বিবেকানন্দ ও বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান

পর্ব ২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২১

বিবেকানন্দ নানা সময়ে সুন্দর সুন্দর কথা বললেও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনারায়ণ বসুর চেয়ে খুব আলাদা কিছু ছিলেন না। বিবেকানন্দের লেখা থেকে তার প্রমাণ মিলবে। বিবেকানন্দের মূল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে পরিচিত হন। স্বামী বিবেকানন্দ নামেই তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন ‘স্ত্রী-শিক্ষা’। বিবেকানন্দের বেশির ভাগ লেখা ইংরেজিতে, সামান্য কিছু বাংলায়, বাংলা লেখার মধ্যে একটি ‘স্ত্রী-শিক্ষা’। প্রবন্ধে তিনি স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছেন। বিবেকানন্দকে তাই খুব প্রগতিশীল মানুষ বলেই প্রথমে ভ্রম হতে পারে। তিনি স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ভারতের অধঃপতন হইল, ভট্টাচার্য-ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণেতর জাতিকে যখন বেদপাঠের অনধিকারী বলিয়া নির্দেশ করিলেন, সেই সময়ে মেয়েদেরও সকল অধিকার কাড়িয়া লইলেন।’

বিবেকানন্দ নারীর সেই অধিকার পুনরায় ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। ভারতীয় নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন। তিনি নারীদের কোন্ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাচীন বৈদিক ধর্মের শিক্ষায় তিনি নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে চান। হিন্দুত্বের জাগরণবাদী বিবেকানন্দ চাইছেন, ভারতের সকল নারীরা হবে সীতার মতো পবিত্র। তিনি রাখ ঢাক না করে খুব স্পষ্ট করেই এ কথা বলেছেন যে, তাঁর কাম্য নারীরা হবেন সীতা সমতুল্য। প্রত্যেক ভারতীয় নারীকে ‘সীতা’র চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার জন্যই শিক্ষা দিতে হবে।

বিবেকানন্দ লিখেছেন, ‘ভারতীয় রমণীগণের যেরূপ হওয়া উচিত, সীতা তাহার আদর্শ; রমণীচরিত্রের যতপ্রকার ভারতীয় আদর্শ আছে, সবই এক সীতা-চরিত্রেই আশ্রিত; আর সমগ্র আর্যাবর্তভূমিতে এই সহস্র বর্ষ ধরিয়া তিনি এখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার পূজা পাইয়া আসিতেছেন। মহামহিমময়ী সীতা স্বয়ং শুদ্ধা হইতেও শুদ্ধতরা, সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত আদর্শ সীতা চিরকালই এইরূপ পূজা পাইবেন। যিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রদর্শন না করিয়া সেই মহাদুঃখের জীবন যাপন করিয়াছিলেন, সেই নিত্যসাধ্বী নিত্যাবিশুদ্ধস্বভাবা আদর্শপত্নী সীতা..। ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া আপনাদের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই ভারতীয় নারীর উন্নতির একমাত্র পথ।’

কট্টর মোল্লার মতো বিবেকানন্দ নারীর উন্নতির একমাত্র পথ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বিবেকানন্দের মতে নারীর উন্নতির আর কোনো পথ থাকতে পারে না। তিনি লিখেছেন, ‘সব পুরাণ নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, এমনকি আমাদের বেদ পর্যন্ত লোপ পাইতে পারে, আমাদের সংস্কৃতভাষা পর্যন্ত চিরদিনের জন্য কালস্রোতে বিলুপ্ত হইতে পারে, কিন্তু আমার বাক্য অবহিত হইয়া শ্রবণ কর, যতদিন পর্যন্ত ভারতে অতিশয় গ্রাম্যভাষাভাষী পাঁচজন হিন্দুও থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত সীতার উপাখ্যান থাকিবে। সীতা আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় প্রবিষ্ট হইয়াছেন, প্রত্যেক হিন্দু নরনারীর শোণিতে সীতা বিরাজমান।’

বিবেকানন্দের কথার মধ্যে সবজান্তার ভাব এবং স্পষ্ট পুরোহিতের কর্তৃত্বকামী সুর। তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, তিনি যা বলছেন তা বেদবাক্য, তার নড়চড় হতে পারে না। তিনি সব ইতিহাস জেনে বসে আছেন। কট্টর চিন্তার ধারক আর কাকে বলে! কিন্তু তিনি ভারতবর্ষেই বিরাট জ্ঞানী এবং শ্রদ্ধাশীল মানুষ। ভারতবর্ষে যেসব মানুষ হিন্দুধর্মের জয়গান গেয়েছে, তারাই সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গান্ধী আর সাভারকারের নাম একইভাবে সত্য। স্বয়ং গান্ধী রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আর গোরক্ষা করার আন্দোলনে যোগ দেয়ার পরেও, ভারতবর্ষে শ্রদ্ধাশীল মানুুষ। গান্ধীর তথাকথিত গোরক্ষা আন্দোলনের জন্য ভারতবর্ষে হাজার হাজার দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। তবুও গান্ধী কখনো ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া বলে পরিচিত নন। ভারতে বিজেপি আজ যা করছে, আরো অনেকের সঙ্গে মিলে গান্ধী তার বীজ রোপন করে গেছেন।

কিন্তু মুসলমানরা যখন কট্টর আচরণ করে তখন তাদের নামে তকমা লেগে যায়। মুসলমানরা তখন জঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান, জঙ্গী মুসলমানদের সমর্থন করার সামান্য কারণ নেই। খুব সত্যি কথা যে, জঙ্গী বা কট্টর মুসলমানরা ইতিহাসকে পিছনে নিয়ে যেতে চাইছে। সর্বদা তাদের সমালোচনা করবে প্রগতিশীল মানুষ সেটাই সঠিক পথ। কিন্তু বাকিরা কেন সমালোচিত হবে না? মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় নেতারা যদি কট্টর চিন্তার জন্য দায়ী হয়, ঘৃণিত হয়; ভিন্ন ধর্মের লোকরা তা হবে না কেন?

বিবেকানন্দ তাঁর প্রবন্ধে আর কী বলেছেন। তিনি ধারণা দিচ্ছেন, ‘ভারতীয় রমণীগণ সর্বাপেক্ষা উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, বিশুদ্ধস্বভাবা, পতিপরায়ণা, সর্বংসহা সীতার ন্যায় হওয়া। সমগ্র ভারতবাসীর সমক্ষে সীতা যেন সহিষ্ণুতার উচ্চতম আদর্শরূপে বর্তমান রহিয়াছেন। সীতা যেন ভারতীয় ভাবের প্রতিনিধিস্বরূপা, যেন মূর্তিমতী ভারতমাতা।..নারীগণের মধ্যে আমরা যে ভাবকে নারীজনিত বলিয়া শ্রদ্ধা ও আদর করিয়া থাকি সীতা বলিতে তাহাই বুঝাইয়া থাকে।’ তিনি বলছেন, ‘জাতির জীবনে পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের  আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে প্রথমত বৈবাহিক সম্বন্ধকে পবিত্র ও বিচ্ছেদহীন করিতে হইবে...হিন্দুগণ বিবাহকে পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য করিয়া বহু শক্তিশালী স্ত্রী-পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছেন। আরবদের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি চুক্তি, একটা বলপূর্বক অধিকারমাত্র; উহা ইচ্ছামত ভাঙ্গিয়া দেওয়া যাইতে পারে। সুতরাং আমরা তাহাদের মধ্যে ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণীর আদর্শ পাই না।..ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচারিণী সৃষ্টির জন্য সর্বসাধারণের বৈবাহিক জীবনকে পূণ্যময় করিয়া তোলা আবশ্যক।

এদেশে প্রত্যেক বালিকাকে সাবিত্রীর ন্যায় সতী হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে; মৃত্যুও তাঁহার প্রেমের নিকট পরাভূত হইয়াছিল। তিনি ঐকান্তিক প্রেম-বলে যমের নিকট হইতেও নিজ স্বামীর আত্মাকে ফিরাইয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। চলবে