিক্তি অনুসারে
ছাপা হয়ে যায় দেখি। আড়াই হাজার বছর
আগের ডাক্তার বুদ্ধ কিছু কিছু ওষুধ বলেছে–
সে-সব ওষুধে কিন্তু মায়ামৃত সুফল ফলেনি।
আরেক ডাক্তার ছিল হজরত মোহম্মদ, তার
কথামতো ওঠে বসে রোগীগণ, তবু
রোগ তো সারে না, আরো বেড়ে যায়, দেখি
সীমান্তেও গুলিগোলা অল্প স্বল্প বিনিময় হয়। চলবে