
বিশ্বজয়ী হও
পর্ব ৩
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ২৪, ২০২০
বিজ্ঞানী নিউটনকে আমরা কে না চিনি, আর কে না শ্রদ্ধা করি? এই নিউটন কুড়ি বছর ধরে পরিশ্রম করে গবেষণার কিছু ফল লিখে রেখেছিলেন। একদিন তার অনুপস্থিতিতে তার পোষা কুকুর ডায়মন্ড টেবিলের উপর উঠে পড়ে এবং টেবিলে রাখা মোমবাতির আগুনে নিমিষেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু নিউটন এতে হতাশ হননি। বরং দ্বিগুণ উদ্যম নিয়ে তার ওইসব লেখাগুলো আবার লিখতে শুরু করেন। অসীম ধৈর্যের অধিকারী নিউটন সেই কুকুর ডায়মন্ডকে পর্যন্ত কিছু বলেননি। তার উপর সামান্যতম হিংসা বা ক্রোধ প্রদর্শন করেননি। শুধু আলতো করে মাথায় একটু হাতের ছোঁয়া দিয়ে বলেছিলেন, ডায়মন্ড, ওহ্ ডায়মন্ড, তুমি নিজেও জানো না, তুমি কী করলে?
কতটা ধৈর্য, কতটা সহনশীলতা আর কতটা উদারতা থাকলে মানুষ এমন বলতে পারে! অথচ আমরা একবার কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েই হাল ছেড়ে দিই। আরে ভাই, ফেল যদি কেউ নাই করবে তো ফেল শব্দটি আসলো কেন? The `FAIL` full form stands for “First Attempt In Learning”। সুতরাং ব্যর্থ হয়েছো মানে তুমি শেষ হয়ে যাওনি। তুমি শিক্ষার প্রথম ধাপটি অতিক্রম করেছো মাত্র। তোমার নিষ্ঠা থাকলে, তোমার ধৈর্য থাকলে, তোমার অধ্যবসায় থাকলে, তোমার মনের দৃঢ়তা থাকলে, তুমি অকুতোভয় হলে, তোমার সাফল্যের পথে কে বাধা হয়ে দাঁড়াবে? মানুষের ইচ্ছাশক্তির সামনে কোনো বাধাই টিকতে পারে না। মানুষ তার আশার সমান বড়। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষের জয় হতেই হয়।
ব্যর্থতা থেকে যে শিক্ষা নিতে পারে, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী। বিফলতা যার মস্তিস্কে জয়ের প্রেরণা যোগায়, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী। বারবার ব্যর্থ হবার পরেও যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী। পশ্চাৎপদতা কোনো সমাধান নয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে সমস্যার মুখোমুখি হবার মধ্যেই সমস্যার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। যে সব থেকে খারাপ রেজাল্ট করে, চেষ্টা করলে তার থেকেই সবথেকে ভালো ফল আশা করা যায়। শুধু চেষ্টাটুকু করতে হয়, বাকি কাজ এমনিতেই হয়ে যাবে। তোমার ফল নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ভাবতে হবে না, `আমার কী হবে?` ভালো কাজের ফল, সঠিক পথে পরিশ্রমের ফল, তুমি এমনিতেই পাবে। এমন কে আছে, যে চেষ্টা করার পরও কাজে সাফল্য পায়নি? এমন কে আছে, ধৈর্য ধরে কঠোর অধ্যবসায়ের পরেও সফল হয়নি?
বন্ধুরা, হতাশ হয়ো না। যিশুখ্রিস্টের সেই বাক্যগুলি স্মরণ কর, `চাহিলেই তোমাকে দেয়া হইবে, অনুসন্ধান করিলেই পাইবে, করাঘাত করিলেই দ্বার খুলিয়া যাইবে।` এই কথাগুলো উপন্যাস, রূপক বা কল্পনা নয়, এগুলো বর্ণে বর্ণে সত্য।" আমি সেই ছেলেটিকে চিনি, যে প্রথমবার পলিটেকনিকে চান্স না পেয়ে দ্বিতীয়বার অন্যের সাহায্যে ও নকল করে পলিটেকনিকে চান্স পায়। এতই খারাপ ছিল সে পড়াশুনায়। এতই মন্দ ছিল তার চিন্তা-চেতনা! এতই হীনবল ছিল তার আত্মমর্যাদা। পরবর্তীতে সেই ছেলেটিই পলিটেকনিকের ফার্স্ট বয় হয়। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ ফার্স্ট হয়। শুধু তাই নয়, সে ডুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ট্রিপলইতে মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেই থেমে থাকেনি, সে পরবর্তীতে ডুয়েটেও তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। সেখানেও ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট বয় হয়।
এমন লক্ষ লক্ষ উদাহরণ পাবে, যারা প্রথম জীবনে চরম ব্যর্থ থাকলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। তারা ব্যর্থ হতে হতে যখন তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে, তখন তাদের মন বিদ্রোহ করে উঠেছে। বলেছে, আর নয় পশ্চাৎপদতা, এবার সামনের দিকে এগোও। তারা সফল হয়েছে শুধু লক্ষ্য স্থির করে পরিশ্রম করে। তারা অমর হয়েছে শুধু তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি বলেই। বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক স্যার টমাস আলভা এডিসন হাজার বার ব্যর্থ হবার পরে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। লক্ষ্য স্থির করে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সফল হয়েছিলেন। তিনি যদি আত্মবিশ্বাস ছেড়ে দিতেন, তবে এই পৃথিবী আরো অনেক পরে আলোর মুখ দেখত। এমন কি এডিসনের নামটিও হয়তো আমরা জানতাম না। আমরা যে এডিসনকে চিনি, তিনি আর কেউ নেন; আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ, অধ্যবসায়ী একজন মানুষ মাত্র। কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার ছিল না, কোনো অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধাও তিনি পাননি। শুধু তার লক্ষ্য স্থির ছিল, সংকল্প দৃঢ় ছিল এবং কঠোর পরিশ্রম ছিল মাত্র। এগুলোর সমন্বয়েই তিনি আজ এডিসন হয়ে উঠেছেন।
এই লক্ষ্য স্থির রাখার জন্য আমাদের মনের একাগ্রতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। ছড়ানো আলোয় আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই না, কিন্তু ছড়ানো আলো যখন প্রতিফলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত হয়, তখনই আমরা সব জিনিস পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাই। সেইভাবে যখন আমাদের বিক্ষিপ্ত মনকে সংযত করে অন্তরের অনুসন্ধানী দৃষ্টি রূপে প্রয়োগ করি, তখনই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার শক্তির সন্ধান পাই। একবার নিজেকে চিনতে পারলে আর চিন্তা নেই। একবার নিজের অসীম শক্তি সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে পারলে আর ভাবনা নেই। যে নিজেকে চিনতে পারে, সে জানে যে, সে অমৃতের পুত্র। সে বোঝে যে, সে এই রক্ত-মাংসের দেহটা নয়, সে অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অপরিমেয় ক্ষমতাধর পরমাত্মার অংশ। সে অমর আত্মা। যে আত্মাকে অস্ত্র দ্বারা ছেদ করা যায় না, যে আত্মাকে আগুন পুড়াতে পারে না, যে আত্মাকে জল ভেজাতে পারে না, যে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, বারবার জন্মালেও যার ক্ষয় নেই, সে সেই আত্মা। অসীম ক্ষমতাধর আত্মা।
যখন মানুষ নিজেকে এভাবে চিনতে পারে, তখন মানুষের মৃত্যুভয় দূরীভূত হয়। এই নশ্বর দেহ নিয়ে অহেতুক চিন্তা থেকে সে মুক্তি পায়। মানুষের যথার্থ স্বরূপ চিনতে পারে সে। নিজেকে জানতে পারে সে। তখন তার আত্মবিশ্বাস এত বাড়ে যে, পৃথিবীর কোনো কিছুকেই তার কঠিন বলে মনে হয় না। পৃথিবীর কোনো কিছুকেই তার অসম্ভব, দুর্জ্ঞেয় বলে মনে হয় না। পৃথিবীর সমস্ত দুর্বোধ্য ভাবনাচিন্তাগুলোকে তার `জলবৎ তরলং` মনে হয়। এমন কোনো কিছুকেই মনে হয় না, যা জানা কঠিন, যা বোঝা কঠিন, যা জয় করা কঠিন। এই মানসিকতার স্তরে মনকে তুলতে পারলেই তোমার বারো আনা কাজ হয়ে যাবে। বাকি কাজটা তুমি অনায়াসেই করতে পারবে। তুমি নিজের জীবনকে সকলের জন্য বিলিয়ে দিতে পারবে। তুমি পৃথিবীকে দিতে পারবে। পৃথিবীতে তোমার পদচিহ্ন এঁকে যেতে পারবে।
সেই তো টিকে থাকে বন্ধু, যে অপরের জন্য কাঁদতে শিখেছে। সেই তো মহান বন্ধু, যে অপরের জন্য কিছু করে। তাকেই তো মনীষী বলি বন্ধু, যে তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি, পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে, জনকল্যাণমুখী কিছু করে গেছেন, রেখে গেছেন তার কৃতি স্তম্ভ। বন্ধু, তুমিও হতে পারো অনন্য একজন মানুষ। তুমিও পেতে পার অমরত্ব। শুধু তুমি কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে কাজে নেমে পড়ো, তাহলেই তুমি এমন অনেক কিছু পাবে, এত এত সাফল্য পাবে, যা তুমি কল্পনাও করোনি। কাজ করে যাওয়াই আমাদের দায়িত্ব। সাফল্য, সে তো আসবেই। চলবে