বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ৮

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯

ঠিক কী যে বিনয়কে উদ্বেলিত করেছিল, ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলো লিখতে, তা রহস্যই থেকে গেছে। শিবপুরের ছাত্রজীবন থেকে কলকাতায় ফিরে, কফিহাউসে যাতায়াত করে, প্রেসিডেন্সির করিডরগুলোয় ঘুরে, গায়ত্রী চক্রবর্তী নামের সেই কিশোরীটির স্মৃতিই কি? স্মৃতির গোপন ঘায়ের রক্ত আবার যদি না বেরোতো তাহলে এই তিন বছরের কবিতাগুলো লেখা সম্ভব হতো না বলেই মনে হয়। এমনও হয়েছে যে, একই দিনে তিনি দু’তিনটি কবিতা লিখেছেন; রাতে তাঁর ঘুম হয় না। যৌবনের স্বাভাবিক কুসুম-কুসুম জ্বরে তপ্ত হয়ে ওঠেন। যার দরুণ রস এসে চাপ দিতে থাকে, ছন্দিত ঘর্ষণে উত্তেজনা চরমে ওঠে, তারপর রসপাত হলে শান্তি হয়। বিনয়ের সঙ্গে জীবনানন্দের এখানে পার্থক্য এই যে, জীবনানন্দ ‘যোনি’ শব্দটি বহুবার প্রয়োগ করলেও, ব্রাহ্মধর্মের বেড়াজাল তাঁকে যুবকের যৌন উত্তেজনার যন্ত্রণা সম্পর্কে এরকম খোলাখুলি লিখতে দিত না।

২২ জুন ১৯৬২ তারিখে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লিখেছিলেন:

যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।
সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।
শুধু তার যন্ত্রণায় ডুবে থাক হৃদয় শরীর।
তার তরণির মতো দীর্ঘচোখে ছিল সাগরের
গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ বাতাস।
কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা— প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া
ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা।
যাক সব জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।

২৯ জুন ১৯৬২ তারিখে লিখেছিলেন এই কবিতাটি:

তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত করে-করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
আড়ালে যেও না; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি; ক্ষিপ্র হাত দুটি…
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা-একা ব্যর্থ বারিপাত।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে না কি? সার্থক চক্রের
আশায় শেষের পঙক্তি ভেবে-ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
কেবল কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে।
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায়।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও নারী, ক্রমে… ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শীর্ষ লাভ করে
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে।

চার.
বিনয় মজুমদার স্বীকার করেছেন যে, তিনি কাল্পনিক বিষয় নিয়ে লেখেন না। তাঁর বিষয়বস্তু বাস্তবজগত থেকে সংগ্রহ করা। সুতরাং অনুমান করা যেতেই পারে যে, ‘গায়ত্রী’ বাস্তব জগতেরই কেউ একজন; বনলতা সেন, নীরা বা সুপর্ণার মতো কাল্পনিক নন। এখানে উল্লেখ্য যে, জীবনানন্দ দাশ এবং ভাস্কর চক্রবর্তী স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক মধ্যবিত্তের মতন দাম্পত্য সম্পর্কে গড়ে তুলতে পারেননি। যেকারণে তাঁরা কাল্পনিক প্রেমিকা তৈরি করে নিয়েছিলেন। ‘গায়ত্রীকে, বা ‘ফিরে এসো, চাকার’ পরে বিনয় মজুমদারের বড়ো কাজ ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। এই বইটি সম্পর্কেও তাঁর কলমেই পড়ি তিনি কী বলছেন:

“এ পর্যন্ত আমি কোনোদিন নিসর্গমূলক কবিতা লিখিনি। অধিকাংশই ঘটনার বিবৃতি লিখেছি। অতঃপর আমায় কলকাতার শহরতলিতে থাকতে হয়, যাকে প্রায় গ্রাম বলা যায়। চারদিকে নানা গাছপালা লতাপাতা ছিল। ছোট-বড়ো পুকুর ছিল। ভাবলাম, প্রকৃতির বর্ণনা লেখা যাক। এক মাসের ভেতর খুব দীর্ঘ ছয়টি কবিতা লিখলাম। হিসাব করে দেখলাম, বই আকারে ছাপলে এই ছয়টি কবিতা ৪৮ পৃষ্ঠার বেশি জায়গা নেবে। ফলে আর বেশি লিখলাম না। বইয়ের নাম দিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ এবং কবিতাগুলির কোনো নাম না দিয়ে সংখ্যাচিহ্ণ দিয়ে চিহ্ণিত করলাম — ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬।

একবার ভাবলাম, কায়দা করে ছ’টি কবিতাকে জোড়া লাগিয়ে একটা কবিতা করি, ৪৮ পৃষ্ঠার লম্বা একটা কবিতা। কিন্তু এত দীর্ঘকবিতা পত্রিকায় ছাপা অসম্ভব হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা ছ’টি কবিতাই রাখলাম। এর প্রথম কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘অনুভব’ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ ভৌমিক, দ্বিতীয় কবিতাটি নিলেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, তৃতীয় কবিতাটির কী হয়েছিল তা গোপন রাখতে চাই, চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা দুটি ছাপতে নিলেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ষষ্ঠ কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বিমল রায়চৌধুরী।

সকলেই যথা সময়ে ছেপে বার করলেন। পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইখানা আমি ছেপে বের করব, কবিতার সঙ্গে ইলাসট্রেশন দেব। অমিতাভ দাশগুপ্ত বললো, তোর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সমালোচনা লিখব, বই হয়ে বেরোবার আগেই। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, তাদের কথা প্রশংসাবাক্য মাত্র। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র তৃতীয় কবিতাটি ছাপা হয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায়— ১৯৭০ সালে। এই একই প্রকার কবিতা আমি আরো লিখে যেতে পারতাম। কিন্তু পড়তে একঘেয়ে হয়ে যাবে ভেবে লিখিনি। এর পরে আমার কবিতা লেখার গতি খুব মন্দ হয়ে আসে।”

একজন কবি যদি আখের গোছাবার ধান্দায় থাকতেন, তাহলে তিনি পরের পর ‘ফিরে এসো, চাকা’র মতোই কবিতা লিখে যেতেন, যা বিনয়ের পক্ষে সেই সময়ে সহজও ছিল, কেননা তিনি অমন কবিতা লেখার পদ্ধতি ও ছন্দ রপ্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই পথ ছেড়ে বিনয় লিখলেন আদিরসাত্মক কবিতা। র‌্যাবেলের ‘গার্গাঁতুয়া পাঁতাগ্রুয়েল’ আলোচনাকালে বাখতিন বলেছেন, ‘লেখক যদি বেপরোয়া না হন তাহলে তার পক্ষে কার্নিভালেস্ক রচনা সম্ভব নয়।’ বিনয় প্রচলিত গণ্ডি কেটে বেরিয়ে গেলেন এবং লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, তারপর ‘বাল্মীকির কবিতায়’ ভুট্টা সিরিজ ও ডালাসারির কবিতাগুচ্ছ, এবং হাসপাতাল ও গ্রামজীবনের দিনপঞ্জিমূলক কবিতা। অর্থাৎ বিদ্যায়তনিক সাহিত্যের ক্যাননের তিনি ধার ধারলেন না। বলা যায়, সপাটে চড় কষালেন সাহিত্যিক মূল্যবোধের মালিকদের গালে। গণ্ডি কেটে বেরোনোর সঙ্গে বিনয়ের স্কিৎসোফ্রেনিয়ার সম্পর্ক খোঁজা ভুল হবে। কেননা র‌্যাবেলের এবং ডন কিয়োটের লেখক সেরভানথেসের স্কিৎসোফ্রেনিয়া ছিল না।

নিজের জীবনকে কবিতার জগতে এমনভাবে নিয়ে গেলেন বিনয় যে, আর সবাইকে শুনিয়ে বলার দরকার হলো না যে, শুধু কবিতার জন্য তিনি অমরত্বের তোয়াক্কা করেননি, এবং সত্যই তাই। তিনি কারোর তোয়াক্কা করেননি, আর এই ধরনের কবিতাও তাঁকে লিখে যেতে হয়নি যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘শুধু কবিতার জন্য’ রচনায় লিখলেন:

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম শুধু কবিতার
জন্য কি যে খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যাবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি এক ঝলক;
শুধু কবিতার জন্য নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আজো দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময়, শুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

বিনয় মজুমদার যখন ২০০৩ সালে বাঙ্গুর সাইকিয়াট্রি ইন্সটিউটে চিকিৎসাধীন তখন তাঁর প্রয়াত মা ও বাবার সম্পর্কে মনকেমনকে কেন্দ্র করে দুটি কবিতা লিখেছিলেন, পড়লে টের পাওয়া যাবে তাঁর চিন্তাধারা কোন পথে চালিত হচ্ছিল সেসময়ে:

মায়ের

মায়ের ইনসোফেগাস ক্যানসার হয়েছিল
কোনো কিছু গিলে খেতে পারত না, জল
খেতে পারত না।
পীযুষ ডাক্তার
গ্লুকোজ ইনজেকশান দিত দুই হাতে।
তাতে আর কী বা হয়, না খেয়ে পনেরোদিন থেকে
মা-ও মারা গেল।
মরবার আগে একবার
আমার বাবাকে মা তো কুকুর বলেছে।
মরবার আগে মা আমার
বাড়ির চাকরটির পা-ও ধরেছিল।
এর নাম মৃত্যু মহাশয়।

নিজের মাকে নিয়ে এই ধরণের কবিতা বিনয়ের আগে আমরা আর কোনো কবিকে লিখতে দেখিনি। সকলেই মাকে নিয়ে যেসব কবিতা এযাবৎ লিখেছেন সেগুলো নাটুকে ও কৃত্রিম বলে মনে হয়। এবার পড়া যাক বাবাকে নিয়ে লেখা কবিতা:

যখন আমার বাবা

যখন আমার বাবা খুব বুড়ো হয়েছিল
বয়স তিরানব্বই বৎসর হয়েছিল তখন তো বাবা
বিছানায় বসতেই পারত না, শুয়েই থাকত ।
বুড়ো হলে এই হয়, আমারো তো হবে ।
বড় ভগ্নীপতি এসে হাবড়ায় নিয়ে
বাবার পেটটি কেটে এনেছিল, পরে
একটানা এগারোটি দিনব্যাপী রক্ত পড়েছিল
কাটা পেট থেকে ।
তারপরে বাবা মারা গেল ।
বাবার তো আত্মা নেই পূনর্জন্ম নেই ।
বাবাকে পোড়ালে পরে বাবার ছাই তো আছে, এই
ছাই ভাবে পৃথিবীর মাটির সহিত। চলবে