বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ১৪

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০১৯

নয়.
একজন কবির সঙ্গে জনসাধারণ কেমনতর আচরণ করে তা আমরা কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে দেখেছি। তাঁর জন্মদিন এলে তাঁকে বিয়ের বরের মতন কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করা হতো। অথচ কবি কিছুই বুঝতে পারছেন না। ভ্রাতৃতুল্য ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা হলো সম্পর্কের একটি প্রাগৈতিহাসিক আচারানুষ্ঠান। কবিরা এই সামাজিক শোষণপদ্ধতি থেকে পরিত্রাণ পান না, বিশেষ করে তাকে যদি মনে করা হয় মস্তিষ্কবিকৃত একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি। জন্মদিন পালন এই আচারানুষ্ঠানে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতা ও অবমাননার উৎসব, যাতে অংশগ্রহণ করে লোকটিকে হেনস্থা করা হয়, এবং প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে মানুষটিকে সমভোগতান্ত্রিক বারোয়ারি পীঠস্থানে বসিয়ে হাস্যকর করে তোলা হয়। প্রতিভাবান মানুষকে নিষ্ঠুরতার অস্ত্র প্রয়োগ করে রোমান্টিসাইজ করার এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা। বিনয় এটি বুঝতে পেরেছিলেন, আর সে কথা তাঁর ‘কয়েকটি কবিতা’র ছয় সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন:

আমার জন্মদিন পালন করত আগে
কয়েক বছর আগে।
আহ্বায়ক ছিল অমলেন্দু বিশ্বাস নৌকা পত্রিকার সম্পাদক।
দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হতো–
‘১৭ই সেপ্টেম্বর কবি বিনয় মজুমদারের
জন্মদিন পালন করা হবে, আপনারা দলবেঁধে আসুন
শিমুলপুরের কবির বাড়িতে।’
অনেকেই আসত। এসে কবিতাপাঠ গানবাজনা
ইত্যাদি করত। এই অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়াও হতো।
কয়েক অতিথি আমার প্রতি সদয় ছিল না–
আমাকে কতবার মানসিক হাসপাতালে
নেওয়া হয়েছিল সেই কথা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে
আলোচনা করত। তাতে আমি মনে খুব ব্যথা পেতাম।
ফলে আমি আমার জন্মদিন আর পালন করতে দিই না।
আমার জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে গেছে।

কবিতাটি থেকে স্পষ্ট যে, আয়োজকগণ এবং যারা কলকাতা থেকে গিয়ে শিমুলপুরে জড়ো হতেন, তারা গোপনে একজন প্রতিভাবান স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগির রোগটিকেই উৎসবে বদলে দিয়ে নিজেরা আনন্দ করতে চাইতেন। কবিকে মনে করিয়ে দিতেন যে, তিনি কতবার মানসিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছিলেন, যেন মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকা একজন দ্রষ্টা কবির বৈশিষ্ট্য। তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া হতো যে তাঁর অসুস্থ জীবনের আরেকটি বছর হাতছাড়া হয়ে গেল। নিজের জন্মদিনে জড়ো হওয়া লোকগুলো সম্পর্কে যিনি এরকম কবিতা লিখতে পারেন, তাঁকে কি মানসিক অসুস্থ বলা যায়! ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ (২০০৩) কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “কবিতীর্থ প্রকাশিত ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ গ্রন্থের প্রায় সব কবিতাই হাসপাতালে থাকাকালে লিখেছি। একটা কথা আমি দিনে তিনচার বার বলি, সবই সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা। এবারেও তাই লিখি। আমাকে হাসপাতালে পুড়ে সৃষ্টিকর্তা কী পরীক্ষা করলেন কে জানে! কী দুরূহ পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে এবং পাঠকপাঠিকাগণের কাছে। পরীক্ষায় পাশ করেছি বোঝা যায়।”

“কবিতা লেখা আমি মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিই। তখন এমন-এমন কাণ্ড ঘটে যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই। এই বইখানাও তেমনি জোর করে লেখানো। কবিতা না লিখে বছর চারেক ছিলাম। তারপর আমাকে হাসপাতালে পুড়ে কাগজ এবং কলম দিয়ে আমাকে বলা হলো— ‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে নচেৎ নয়।’ তার ফলে আমি লিখেছি ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ বইখানা।” স্কিৎসোফ্রেনিয়ার নিরাময় হিসাবে হয়তো মানসিক চিকিৎসকরা তাঁকে কবিতা লিখতে বলতেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির নিষ্ঠুরতা বিষয়ে বিনয় একটি কবিতা লিখেছেন, শিরোনাম ‘কিছু কিছু কবির’। এই কবিতাটিতে বিনয় মজুমদার দেখিয়েছেন যে মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে যত বেশি পারা যায় কবির প্রত্যাদেশ ছেঁকে বের করে আনার চেষ্টা করেছিল সমবেত জনগণ। রবীন্দ্রনাথের সেই মুহূর্তের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের কবিতাকে দ্রষ্টার দিব্যদৃষ্টি করে তোলার চেষ্টা হয়েছিল, যাকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘বাণী’। একজন কবি, যিনি মানবজীবনের অস্থিরতা সম্পর্কে চিরকাল চিন্তা করে গিয়েছেন, তাঁকে মৃত্যুশয্যায় একটি স্বয়ংক্রিয় দিব্যদৃষ্টির যন্ত্রে পালটে ফেলার চেষ্টা হলো। এখনকার দিন হলে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হতো, টিভি সাংবাদিকরা ক্যামেরা মাইক নিয়ে পৌঁছে যেত আর জানতে চাইতো তিনি কেমন ফিল করছেন! বিনয়ের ক্ষেত্রেও, “মানসিক হাসপাতাল থেকে ফেরা” কিংবা “মানসিক হাসপাতালে প্রতিভাবান কবি বিনয়” নাম দিয়ে মোবাইলে তোলা হয়ে থাকবে হয়তো।

কিছু কিছু কবির সঙ্গে বাঙালিগণ

খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন; এবং মনে হয়
ভবিষ্যতেও করবেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায়
হাত নাড়তে পারছিলেন না
তখনো বাঙালিগণ দাবি করলেন যে,
রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে একটি কবিতা বলুন
সেই কবিতা কাগজে লিখে নেবেন অন্য একজন।
অগত্যা রবীন্দ্রনাথ কবিতা বললেন এবং
তা লিখে নিলেন একজন শ্রোতা।
এই হলো রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা।

দাদা সমীর রায়চৌধুরী ‘অপর’ তত্ত্বটি বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে পুরাণ থেকে ‘সংজ্ঞা’ নিরূপণ আলোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, মার্কণ্ডেয় পুরাণে সংজ্ঞা বিশ্বকর্মার মেয়ে আর সূর্যের স্ত্রী। সংজ্ঞাকে নিয়ে যে আখ্যান তা থেকে জানা যায় কখন তিনি চোখ বোজেন, আর কখনই বা চপলভাবে দৃষ্টিপাত করেন, আবার কখনও চোখ মেলে পরম মিলনে প্রস্ফূট হয়ে ওঠেন। এই অবলোকন বদলের ওপর নির্ভর করে কখন তিনি সংযমনকারী যমকে প্রসব করবেন, আর কখনই বা প্রসব করবেন চঞ্চলাস্বভাবা নদী যমুনাকে, আবার কখন জন্ম দেবেন যুগলদেবতা অশ্বিনীকুমারদের। অশ্বিনীকুমার যম নন, তবে যমজ, সৌন্দর্যের অধিকারী আর নিরাময়ে পারদর্শী— স্বর্গবৈদ্য; বিশ্বচরাচরের মহাপারিবারিক আসঙ্গযুক্ত দ্বিপাক্ষিক শঙ্খিলতার মহাপরিপূরকতা বজায় রাখা যাঁর ধর্ম। চোখ মেলে সংজ্ঞা আরও প্রসব করেন রেবন্ত, যিনি সর্বদা সংঘর্ষে, প্রতিবাদে উদ্যত। যিনি পূর্বের ক্লেদ অপসারণ করে নবীনতাকে প্রশ্রয় দেন। এই আখ্যান বিনয় মজুমদারকে সংজ্ঞায়িত করে, অবলোকন ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি জগতসংসারের বিশাল স্পেকট্রামকে পাঠকের সামনে মেলে ধরেন।

‘আজকের পত্রিকা’র ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় বীরেন মুখার্জি লিখেছেন যে, বিনয় মজুমদার একজন ইনট্রোভার্ট বা আত্মমুখিনতার রূপদক্ষ শিল্পী— অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ, স্বগতোক্তি কিংবা আত্মকথন যা শান্তরস-সিক্ত তা রয়েছে তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’ পর্যায়ের কবিতায়— তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক, তাঁর কবিতার সুর তন্ময় ব্যক্তিগত কিংবা মন্ময় বস্তুগত; তাঁর কাব্যবোধ তাঁর প্রেমিক সত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত। তবে বীরেন মুখার্জি মনে করেন যে, বিনয় মজুমদারের ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ পাঠে তাঁকে ‘কামোন্মাদ’ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্থাপন করলেও, তা অত্যন্ত নিচুস্বরে, যেমন:

কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে, ক্রমাগত
ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন ঘুম পাড়াবার সাধ করে।

বিনয় মজুমদারকে নানা ধরণের উন্মাদের তকমা দেয়া হয়েছে দেখে বীরেন মুখার্জি সম্ভবত ‘কামোন্মাদ’ তকমাটি ধরিয়ে দিলেন। ‘কামোন্মাদ’! এরকম ভয়ঙ্কর আরোপ আর হয় না, যেন বিনয় একজন গ্রিক দেবতা স্যাটারিয়াসিস। বিনয় নিজেই বলেছেন যে তিনি ‘ইরোটিক’ কবিতা লিখতে চান, কেননা ইরোটিক কবিতা লেখার যে চল ইংরেজরা আসার আগে ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। কথাটা সত্যি। শ্রীরামপুরের পাদরি আর ম্যকলে সাহেবের ভিকটোরিয় শিক্ষাপদ্ধতির দরুণ প্রাগাধুনিক বাংলার ধারা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেওয়াকে মধ্যবিত্ত বাঙালি গৌরবের ব্যাপার মনে করেছে বহুকাল, তার ওপর ব্রাহ্মধর্মের হাস্যকর রক্ষণশীলতা মিশে সেই ধারাকে সম্পূর্ণ তামাদি করে দিয়েছে। ইংরেজি ভাষার কবি নন বলে ওভিদ, কাতুল্লুস, সেক্সটাস প্রোপার্টিয়াস, পেত্রার্ক, পিয়ের লোয়ুস, গ্রেগোরিও দে মাত্তোস, হিল্ডা হিলর্স্ট, গ্লাউকো মাটোসো, ভিনি করেয়া, ম্যানুয়েল মারিয়া প্রমুখ বাদ গেছেন আমাদের বিদ্যায়তনিক জগৎ থেকে। ইংরেজিতেও কবিরা লিখেছেন, যেমন চার্লস সুইনবার্ন (লাভ অ্যাণ্ড স্লিপ), রবার্ট হেরিক (আপঅন জুলিয়াজ ক্লোদস), ই ই কামিংস (মে আই ফিল সেড হি), ডাবলিউ এইচ অডেন (দি প্ল্যাটনিক ব্লো), জন ডান (টু হিজ মিসট্রেস গোইং টু বেড), এমিলি ডিকিনসন (কাম স্লোলি ইডেন), ওয়াল্ট হুইটম্যান (আই সিং দি বডি ইলেকট্রিক), হার্ট ক্রেন (ভয়েজেস) ইত্যাদি। ইংরেজরা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করে গেছে, তা হলো আমাদের সনাতন রসশাস্ত্রকে লোপাট করে দিয়ে নিজেদের ভাষার অলঙ্কার বাংলা ভাষায় চাপিয়ে দেয়া।

বাংলা সাহিত্যে ইরটিক কবিতা লেখার ঐতিহ্য ছিল। জেমস লঙ-এর কুযুক্তির দরুণ বটতলা সাহিত্য বিলুপ্ত হতে সময় লাগেনি। চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, সপ্তদশ শতকের শুকুর মামুদের গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস ইত্যাদি। বহু আলোচক বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’র পর আর তাঁর কাব্য বিশ্লেষণে এগোন না, তাঁদের মধ্যমেধা-মধ্যবিত্ত মননে চোট লাগে। নৈসর্গিক বর্ণনার মাধ্যমে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্থে যে যৌনতা আছে তা হয়তো বহু পাঠক ধরতে পারেন না, কিন্তু ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের ভুট্টা সিরিজে ও ডালাসারির কবিতায় গিয়ে তাঁদের মধ্যবিত্ত চেতনা আক্রান্ত হয়। ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের পরেও বিনয়ের কবিতার বই বেরিয়েছে, ছোটো গল্পের বই বেরিয়েছে, সেগুলো নিয়ে আগ্রহ দেখা যায় না তাদের! কবিতা লিখে আনন্দের কথা বলেছেন বিনয়, তা যেমন কবিতাই হোক, তাঁর ‘কবিতালেখা’ নিবন্ধে, “তুমি কষ্ট পাচ্ছো সেই কষ্টের কথা লিখে তুমি আনন্দ পেতে পারো। সৃষ্টির ব্যাপারে এই আনন্দটা তিন স্তরে বিভক্ত। লেখার আগে একটা জিনিস ভাবতে হচ্ছে, তখনকার আনন্দ একরকম; যখন লিখছি তখন আরেকরকম, আর লেখার শেষে আরেকরকমের আনন্দ। আনন্দ না থাকলে শিল্পসৃষ্টি হয় না।” তারপর যোগ করেছেন, “ময়ূর পেখম তুলে নাচে — আমরা দেবতারা মন খুলে কবিতা লিখি। ময়ূরের নাচের মতনই কবিতা লেখা ব্যাপারটা।” চলবে