বিভক্ত দুই ফোবানা নিয়ে কমিউনিটিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া

তোফাজ্জল লিটন

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৯

তিন দশক আগে যাত্রা শুরু করা ফেডারেশন অব বাংলাদেশিজ অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার (ফোবানা) উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের হতাশ করেছে। যে প্রত্যয় নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছিল, সময়ের ফাঁকে এখন নানা পক্ষের স্বার্থের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এবারে দুইভাবে বিভক্ত ফোবানা তিন দিনব্যাপী ৩৩তম সম্মেলন ৩০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়। নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কেল আয়োজিত লং আইল্যান্ডের নাসাও কলিসিয়ামে ফোবানা সম্মেলনে ব্যায় হয়েছে সাড়ে সাত লাখ ডলার। শতেরো হাজার ধারণ ক্ষমতার এই হলে প্রতিদিন গড়ে দর্শক ছিল দুই হাজার। অন্যদিকে বাংলাদেশি আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি আয়োজিত লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে ফোবানা কনভেনশনে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ ডলার। চার হাজার সিটের এই হলে দর্শক ছিল গড়ে সাতশো।

প্রবাসীরা বিভক্ত ফোবানাকে কেন প্রত্যাখান করেছে? এই স্বল্প সংখ্যক দর্শকের জন্য নয় লাখেরও বেশি টাকা ব্যায় করা হয়েছে কার স্বার্থে? কমিউনিটির কল্যাণের জন্য কী করেছে সংগঠনটি বা আয়োজকরা? এমন অনেক যৌক্তিক প্রশ্ন নিয়ে তীব্র সমালোচনায় চায়ের কাপে ঝড় উঠছে কমিউনিটিতে।

জ্যাকসন হাইটসের একটি দোকানে পানের ডাটা দিয়ে পানে চুন লাগাতে লাগাতে ৫৭ বছর বয়সী প্রবাসী মুজিবুন্নেসা বলেন, “কমিউনিটির সবাই যে বলছে আয়োজকরা ব্যর্থ। কিন্তু আমি মনে করি, আয়োজকদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, নেতাগিরি দেখানো আর নিজের আখের গোছানো। দুই ফোবানার নেতারাই তাতে সফল হয়েছে। তাদের তৃপ্তি বোধ করার কারণ আছে।”

ফোবানার বর্তমান যে লোগো, তা অঙ্কন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী তাজুল ইমাম। তিনি এবারের ফোবানা সম্মেলনে গিয়ে ব্যথিত হয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, “বড় অনাদর, অবহেলা হলো আমার দেশের বরেণ্য শিল্পীদের এই ফোবানায়। ব্যথিত হলাম। অপূর্ণ থেকে গেল প্রত্যাশা।”

বাপ্পী সোম নামের এক তরুণ সঙ্গীত শিল্পী বলেন, “চরম বিশৃংখলা ও অসফলতার মধ্যে শেষ হলো একই শহরে, একই দিনে, একই নামে, একই কমিউনিটির তিনদিন ব্যাপী দুটি সার্কাস। যেখানে সং, ধামাধরা, চাটুকার, শিল্পী, অশিল্পী, স্পন্সর অগণিত থাকলেও দর্শক সংখ্যা ছিল নগন্য। দুই ফেবানাতেই ফ্রি টিকিট বিলি করা হয়েছে। তবু দর্শক টানতে পারেনি।”

ফোবানা কনভেনশনে নিয়ে নিউইয়র্কের নিয়মিত দর্শক অনিন্দিতা ইসলাম বলেন, “ম্যারিয়ট হোটেলের এই নাচ-গানের অনুষ্ঠানকে ফোবানা বলা হলে ফোবানা শব্দটির অপমান করা হবে। এটি নিউইয়র্কে অন্য দশটি ফ্রি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো হয়েছে। নায়ক ওমর সানী, নায়িকা শাহনূর ছাড়া তেমন কেউ ছিলেন না জনপ্রিয়। ছোট পরিসর, অগোছালো অনুষ্ঠানসূচি, অপেশাদার শিল্পীর গান-নাচ, দলীয় নেতাকর্মীদের মঞ্চে দাপাদাপিতে একটি দলের ‘কর্মী সম্মেলনে’ পরিণত হয়েছিল এ কনভেনশন। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এটি উদ্বোধন করেন। নিউইয়র্কের নানান অনুষ্ঠানে যারা গান গায় নিয়মিত তারাই এখানে গেয়েছেন।”

প্রবাসী বিধান পালের মেয়ে ফোবানা সম্মেলনে শিশু শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছে। তাই তিনিও ছিলেন এ সম্মেলনে। বিধান পাল বলেন, “তপন চৌধুরী, রিজিয়া পারভীন, বেবী নাজনীন, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী ও শুভ্র দেবসহ জনপ্রিয় শিল্পীদের গান ছিল অনুষ্ঠানে। ৩০ ডলার থেকে ১০০ ডলার দিয়ে টিকেট কেটে দূর-দূরান্ত থেকে নিউইয়র্কের বিশ্বখ্যাত অডিটরিয়াম নাসাউ কলিসিয়ামে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি দর্শকেরা। কিন্তু স্পন্সরদের খুশি রাখতে গিয়ে আয়োজকদের ‘বাড়াবাড়ি’ ও কথিত ‘সাংগঠনিক’ কর্মকাণ্ডেই শেষ হয়েছে অনুষ্ঠানের অধিকাংশ সময়।”

তিনি আরো বলেন, “কর্মকর্তাদের ‘অতিকথনে’ দর্শকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আয়োজক সংগঠন ড্রামা সার্কলের সভাপতি ও ফোবানার সদস্য সচিব আবীর আলমগীর বলেন, ‘এটা ফোবানা কনসার্ট নয়, সম্মেলন। অতএব, আমাদের কথা শুনতে হবে।’ তার এ কথায় দর্শকেরা চিৎকার করে প্রতিবাদ জানান।

বিধান রায় বলেন, “মিলনায়তরে ভেতরে যখন ‘হযবরল’ অবস্থা, বাইরে এক্সপো সেন্টারে তখন তীব্র হট্টগোল চলছিল। অর্ধশতাধিক স্টল মালিককে মিলনায়তনের প্রধান ফটকের বাইরে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। স্টল মালিকদের অভিযোগ, ১০-১২ হাজার লোকের উপস্থিতি ঘটবে বলে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ নগণ্য উপস্থিতির কারণে তাদের স্টলের ভাড়াই ওঠেনি। পরে নাসাউ কলিসিয়ামের নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যস্থতায় আয়োজকরা ক্ষতিপূরণ দেয়ার অঙ্গীকার করলে স্টল মালিকেরা শান্ত হয়।”

এ ব্যাপারে ফোবানা সম্মেলন কমিটির আহ্বায়ক নার্গিস আহমেদ ও সদস্য সচিব আবীর আলমগীরের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তারা কেউ তিন দিন ধরে কোনো গণমাধ্যমকর্মীর ফোন ধরেননি। ফোবানা সম্মেলন শেষে সাধারণ সভায় জানানো হয়, এবারের ব্যয় হয়েছে সাড়ে সাত লাখ ডলার। এ পর্যন্ত তাদের হাতে এসে পৌঁচেছে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ ডলার। আয়োজকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘাটতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে প্রবাসে বাংলাদেশিদের কথিত সবচেয়ে বড় আয়োজন নাসাউ কলেসিয়াম ফোবানা সম্মেলন।

কনভেনশন কমিটির আহ্বায়ক ব্যবসায়ী মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “আমরা একটি সফল কনভেনশন করতে পেরেছি। প্রায় প্রতিদিনই হল ভর্তি ছিল দর্শকে। আমাদের ব্যয় হয়েছে অন্তত দুই লাখ ডলার। আমরা বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করেছি।”

প্রবাসী প্রবীণ সাংস্কৃতি কর্মী আব্বাস উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশি ফ্ল্যাগ গার্ল খ্যাত নাজমুন নাহারকে ‘মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে ফোবানা সম্মেলন। বেশ কয়েকটি ভালো সেমিনারও আয়োজন করেছে। ফোবানা কনভেনশনে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই হয়নি। ফোবানা বিভক্ত হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থ, নেতৃত্বের কোন্দল, অর্থ আত্মসাৎ— এসব কারণে। হয়েছে মামলা-মোকদ্দমা। তাদের বিরোদ্ধে রয়েছে আদম পাচারের অভিযোগও।  ফোবানা বাংলাদেশি কমিউনিটির কল্যাণে কী করছে? তারা সবাই মিলে যদি একটি বংলাদেশ সেন্টারও স্থাপন করতো তাহলে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ থাকতাম এই ফেবানার প্রতি।

তিনি আরো বলেন, “আমার মতো অনেক প্রবাসী মনে করেন, দলাদলি বাদ দিয়ে একসঙ্গে কাজ করলে ফোবানার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই অর্জন করার ছিল। কতিপয় লোকের কারণে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশির সে প্রত্যশা দুরাশাই হয়ে থাকলো।