বিবেকানন্দ ও বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান

শেষ পর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ০৯, ২০২১

তিনি সবার আগে স্থান দিয়েছেন ধর্মকে, ধর্ম মানে সনাতন ধর্ম। তিনি লিখেছেন, শিক্ষাই বলো আর দীক্ষাই বলো ধর্মহীন হলে তাতে গলদ থাকবেই। ধর্ম ভিন্ন অন্য শিক্ষাটা গৌণ হবে। ধর্মশিক্ষা, চরিত্রগঠন, ব্রহ্মচর্য-ব্রতোদ্যাপন; এই জন্য শিক্ষার দরকার। বর্তমানে ভারতে যে স্ত্রী শিক্ষা দেওয়া হয় তাতে ধর্মটাকে গৌণ করে রাখা হয়েছে; সেজন্যই শিক্ষার মধ্যে নানারকম দোষ দেখা দিয়েছে। স্ত্রীদের তাতে দোষ নেই, সংস্কারকেরা নিজে ব্রহ্মজ্ঞ না হয়ে স্ত্রী শিক্ষা দিতে অগ্রসর হওয়াতে এরকম দোষ ঘটেছে। আমি ধর্মকেই শিক্ষার সার বলে মনে করি। খুব স্পষ্ট বিবেকানন্দের বক্তব্য, তিনি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চাচ্ছেন না; তিনি চান ধর্মীয় শিক্ষা। বিবেকানন্দ যে কোনো বিচারেই একজন কট্টর ধার্মিক বা ধর্মান্ধ; বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মান্ধদের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর সামান্য পার্থক্য নেই। ধর্মান্ধদের মতো নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করাই তাঁর প্রধান কাজ। নিজধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পুরুষগণকে যাহা বলিয়া থাকি, রমণীগণকেও ঠিক তাহাই বলিব। ভারত এবং ভারতীয় ধর্মে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থাপন কর; তেজস্বিনী হও, আশায় বুক বাঁধ; ভারতে জন্ম বলিয়া লজ্জিত না হইয়া উহাতে গৌরব অনুভব কর; আর স্মরণ রাখিও, আমাদের অপরাপর জাতির নিকট হইতে কিছু লইতে হইবে বটে, কিন্তু জগতের অন্যান্য জাতি অপেক্ষা আমাদের সহস্রগুণে অপরকে দিবার আছে। দেশীয় নারী দেশীয় পরিচ্ছদে ভারতের ঋষিমুখাগত ধর্ম প্রচার করিলে, আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি এক মহান তরঙ্গ উঠিবে যাহা সমগ্র পাশ্চাত্যভূমি প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। বিবেকানন্দের সঙ্গে বাংলার ধর্মান্ধদের চিন্তার সামান্য পার্থক্য আছে কি? নিজধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করেই তিনি ক্ষান্ত নন, তিনি সারা পাশ্চাত্যভূমিকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করাতে চান। বর্তমানের জঙ্গী মুসলমান ধার্মিকরা যেমন সারাবিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান।

রামমোহন এবং তার পরবর্তী যুগটা ছিল হিন্দুত্ব বা বৈদিক যুগ নিয়ে গর্ব করা, প্রাচীন ভারতের সবকিছুকে বড় করে দেখা আর তথাকথিত হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের যুগ। কারণ আসলে ভারতে ‘হিন্দু’ বলে কোনো ধর্ম ছিল না, বৈদিক ধর্মকে তাঁরা হিন্দু নামকরণ করেছিলেন। কথাটা হলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যদি তৎকালীন বাংলার প্রগতিশীলতার লক্ষণ হয়, মুসলমানদের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কেন প্রতিক্রিয়াশীলতা হবে? সন্দেহ নেই, রামমোহন-বিবেকানন্দদের সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় বাড়াবাড়ির সামান্য পার্থক্য রয়েছে। রামমোহনরা একদিকে বিজ্ঞান চর্চার কথা বলে ভিন্ন দিকে ধর্মের পরিচয়কেই বড় করে তুলেছিলেন। ইংরেজদের কাছ থেকে পাওয়া পাশ্চাত্যের সকল আধুনিকতার সুবিধা নিতে ছাড়েননি, পাশাপাশি ধর্মীয় বিলাসিতা বাদ দেননি। নিশ্চয় সে বিচারে তাঁরা কিছুটা ভিন্ন পথের লোক। বাংলাদেশের বর্তমান কট্টরপন্থীরা ধর্মের জন্য বিজ্ঞানের সব সুফল বাতিল করার পক্ষে, রামমোহন আর বিবেকানন্দরা তা করেননি। রামমোহন-বিবেকানন্দরা ইংরেজি শিখেছেন, খ্রিস্টানদের জগতে গিয়ে নিজেদের বাণী প্রচার করেছেন। পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেননি। বাংলাদেশের বর্তমান কট্টরপন্থীরা নিজেদের দৃষ্টিটা কল্পিত আরবমুখী করে রেখেছেন। যদিও আরব-বিশ্ব ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সবটুকু গ্রহণ করছে, নিজেদের ক্রমশ পাল্টে ফেলছে।

রামমোহন বিবেকানন্দের সময়টা নিয়ে গোপাল হালদার খুব চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, বিশেষ সত্য লক্ষণীয় এই যে, উনিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতির কাঠামোই হিন্দু, তার প্রাণ কিন্তু বুর্জোয়া সংস্কৃতির। মধুসূদনের কথাতো নেই, বঙ্কিমও প্রাণপণে চাইছেন মিল, কোৎ-এর বাণীকে স্বদেশীয় কায়দায় রূপ দিতে। বুর্জোয়া সভ্যতার মূল সত্য কথা হলো মানবতাবাদ; ধর্মতত্ত্বের ভিতরে বঙ্কিম পাশাপাশি উপন্যাসে, প্রবন্ধে ধরতে চেয়েছেন এই সত্যকে; মানবতাবাদকে পুরতে চাইছেন ‘হিন্দু কাঠামোতে’। বুর্জোয়া প্রাণশক্তিকে বাঁধতে চেয়েছেন তাঁরা হিন্দুত্বের গৌরবের ভিতরে। ব্রাহ্ম ও উদারনৈতিক সংস্কারবাদীরা এ কাঠামোকে ততটা গুরুত্ব দিতেন না। তাঁদের ধর্ম আন্দোলন ও কর্ম আন্দোলনে তা অনেকটা স্পষ্ট। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা চাইতেন সেই জাতীয় আধারকে হিন্দু আধারে নতুন প্রাণ সঞ্জীবিত করতে। (গোপাল হালদার, ‘বাঙালি মুসলমান ও মুসলিম কালচার’)। মূলত সবকিছুর পর সেটা ছিল হিন্দুত্বের পক্ষে তরবারি ধরা। রাজনারায়ণ বসু খুব সম্মানিত মানুষ অবিভক্ত বাংলার। হিন্দুত্বের পক্ষে তিনি ‘সে কাল আর এ কাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি বিলাতে যাইবার প্রতিপক্ষ নহি। বিলাতে যাইলে অনেক উপকার আছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যাঁহারা বিলাত হইতে ফিরিয়া আইসেন, তাঁহারা হিন্দু সমাজের সহিত একেবারে সম্বন্ধ পরিত্যাগ করেন।’ সামান্য পরেই তিনি লিখেছেন, ‘কী এত মূঢ় হইয়াছি যে, ভারতমৃত্তিকার মঙ্গলপ্রসূনস্বরূপ ব্রহ্মপ্রতিপাদক বেদ বেদান্ত উপনিষদাদি শাস্ত্র ত্যাগ করিব? এই সকল ধর্মভাব, এই সকল ব্রহ্মজ্ঞানশাস্ত্র, যাহারা গুরু ভাবের সহিত শতকোটি বাইবেল, ইঞ্জিল, তওরেৎ, জবুর, কোরান ও আবেস্তা এবং র্পার্ক, নিউম্যান, কান্ট, কুজিন প্রভৃতির স্তূপায়মান সমতুল্য হয় না, তাহাতে আমাদের যে আত্মীয় ও স্বজাতীয় এই দ্বিবিধ অধিকার যুগপৎ আছে, তাহা মনে করিলেও পিতামহ পুরাণ পরমেশ্বরকে শত শত ধন্যবাদ প্রদান করিতে হয়।’ (রাজনারায়ণ বসু, ‘সে কাল আর এ কাল’)

লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে, রাজনারায়ণ অতীতকে বড় করে দেখেছেন যখন বেদ বেদান্তের প্রচুর চর্চা হতো। তিনি আরো বলছেন, বেদ বেদান্তের সমতুল্য আর কোনো গ্রন্থ নেই। তিনি কান্ট বা অন্যান্য মনীষীদের দর্শনকে পর্যন্ত বেদ-এর কাছে স্থান দিতে রাজি নন। তিনি তার পরের পংক্তিতেই লিখেছেন, ‘উল্লিখিত মহাশাস্ত্র সকলকে মূল করিয়া ধর্মসংস্কার কার্যে আমাদিগের প্রবৃত্ত হওয়া কর্তব্য। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের এমন কার্য নাই, উহার সম্বন্ধীয় এমন একটি বিশুদ্ধ মত নাই, যাহার প্রমাণ আমাদিগের শাস্ত্রে না পাওয়া যায়। ধর্ম বিষয়ে এমন একটি সদুপদেশ নাই, যাহা আমাদিগের ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না; সমাজ সম্বন্ধে এমন একটি সুরীতি নাই, যাহা প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল না, এবং যাহা এক্ষণে হিন্দুভাবে প্রচার না করা যাইতে পারে। হিন্দুভাব রক্ষা করিয়া আমরা ধর্ম ও সমাজসংস্কার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে, আমরা ওই কার্যে সুসিদ্ধ হইতে পারি।’

রাজনারায়ণ খুব জোরের সঙ্গে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করছে। রাজনারায়ণের সেই প্রচারের ভাষা কি বাংলাদেশের মৌলবাদী মোল্লাদের চেয়ে সামান্য রকম আলাদা? বাংলাদেশের ধর্মীয় মোল্লারা মনে করেন তাদের ধর্মগ্রন্থে সব কিছু আছে, একই রকম দাবি করছেন রাজনারায়ণ বসু হিন্দুদের ধর্মীয়গ্রন্থ সম্পর্কে। দুপক্ষের চিন্তার মধ্যে তাহলে পার্থক্য কোথায়? রাজনারায়ণ কেন তাহলে প্রগতিশীল মানুষের তকমা পাবেন আর বাংলাদেশের মোল্লারা কেন প্রতিক্রিয়াশীল তকমা লাভ করবেন? বাংলাদেশের মোল্লাদের যদি প্রতিক্রিয়াশীল ভাবা হয়, রাজনারায়ণ কেন তবে সেই একই রকম বক্তব্য রাখার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল বলে প্রমাণিত হবেন না? তিনি বুর্জোয়া চিন্তার আলোকে আলোকিত হয়েও, ধর্ম-প্রশ্নে বাংলার মোল্লাদের চেয়ে আলাদা কিছু নন। ধর্মান্ধ হয়েও ভারতের বিরাট আলোচিত মনীষী, বহু মানুষের পরম পূজনীয়। ধর্মান্ধ মহান বিবেকানন্দও ঠিক তাই।

বিবেকানন্দের পক্ষে অনেকে বলবেন, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার জন্যই তিনি ভারতীয় সনাতন ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান কট্টরপন্থীদের তাহলে দোষ কোথায়, মুসলমান কট্টরপন্থীদের বিদ্রোহ সাম্রা]জ্যবাদের বিরুদ্ধেই। প্রথম যুগে যা ভারতে ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তিতুমীর, হাজি শরীয়তউল্লাহ আর দুদুমিয়ার কৃষক আন্দোলন বা বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। বিবেকানন্দ সেরকম কোনো বিদ্রোহ করেননি ইংরেজ শাসকদের বিপক্ষে; বরং তিনি ইংরেজ শাসকদের নানাভাবে তোষণ করেছেন। তিতুমীর, হাজি শরীয়তউল্লাহ-দুদুমিয়ার ধর্মীয় আন্দোলন বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল বাংলার অপর বৃহৎ অংশ হিন্দু কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। তিতুমীর বা শরীয়তউল্লাহ হিন্দু-কৃষকদের অস্বীকার করেননি; ফলে হিন্দু কৃষকরা মুসলমান কৃষকদেরদের সঙ্গে দুটো আন্দোলনেই যুক্ত ছিল। তিতুমীর আর শরীয়তউল্লাহ ইসলাম ধর্মের বিশুদ্ধতার কথা বলেছেন কিন্তু ভিন্ন ধর্মের সমালোচনা করেননি। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন; তিতুমীর একথাও বলেন যে, কেবলমাত্র ধর্মের ব্যবধানের জন্য অ-মুসলমানদের সঙ্গে বিবাদ করা আল্লাহর পছন্দ নয় এবং দুর্বল অমুসলমানকে সাহায্য করা মুসলমানের কর্তব্য। তিতুমীর বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নন, তাদের সঙ্গে কেবল ধর্ম ব্যবধানের জন্য অহেতুক বিবাদ করা আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল পছন্দ করেন না। বরং আল্লাহর প্রিয় রসুল এ কথাই ঘোষণা করেছেন, কোনো প্রবল শক্তিসম্পন্ন অমুসলমান যদি দুর্বল অমুসলমানের ন্যায়সঙ্গত দাবী অগ্রাহ্য করে তার প্রতি অন্যায় জুলুম ও অবিচার করে, মুসলমানেরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য।’ সরফরাজপুর গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান যখন প্ররোচিত হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয় তখন তিতুমীর ঐ গ্রামে গিয়ে জুম্মার নামাজের পরে হিন্দু-মুসলমানকে সম্বোাধন করে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। (অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ)

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিতুমীরের কাছে তাঁর রাজনীতির চেহারা পরিষ্কার। বর্তমান যুগের বিপ্লবীদের মতোই ছিল তাঁর চিন্তা চেতনা। ফলে জমিদারের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে অনেক হিন্দু তাঁর দলে যোগ দেন। বহুগুণসম্পন্ন তিতুমীর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিহারীলাল সরকার লেখেন, ‘তিতু আপন ধর্মমত প্রচার করিতেছিল। সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়ন ছিল না।’ বাস্তবিক দেখা যাচ্ছে যে, তিতুমীর ধর্মসংস্কার আন্দোলন করেছেন, বিশুদ্ধ ইসলামের কথা বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছেন-কিন্তু তিনি হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মীয় সমাজকে অস্বীকার করেননি। বরং অন্যান্য বিধর্মী ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিতুমীরে পাশে দাঁড় করালে বিবেকানন্দকে কীভাবে দেখতে পাই। তিনি ভারতের মুসলমান সমাজকে স্বীকারই করেননি। বিবেকানন্দ তাঁর অনুসারীদের বলছেন, ভারত এবং ভারতীয় ধর্মে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থাপন  করো। ভারতীয় ধর্ম বলতে তিনি শুধু সনাতন ধর্মকে বোঝাতে চাইছেন। ভারতে তখন ইসলাম ধর্ম সহ আরো নানা ধর্ম ছিল; বিবেকানন্দ সেগুলিকে অস্বীকার করছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে ভারতীয় জাতি বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের কথা উচ্চারণ করেছেন। ভারতীয় মুসলমানরা যে ভারতের অংশ তাঁর আলোচনায় সে প্রসঙ্গ নেই। কিন্তু তিতুমীর তাঁর আগে জন্মে চিন্তা চেতনায় আর ধর্মীয় বিশ্বাসে যথেষ্ট প্রগতিশীল মানুষ। তিতুমীর ইংরেজি জানা বা ইংরেজি শিক্ষিত লোক ছিলেন না। তিরি ফারসি, ব্যাকরণ শাস্ত্র, আরবি ফরায়েজ শাস্ত্র, আরবি ও ফারসি কাব্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাভাষা ও অঙ্কশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। বাংলা-আরবি; ফারসি তিনটি ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ভারতে তখনো সরকারিভাবে ইংরেজিকে শিক্ষার বাহন করা হয়নি। তিতুমীর ছিলেন একজন কুশলী কুস্তিগীর। তিতুমীর যখন জন্মে ছিলেন তখনো ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ দেখা দেয়নি। ইংরেজরা তখনো সেভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে পারেনি কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি আর হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলো।

রামমোহনের সঙ্কট তিনি যথেষ্ট আধুনিক হয়েও ধর্ম বর্জন করতে পারেননি বরং ধর্ম বর্জন করাকে তিনি ভ্রান্তি হিসেবে দেখেছেন। ব্রিটেনে যখন সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, তিনি ধর্মহীন সমাজতন্ত্র পছন্দ করতে পারেননি। রামমোহনই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় যার সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রবাদীদের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটে। কিন্তু ধর্মহীন সমাজতন্ত্রকে তিনি বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার জন্য ধর্মের সমালোচনা প্রয়োজন নেই। তিনি মনে করেন, ধর্ম মানুষের মধ্যে অনেক বেশি বদান্যতা এবং সুখ বৃদ্ধি করতে সক্ষম।  ভিন্ন দিকে বিবেকানন্দ নিজেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে বলেন, সমাজতন্ত্র পদ্ধতিকে তাঁর কাছে নিখুঁত বলে মনে হয়নি। বিবেকানন্দ যথেষ্ট আবেগে ভেসে গিয়ে বলেছিলেন, ভারত প্রথম ছিল ব্রাহ্মণদের শাসন, পরে ক্ষত্রিয়দের শাসন, আরো পরে বৈশ্যদের শাসন; এবার শূদ্র বা কায়িক শ্রমজীবীদের শাসনের পালা। তিনি বলেন, নিজেদের শূদ্রকর্ম বজায় রেখেই সমাজে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তিনি বলেন ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়যুগের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ ক্ষমতা আর শূদ্রের সাম্যের আদর্শবজায় থাকবে। তিনি বলেন, সেই রাষ্ট্রে শূদ্রদের সাম্যের আদর্শ বজায় থাকবে কিন্তু শূদ্রদের দোষগুলি থাকবে না।  শূদ্রদের দোষগুলি দূর হবে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান আর ক্ষত্রিয়যুগের সভ্যতা দিয়ে। বিবেকানন্দের সকল বক্তবের সমাপ্তিতে গিয়ে সার কথা হলো, ব্রাহ্মণ্যযুগ আর ক্ষত্রিয়সভ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে; এই হলো ভারতে বিবেকানন্দের সমাজতন্ত্র।

বিবেকানন্দের এইরকম সমাজতন্ত্র চাওয়া, শূদ্রদের ক্ষমতা দখলের কথা বলা; ভারতের বিদগ্ধ সমাজের বহুজন বিনাবিচারে তাঁর এসব বক্তব্যের কারণে তাঁকে প্রগতিশীল বানাতে চেয়েছেন। কিন্তু বিবেকানন্দের এই সমাজতন্ত্র বা শূদ্রদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার ঘোষণা ছিল তাৎক্ষনিক আবেগ। সবটাই ছিল কাল্পনিক ভাবনা; যাকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রও বলা চলে। তিনি বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী পুরানো ব্রাহ্মণদের জ্ঞান দিয়ে নতুন ক্ষমতাধর শূদ্রসমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। বিবেকানন্দ স্পষ্ট করেই বলেন, উচ্চশ্রেণীরা বিলীন হয়ে যাবে। তাই তাদের কর্তব্য হলো নিজের সমাধি খনন করা।  যত শীঘ্র এ কাজ তারা করবে ততই মঙ্গল। বিবেকানন্দ চান ধনীরা শূদ্রদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিক। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, শূদ্রজাগরণের ফলে সমাজের নৈতিক মান নেমে যেতে পারে। শূদ্রজাগরণের ফলে জনসাধারণের সুখ স্বচ্ছন্দ্য বাড়লেও শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও, তার ফলে একই সঙ্গে ‘সমাজের অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা কমে আসবে।’ তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে যেখানে ‘শূদ্র বিপ্লব ঘটেছে’ সেখানেই ‘সাংস্কৃতিক মান নেমে গেছে। ভারতে যাতে শূদ্রশাসনের এই অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেজন্য তিনি সমগ্র দেশের উপর দিয়ে ‘একটি আধ্যাত্মিক প্লাবন’ ঘটাতে চান। বিবেকানন্দ শূদ্রের উন্নয়ন চাইলেও ব্রাহ্মণের পতন কামনা করেননি। তিনি মনে করেন, ধর্মের সারমর্ম উপলব্ধি করতে না পারার জন্যই ভারতে অস্পৃশ্যতা বিরাজ করছে।  বিবেকানন্দ শেষ বিচারে ধর্ম দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে চান। সেটা কোন্ ধর্ম? প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম; তিনি হিন্দুত্ব বা হিন্দুধর্মকে মনে করেন মুক্তির উপায়। তিনি পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যথেষ্ট নতুন নতুন জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন; পুনরায় ফিরে যাচ্ছেন ধর্মের অন্ধকার যুগে। হিন্দুত্বের গৌরব তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।