বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ৯

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯

বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বের জন্য বিনয় মজুমদার জার্মানিতে গণিত অধ্যাপকের চাকরি পেয়েও যাননি। ১৯৯৮ সালে ‘অধরা মাধুরী’ পত্রিকার জন্য বোধিসত্ত্ব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছিলেন, “বার্লিনে নেমন্তন্ন করেছিল আলেকজান্ডার ডি ভার্স্ট বলে একজন ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। আমি তাঁকে দরখাস্ত দিই, আমি চাকরি করতে চাই জার্মানিতে। আমি তাঁকে আমার গণিতের গোটা কয়েক খাতা পাঠিয়েছিলাম। সেইগুলি পড়ে উনি আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন। বললেন, তুমি এসো, আমাদের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক কষাবে। তোমাকে মাইনে দেয়া হবে ইউএসএ’র স্কেলে। তখন আমি বাবাকে বললাম, আমাকে দেখছি জার্মানিতে ডেকেছে! অঙ্ক কষাতে হবে এমএসসি ক্লাসে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা বললেন, দ্যাখ, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি। আমার বয়স আশি-পঁচাশি বছর। তোর মায়ের বয়সও ওইরকম। আমাদের বাড়িতে দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই। তুইও একা আছিস। তুই আর যাসনে কোথাও। আমাদের দেখাশোনা কর। সুতরাং আমি আর জার্মানিতে যেতে পারিনি।

দার্শনিক-তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যাঁকে নিয়ে ’গায়ত্রীকে’ (পরিবর্তীতে নাম ‘ঈশ্বরীকে’ এবং আরেকবার পরিবর্তিত নাম ‘ফিরে এসো, চাকা) বইয়ের কবিতাগুলো বিনয় মজুমদার লিখেছেন, এবং  বিনয় নিজেও তা প্রথম দিকে স্বীকার করেছিলেন, এবং জীবনের মধ্যভাগে তা স্বীকার-অস্বীকারের দোনামনায় ভোগা আরম্ভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯৫৯ সালে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর বাবার বাড়িতে বিনয় গিয়েছেন কয়েকবার তা তিনি ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার সম্পাদক শামীমুল হক শামীমের  কাছে স্বীকার করেছেন, এবং কিশোরী গায়ত্রীর প্রতি তিনি টান অনুভব করতে থাকেন, সেই টান তিনি আজীবন বয়েছেন, একতরফা প্রেমের টান, নিজের মনের কথা উচ্চবর্ণের ধনী পরিবারের স্মার্ট কনভেন্টে-পড়া ইংরেজি-বলিয়ে কিশোরীটিকে বলে উঠতে পারেননি। তাঁর অবস্থান থেকে তা বলা বিপজ্জনক ছিল।

শামীমুল হক শামীম প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ যাঁকে উৎসর্গ করেছেন সেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
বিনয় মজুমদার উত্তরে বলেছিলেন, আমি যখন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছিলাম তখন গায়ত্রীর বাবা ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট, জনার্দন চক্রবর্তী, দাদার নাম প্রসূন চক্রবর্তী। তখন ওর বয়স বারো। তখন থেকে দেখেছি। পুরোহিতের মেয়ে তো। বেশি কথাবার্তা হয়নি। আলাপ-আলোচনা হতো— কবিতা নিয়ে। ‘কবিতা লিখেছি কবে, দুজনে চকিত চেতনায়’— এবার বুঝলে তো! তারপর ভালো ছাত্রী হওয়ার ফলে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ২৩ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে গেল। আমি তিনটি বই তাকে উৎসর্গ করেছি।

গায়ত্রী স্মার্ট তন্বী ছিলেন, আকর্ষণীয়া, প্রতিভাময়ী, কিন্তু সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তাঁর যৌবনের ছবি দেখে তা মনে হয় না। মিষ্টি মেয়ে বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন তিনি। কিন্তু তরুণ বিনয়ের অস্তিত্বে তিনি প্রগাঢ় ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন, ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে’ কবিতাটি পড়লে তার আঁচ পাওয়া যায়:

কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সন্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টি বিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়,
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।
অথবা করেছ ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে।
জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না; বিমর্ষ ভাবনায়
রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা–
হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে।
মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অবস্থানে বেদনা ঝরে যাবে।

পাঁচ.
অরুণেশ ঘোষ ‘গায়ত্রীকে’ বা ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের প্রতি বিনয়ের আকর্ষণ স্বীকার করেননি। অরুণেশ লিখেছিলেন, “এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিনয় পাগল হয়ে গেছে আর সেই উন্মত্ত অবস্থার মধ্যে লেখা হয়েছে ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাগুচ্ছ। আরও গুজব ছিল, এমন একটি অভিজাত, উঁচু বংশীয় আর সুন্দরী মেয়েকে সে দূর থেকে ভালবাসত— সে ঘুণাক্ষরেও নাকি ধারণা করতে পারেনি, কোনো উন্মাদপ্রায় কবি তাকে ভালবেসে লিখে ফেলেছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতাবলি। এই গুজবের রেশ এখনও রয়ে গেছে।”

আসলে গায়ত্রী সম্পর্কে ক্রাশ এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়া যে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার তা ধরতে পারেননি অরুণেশ। বোধিবৃক্ষের তলায় গৌতমবুদ্ধ উলঙ্গ হয়ে বসেছিলেন আমৃত্যু, কিন্তু তার জন্য তাঁকে তাঁর শিষ্যরা পাগল তকমা দেননি। একজন ভিখারিনীকে নিজের কাপড় খুলে দিয়ে উলঙ্গ হেঁটেছিলেন শিষ্যদের সঙ্গে, তার জন্য তাঁকে পাগল বলা হয়নি। সম্প্রতি হরিয়ানা বিধানসভায় জনৈক উলঙ্গ দিগম্বর জৈন সন্ন্যাসী বক্তৃতা দিয়েছিলেন; তাঁকে কেউ পাগল বলেননি। মহাবীরও উলঙ্গ বসে সাধনা করেছিলেন, শিষ্যদের বাণী শুনিয়েছেন, তার জন্য কেউ তাঁকে সমাজবহির্ভূত উন্মাদ মনে করেনি। কবিদের বোধিপ্রাপ্তির পথে যাত্রাকে তাহলে কেন পাগলামি ইত্যাদি বলা হবে! এই বিপর্যয় এনেছে আধুনিকতাবাদী শিক্ষা, ইউরোপের সংস্কৃতি। ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতবর্ষে পাগলাগারদ বলে কিছু ছিল না।

গণিতের অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র ঘোষও মনে করেন যে, গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে অহেতুক মিথ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। ‘গায়ত্রীকে’ নামকরণ তিনি সম্পৃক্ত করেছেন হিন্দু ধর্মের গায়ত্রীমন্ত্রের সঙ্গে, যে মন্ত্রটি দ্বারা উপনয়নের সময়ে সদ্যব্রাহ্মণকে দীক্ষিত করা হয়। তিনি ‘সৃষ্টিসন্ধান’ ওয়েব-পত্রিকায় লিখেছেন যে, “বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থটি বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬১ সালে চোদ্দটি কবিতা নিয়ে বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে’ নামের কবিতার বই প্রকাশিত হয়। চোদ্দর সঙ্গে আরও তেষট্টিটি কবিতা যোগ করে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থ। ‘ফিরে এসো, চাকা’ নাম পালটিয়ে একই কবিতাগুচ্ছ নিয়ে ১৯৬৪ সালে নতুন নামে প্রকাশিত হয় ‘আমার ঈশ্বরীকে’। নামকরণের কারণেই গায়ত্রী চক্রবর্তী-চাকা-ঈশ্বরী সম্পৃক্ত হয়ে এক মিথের জন্ম দিয়েছিল এবং গাণিতিক চেতনার কবির বিশ্লেষণাত্মক ছন্দময় কাব্যপ্রবাহকে ‘হতাশাজনিত মস্তিষ্কবিকৃতি’, ‘ব্যর্থ প্রেমিকের পাগলের প্রলাপ’ প্রভৃতি উক্তি দ্বারা অভিহিত করে কবি বিনয় মজুমদারের কাব্যভাবনার মূলকে সৃষ্টির আড়ালে রাখার সচেতন বা হেঁয়ালি প্রয়াস দেখা যায়। অনেক সময়ে মিথ যেন সত্য মনে হয়:

‘কী রহস্য যেন সর্বদা আমাকে ঘিরে রাখে’। ‘রহস্য’ কবিতার এই পঙক্তিটি যেন কবি বিনয় মজুমদারের নিজের জীবনযাপন, কাব্যকৃতি, প্রেম-বাসনা, বিষাদ-আনন্দের অনুরণন। তাঁর কবিতায় জননপ্রক্রিয়া, পদার্থবিদ্যা, বীজগণিত, কফিহাউস, পড়শি রঞ্জিত, পীযুষ ডাক্তার, কৃত্তিবাস, হাংরি আন্দোলন, বাবলা গাছ, লাঙল, হারাধন, বুচি, জীবনানন্দ, বাবা, মা, মানসিক হাসপাতাল, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, মঘা তারা, রেবতী, কৃত্তিকা, ছন্দভাবনা, সমাজভাবনা, সরস্বতীপুজো, সব একাকার হয়ে গেছে। সেখানে কোনো কাব্যের নামকরণ বা কাব্যভাবনাকে বিশেষ কৌণিক বিন্দু থেকে মূল্যায়ন করলে মিথ আরও মিথের জন্ম দেবে। বিনয় রহস্য উন্মোচনে তাই বড়ো বেশি সাবধানী হওয়া বোধহয় শ্রেয়:

তাকাই সামনে সোজাসুজি
ব্যাকুল আশায় তাকে খুঁজি।

যিনি ব্যাকুল আশায় তাঁকে খোঁজার প্রয়াস চালিয়েছেন, সম্ভবত সেই বিনয় মজুমদারকে খুঁজতে দুচোখ ধারালো করা প্রয়োজন এবং এ-কাজে কোনো মিথের শিকার না হয়ে মনে রাখা দরকার, সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো। কেননা বিনয় মজুমদারের কথায়:

নিষ্পেষণে ক্রমে-ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত।

এ তো বিনয়ই শিখিয়েছেন। তাই মিথ নয়, যুক্তসমীকরণে বিনয়-প্রতিভার সন্ধান চালানো ভালো:

যে কোনো গণিতসূত্র নিয়ে তার পরবর্তীদের
বাঁপাশে আনার পরে সে সমীকরণে
সমান চিহ্ণের পরে— ডানপাশে শূন্য হয়ে যায়।
এইভাবে কতিপয় যত খুশি সূত্র নিয়ে এগুলির বামপার্শ্বগুলি
গুণ করে শুধুমাত্র একটি সমীকরণ সহজেই পাই
এবং ডানপার্শ্বে শূন্য শূন্যের সমান
সদ্য উল্লিখিত এই একটি সমীকরণ জ্যামিতিতে রূপায়িত হলে
অনেক পৃথকরূপ পৃথক পৃথক চিত্র পাওয়া যায় সর্বদাই পাই।
মূল সমীকরণের — আলাদা আলাদা সব সমীকরণের
আলাদা সকল চিত্র একীভূত সমীকরণের
জ্যামিতিক রূপায়ণে তার মানে পাওয়া যায় অনেক সূত্রকে
একীভূত করা যায় কেবল একটিমাত্র করে ফেলা যায় ।
তাতে আমাদের কিছু লাভ হয় এখানে আমার বৌ রাধা
এই লিখে রাখা ভালো সবার অবগতির জন্যই নিশ্চয়।

নারায়ণচন্দ্র ঘোষ আরও বলেছেন যে, “প্রকল্পিত সমীকরণের পদ্ধতি অজানা থাকলে রাধার একীভূত সত্তার প্রসঙ্গ সহজবোধ্য হয় না। অজানা থেকে যায় রূপময়তার পরিসরে আলাদা হয়ে যাওয়া, আলাদা থাকা, বহুময়তা আর সমন্বয়, সমাবিষ্ট, একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাসূত্র— ভেদ ও অভেদের গমনপথ, পারস্পারিকতার রহস্য। বিনয়কে বুঝতে হলে, বিনয়ী হয়ে বলা ভালো, গাণিতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি; অন্যথায় মিথ মিথের জন্ম দেবে; বিনয় কেবলমাত্র অবিনশ্বর প্রেম কাহিনির প্রতীক হয়ে থাকবেন। মিথপ্রেমীদের পথ তখন মহাশূন্যের কোটরে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হবে। গণিতবিদ নারায়ণবাবু তাই পৌরাণিক মিথে টেনে নিয়ে গেছেন বিনয়ের ‘চাকা’কে। তিনি বলেছেন, সুদর্শন চক্রের আবহমণ্ডলে ভারতবাসী তথা বাঙালির অবস্থান। কত না মিথ সুদর্শনচক্রকে উপলক্ষ্য করে। অশোকচক্র, সেও কি কম কথা। উপনিষদে বর্ণিত সত্যচক্র হলো একটি ত্রিমুখী সিংহের পায়ের নিচে একটি ছোটো চক্র আর মাথার উপরে আরেকটি বড়ো চক্র। এর অর্থ হলো, পশুশক্তি সত্যকে দমন করতে চাইলে সত্য আরও বড়ো আকার নিয়ে পশুশক্তির ঊর্ধ্বে নিজের স্থান করে নেয়।”

বলা বাহুল্য, নারায়ণবাবুর এই যুক্তি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। বিনয়ের কবিতায় পুরোহিততন্ত্র ও ব্রা্হ্মণ্যবাদের প্রতি খোঁচা বেশ কয়েকটি কবিতায় ও সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। কবি জুবিন ঘোষ ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার ২০১৬ সালের একুশে জানুয়ারি সংখ্যায় বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনাকালে নারায়ণ ঘোষের বক্তব্যকে আরও প্রসারিত করেছেন গায়ত্রীমন্ত্র ও ষটচক্রের প্রেক্ষিতে। তিনি বলেছেন যে, গায়ত্রী শুধুমাত্র একটা মন্ত্র নয়, এটা হিন্দুদের একটা পরম সাধিত স্তব। যার সুর অমর। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে ‘ভক্ত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থাকুর লিখেছেন, “একদিকে ভূলোক, অন্তরীক্ষ, জ্যোতিষ্কলোক, আর একদিকে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের চেতনা— এই দুইকেই যদি এক শক্তি বিকীর্ণ করছে, তার এই শক্তি বিশ্বের মধ্যে এবং আপনার বুদ্ধির মধ্যে ধ্যান করে উপলব্ধি করবার মন্ত্র হচ্ছে গায়ত্রী।” বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতার শেষ কয়েক পঙক্তির মধ্যে বলেছেন, “আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” সেখানে এক অমরতার চিহ্ণ পাই সকল আকাশে বিচরণ করার শক্তির মধ্যেই। গায়ত্রী স্তবের সুর যা ‘জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে’ আসে হিন্দুদের কাছে। এই অমরতা যা মন্ত্রের সুরেই সম্ভব। স্বর না থাকলেও সুর থেকে যায় অনাদিকাল, পুনরাবিষ্কার হয় তার। সেই গায়ত্রী শব্দোচ্চারণের সুরেই বিনয় বলেছেন, “লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” এখন বেদমন্ত্রের আলোকে দেখা যাক ‘ধী’ কী! সূর্যের কল্যাণতম তাপ মানবের ব্যক্তিচৈতন্যের উপরে বেগ সৃষ্টি করে জ্ঞান, আত্মা বা ‘ধী’ এর পরিস্ফূটন ঘটায়। এই ‘ধী’, যা মানুষের আত্মশক্তিকে তেজপূর্ণ করে, সূর্যের অমৃতজ্যোতির সঙ্গে সাযুজ্যতা দিয়ে থাকে। ‘ধী’ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের ২/৪০/৬ ঋক বলছে, ‘ধিয় পূষা জিম্বতু বিশ্বামিত্রো রয়ি সোমা রয়িপতির্দাধতু।’ মানে হলো, সব জীবনের ধ্যানে, মননে, চিন্তনে রয়েছেন পূষা, তিনিই ‘ধী’ যা সবার ধ্যানচৈতন্যের স্ফূরণ করে, সোমলতাকে ‘ধী’ রসবন্ত করে। গায়ত্রী স্তবেও বলছে ‘ধিযো নঃ প্রচোদয়াৎ’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই ধ্যানকে উপলব্ধি করতে হয়, আবিষ্কার করতে হয়, তাই তো ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় বিনয় লেখেন, ‘দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।’ গায়ত্রীমন্ত্র একবার মনস্থ করে হয় না, তাকে ধীরে ধীরে ১০ থেকে ১০৮ বার করতে হয়। বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় লেখেন, ‘নিমেষেই/গলধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/তৃপ্ত হই’— এই ধীর স্বাদ গ্রহণের চমৎকার অবস্থায় প্রকৃত সাধক বিনয় মজুমদার ‘পরাবর ব্রহ্ম’ দর্শন করেন। দর্শনের শেষে যা আসে তা দেব দর্শনের মতো মিলিয়ে যায়, শরীর সাকার হয় না, চিত্ররূপ থেকে যায় মনে, ‘প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি/চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি’ (ভালোবাসা দিতে পারি— ১৮.৫.৬২)। এভাবে স্তব বা বেদমন্ত্রে গায়ত্রী জীবন্ত মানুষী হয়ে ওঠেন। ঠিক যেমন গায়ত্রীমন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে এক অপূর্ব আলোর পরিস্ফূরণ, স্রোতের তরঙ্গশীর্ষে রয়েছে উত্তরণের সাংকেতিক লিপি। লক্ষ-কোটি মুহূর্তের প্রবাহে যিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে এই শক্তিকে আত্মস্থ করেন, তিনিই যোগী। ‘ধী’ অর্থাৎ বোধ আমাদের রক্ষা করছে। বোধের পূজারী হলেন বিনয় মজুমদার। তিনি বারবার গায়ত্রীর মূল রসকে সেই স্তরের ব্যাখ্যায় অন্তস্থিত মর্মে পদার্পণ করেছেন। ‘ধী’ ও গায়ত্রীকে মিশিয়ে দিয়েছেন কাব্যের আধ্যাত্মিকতায়।

জুবিন ঘোষ আরও বলেছেন, এবং যা বলেছেন, খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বিনয়ের ‘বাল্মীকির কবিতার’ ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য, যদিও জুবিন ঘোষ ‘বাল্মীকির কবিতা’র পপসঙ্গ তোলেননি এখানে। জুবিন বলেছেন, “ফিরে এসো, চাকা’ তো সভ্যতার প্রধান চক্র, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা গড়িয়ে এগিয়েছে, আর চক্র মানেই ‘ষটচক্র’। সেখানে দেখব রয়েছে: ১. মূলাধারচক্র; ২. সাধিষ্ঠচক্র; ৩. মণিপুরচক্র; ৪. অনাহতচক্র; ৫. বিশুদ্ধিচক্র ও ৬. আজ্ঞাচক্র। এই চক্রের পুনঃসাধনার কথাই বলেছেন কবি বিনয় মজুমদার। এতো সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক গভীরতার দিকে এগিয়েছে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’, যাকে বলতে পারি ফিরে এসো চক্র— সভ্যতার সাবলীল গতিসমূহ মানবদেহের সাবলীল সাধনাসমূহ। মূলাধারচক্র সাধনায় মানুষের বাসনা সিদ্ধ হয়— সে মুক্তি লাভ করে। বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’-এ বলছেন, ‘কাকে বলে নির্বিকার পাখি/অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়/উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে/…/আমি মুগ্ধ ; উড়ে গেছ ; ফিরে এসো চাকা। এই মুগ্ধ উড়ে যাবার মধ্যে মুক্তির স্বাদ। মুগ্ধতার অর্থ বাসনা পরিতৃপ্তির ফল। এই মুগ্ধ উড়াল আমরা বারবার পাই ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রথম কবিতাতেই, ‘একটি উজ্বল মাছ, যা ১৯৬০ সালের ৮ মার্চ লেখায় আশ্রিত — ‘একটি উজ্বল মাছ একবার উঠে/দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেল/এই স্মিত দৃশ্য দেখে বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হল ফল/…/বিপন্ন মরাল ওড়ে অবিরাম পলায়ন করে।’ আবার ‘কাগজ কলম নিয়ে’ (১৪/১০/১৯৬০) বিনয় লিখছেন, ‘তবু কী আশ্চর্য দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার সেই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়।’ এই ওড়াটাই হলো মুক্তির আর্কিটাইপ, উড়ে যেতে চাইছে সব ছিন্ন করে, মুক্তি পেতে চাইছে বাসনা তৃপ্ত করে, যা মূলাধারচক্র সাধনার মূল রস , যা আবার ফিরে এসেছে ‘মুকুরে প্রতিফলিত’ (২৬/৮/১৯৬০) কবিতায়, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’ এভাবেই ঈচ্ছিক মুক্তির পথে বার বার তাঁর কলম লিখে চলেছে মূলাধারচক্রের সার কথা। মণিপুরচক্র বলছে যে, এই সাধনার ফলে সাধক অন্যের শরীরেও প্রবেশ করতে পারেন, যেভাবে ‘আমার আশ্চর্য ফুল যেন চকোলেট এক বস্তুস্থিত অবস্থান থেকে অন্য বস্তুস্থিত অবস্থানে চলে যাচ্ছেন কবি। স্বচ্ছ জলে মিশে যাওয়াটাই মণিপুরচক্র। প্রায় প্রত্যেক কবিতায় এই বৌদ্ধিক সাধকের মিশে যাওয়াটাই অনুভব করতে হয়। একটা চিত্র বারবার অন্য চিত্রের সঙ্গে, অন্য আর্কিটাইপের সঙ্গেমিশে যাচ্ছে। বিশুদ্ধিচক্রে পরমযোগী হবার সাধনা বার বার তাঁর কাব্যে এসেছে, যেমন ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে’। এমন তো একজন প্রকৃত ঋষিই পারেন, পরম সাধকেই তো তিনি উত্তীর্ণ।”

জুবিন ঘোষ বাসনা পরিতৃপ্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমরা বিনয়ের ভুট্টা সিরিজ কবিতাতেও পাই। সেই কবিতাগুলোয় একটি আশ্চর্য ফুল রূপান্তরিত হয়েছেন একজন রক্তমাংসের ফুলে। হিন্দু তন্ত্রসাধকদের মতো বিনয়ও আশ্রয় নিয়েছেন রক্তমাংসের অভিজ্ঞতায়। বিনয় তাঁর জাগতিক অভিজ্ঞতাকে অসম্পূর্ণ রাখতে চাননি, যা তিরিশের মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। ভুট্টা সিরিজের কবিকে আমরা হিন্দু তন্ত্রসাধকদের অন্বেষণের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যাঁরা তনুমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতেন। দেবীর আধারে নির্বাচিত সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌন একাত্মের মাধ্যমে জরা, ব্যাধি, বার্ধক্য, মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতেন; মৃত্যুঞ্জয়ী ও ভয়জয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করতেন। হিন্দু ও বৌদ্ধিক তান্ত্রিকদের যৌন একাত্মতা ছিল দেহ ও মনের পরস্পরের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বুনন, পুরুষের সঙ্গে নারীর, মানবের সঙ্গে দৈবের। বিনয় মজুমদার রক্তমাংসের ঈশ্বরীকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর রাধায়। সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য বিনয় মজুমদার স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চেয়েছেন, বোধিপ্রাপ্ত, এবং চেয়েছেন শেষতম শান্তি, যাতে মন থেকে যাবতীয় নোংরা বিদায় নিয়ে তাঁকে বামাক্ষ্যাপার স্তরের বোধিতে উন্নীত করতে পারে। অরুণেশ ঘোষ, জুবিন ঘোষ ও নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, এবং তাঁদের মতো আরও অনেকে বিনয়ের কবিতায় গায়ত্রী চক্রবর্তীর অস্তিত্ব নস্যাৎ করতে চাইলেন কেন বোঝা কঠিন। বিনয়ের ইনটারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আরও ছাত্রী ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। গায়ত্রীর নামটিই কেন তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণে এলো? পুরাণের নানা রকমের চক্র বিনয়কে ‘ফিরে এসো, চাকা, অথবা ‘গায়ত্রীকে’ অথবা ‘আমার ঈশ্বরীকে’ নামকরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এরকম ভাবতে খটকা লাগে। বিনয় যদি ব্রাহ্মণ পরিবারের বা উচ্চবর্ণের সন্তান হতেন তাহলে না হয় কিছু যুক্তি দেয়া যেতে পারত।

তরুণ বয়সে কোনো কিশোরীর প্রতি ক্রাশ যদি হয়েই থাকে এবং তা যদি মনের গভীরে বাসা বেঁধে তরুণটিকে সেই কিশোরীকে নিজের কবিতায় তুলে আনতে প্ররোচিত করে থাকে, সেটাই তো বরং স্বাভাবিক মনে হয়। তবে বিনয় নিজেই বলে গেছেন যে লিখিত কবিতার ভেতরে যা লুকিয়ে থাকে এবং পরবর্তীকালে তাকে পাঠ করলে যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় তাহলে তা কবিতাটির অন্তর্গত ‘অতিচেতনা’; এই অতিচেতনা এবং অতিসত্য গণিতে থাকে, যে কারণে একই গণিততন্ত্র পরবর্তীকালে আরেকজন গণিতবিদের জন্য অন্য পথের দিশারী হয়ে ওঠে। তাই নারায়ণবাবু ও জুবিনবাবুর যুক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা উচিত হবে না, তাঁরা বিনয়-কথিত ‘অতিচেতনা’ আবিষ্কার করেছেন তাঁর কবিতায়। চলবে