বুরহান উদ্দিনের গদ্য ‘ওসমানি খিলাফত পরবর্তী আফ্রিকা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০২০

আজ আফ্রিকার কথা উঠলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, হাড্ডিসার ও বুভুক্ষু মানুষের চেহারা। কিন্তু এই আফ্রিকা মহাদেশ কি এমন ছিল? না, মোটেও না। আমাদের ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতায় আফ্রিকা হলো, মদিনা মুনাওয়ারার আগের হিজরত স্থল। আফ্রিকানরা হলো সেই সকল মানুষ যারা সর্বপ্রথম মক্কার নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানদেরকে তাদের কোলে আশ্রয় দিয়েছিল। নিজেদের ঘরকে মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। এইভাবে আফ্রিকানরা সর্বপ্রথম ‘মুসলমানদের আনসার’ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিল।

আফ্রিকা হলো এমন এক ভূমি, এই ভূমিকেই মুসলমানরা তাদের বসবাসের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিল। রাসূলে আকরামের (স.) সময়কাল থেকেই এই আফ্রিকা মহাদেশ মুসলমানদেরকে বরণ করে এসেছে, তাইতো বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও মুসলমানরা ছিল এই মহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ এই অঞ্চলের মানুষদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে আজ মুসলমানদেরকেই করেছে এখানে সংখ্যালঘু, আজ আফ্রিকা মহাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা ৪০% এরও নিচে!

আফ্রিকায় হিজরতকারী প্রথম মুহাজিরদের মধ্যে রাসূলে আকরামের (স.) প্রিয়তম কন্যা হজরত রুকাইয়্যা (রা.) ছিলেন। হযরত জাফরের (রা.) নেতৃত্বে মুসলমানরা যেদিন থেকে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসির মুসাফির হয়েছিল সেদিন থেকে নিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই মহাদেশ ইলম, ইরফান, আখলাক, সংস্কৃতি এবং সভ্যতাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে যে সকল অবদান রেখেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।

হযরত উমর (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত বিলাল (রা.), হযরত আমর ইবনুল আস (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দ (রা.), উকবা বিন নাফে (রা.), উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহ.), তারিক বিন যিয়াদ, আহমেদ বিন তলুন এবং ইউসুফ বিন তাশফিনের ভালোবাসায় আফ্রিকা সিক্ত হয়েছে। ৬৪১ সালে আমর ইবনুল আসের (রা.) মিশর বিজয়ের মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশে ইসলাম বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করে এবং এরপর মিশরের ফুসতাত, আয়সুত; তিউনিশিয়ার কায়রাওয়ান; মরক্কোর ফেস, সিজিলমাসে; মালির তিমবুক্তি; সুদানের সিন্নার; ইথিওপিয়ার হারার; সোমালির যেয়লা এবং মোগাদিসু; কেনিয়ার মোম্বাসা, তানজানিয়ার যেনযিবার; আলজেরিয়ার তাহেরত, লিবিয়ার ত্রাবলুসগারব আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে এই মহাদেশে আলোকিত করে রেখেছিল হাজার বছর ধরে।

ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং এর সৌন্দর্য এই মহাদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে প্রবলভাবে, দলে দলে মানুষ ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নেয় এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে আফ্রিকার অনেক শহর ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্রভূমিতে রূপান্তরিত হয়। ইসলামি সভ্যতায় আফ্রিকার যে অবদান তা আজও আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। আসাদ বিন ফুরাত, সাহনুন, জেইলানী, ইবনে খালদুন, ইবনে বতুতা, ইমাম সুয়ুতী, আহমেদ আত-তিজানী, মুহাম্মাদ আস-সানুসী, খায়রুদ্দিন তিউনিসি এবং আরো অনেক মহান ব্যক্তিবর্গ এই আফ্রিকারই সন্তান। এই সকল মহান ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি মানুষের অন্তরকে বিজয় করে তাদের হৃদয়পটে ইসলামের বীজ বপন করার জন্য অনেক তরিকতের জন্ম হয়, এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো, শেজালী, তিজানী, সানুসি এবং সামানিয়্যা।

আফ্রিকা মহাদেশ একই সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সিল্করোড ও মসলা পরিবহনের রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও অসামান্য অবদান রেখেছে। আফ্রিকা মহাদেশের এই সম্ভাবনা ও অবদানকে সামনে রেখে এই মহাদেশের ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য প্রায় দীর্ঘ চারশত বছর ওসমানি খিলাফত এই অঞ্চলকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। যেমন, বারবারস খাইরুদ্দিন পাশা শুধুমাত্র ওসমানি খিলাফতের একজন বীর নন, একই সাথে তিনি আফ্রিকারও একজন বীর। তিউনিশিয়ার খাইরুদ্দিন পাশা, আলজেরিয়ার উস্তাজ হামদান কেবলমাত্র তাদের নিজেদের দেশের জন্য নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সম্পদ। পিরি রেইস কেবলমাত্র একজন ওসমানি নাবিকই নন, একই সাথে তিনি ভারত মহাসাগরের আশপাশের মুসলিম দেশসমূহেরও একজন নাবিক ছিলেন।

ওসমানি খলিফা, সুলতান সেলিম ইয়াভুজ আফ্রিকাকে অবরুদ্ধ কারী স্পেনিশ ও পর্তুগীজদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করার জন্য তিনি নিজে মিশরে যান এবং সেখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কানুনি সুলতান সুলায়মান আফ্রিকান মুসলমানদের জন্য সকল কিছুর বন্দোবস্ত করেন, সুলতান আব্দুল আজিজ দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানদের শান্তির জন্য ওসমানি আলেম আবু বকর এফেন্দিকে সেখানে পাঠান।

দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ইথিওপিয়ার হারার মুসলমানদের জন্য সেই দেশের সম্রাটের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। এক কথায় বলতে গেলে, ওসমানিরা ইস্তানবুলের জন্য যেমন পেরেশান ছিলেন একইভাবে মোগাদিশু, তিম্বুকতি, ফেস, মোমবাসা, কায়রাওয়ান, ফুসতাত এবং খারতুমের জন্যও একই ভালোবাসা ও পেরেশানী লালন করতেন। যার কারণেই মরুপ্রান্তরে শত শত ওসমানি সেনাবাহিনী জীবন দিয়েছেন তাদের আফ্রিন মুসলিম ভাইদেরকে রক্ষা করার জন্য।

কিন্তু ওসমানি খিলাফতের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের শক্তি ও অস্ত্রের পরীক্ষার জন্য আফ্রিকা মহাদেশকে বেছে নেয়। এই অঞ্চলকে শোষণ করে তারা তাদের সুখের মহা অট্টালিকা গড়ে তোলে। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই মহাদেশকে সকল দিক থেকে শোষণ করছে। এই সকল শোষকগোষ্ঠী তাদের চাতুরতার মাধ্যমে এখনো এই অঞ্চলকে শোষণ করে চলছে। এই সকল সাম্রাজ্যবাদীরা কেবলমাত্র তাদের সম্পদকে লুণ্ঠন করেই ক্ষান্ত হয়নি, একই সাথে তারা এই অঞ্চলে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল কিছুকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।

এত কিছুর পরেও আফ্রিকার মুসলমানরা থেকে নেই, তারা তাদের অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যেন তাদের হৃত গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে পারে তাই আজ আমাদের প্রয়োজন তাদের পাশে দাঁড়ানো। তারা আজ তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর লক্ষ্যপানে।