বোধিসত্ত্ব

পর্ব ৩

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০১৯

মহাযানে সাতটি বিশেষতা গুণধর্ম
আচার্য অসঙ্গের ‘মহাযানাভিধর্ম সঙ্গীতি শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে মহাযানের সাত প্রকার বিশেষতা দেখিয়েছিলেন। (১) মহাযান বস্তু: মহান ও বিশাল, যেহেতু ইহাতে জীব মাত্রেই মুক্তির (বিধান) আশ্বাস আছে। (২) মহাযানে প্রাণীমাত্রের জন্য ত্রাণের বিধান আছে। (৩) মহাযানের লক্ষ্য একমাত্র বোধিপ্রাপ্তি। (৪) মহাযানের আদর্শ বোধিসত্ত্ব, যারা সকল প্রাণীর উদ্ধারার্থে সতত প্রযত্নশীল থাকেন। (৫) মহাযানের মান্যসিদ্ধান্ত হলো, বুদ্ধ স্বীয় উপায় কৌশল্যের দ্বারা নানা অধিমুক্তি অর্থাৎ সত্ত্বদের জন্য নানা প্রকারের ধর্মের উপদেশ দিয়েছেন, যা পরমার্থত এক। (৬) মহাযানে বোধিসত্ত্বের দশভূমির বিধান আছে এবং (৭) মহাযানের মতে বুদ্ধ সমস্ত মানবের আধ্যাত্মিক আবশ্যকতাসমূহ পূর্ণ করতে সমর্থ।

মহাযান ধর্মদর্শনে বোধিসত্ত্বের দশভূমি: মহাযান মতাদর্শে বোধিসত্ত্বের দশভূমি পর্যেষণা রয়েছে। মহাযান শাস্ত্রানুসারে বুদ্ধত্ব লাভ করতে হলে বোধিসত্ত্বকে ধ্যানের দশটি ভূমি অতিক্রম করতে হয়, যেমন- (প্র) মুদিতা, বিমলা, প্রভাকরী, অর্চিষ্মতী, (সু) দুর্জয়া, অভিমুখী, দূরংগমা, অচলা, সাধুমতী এবং ধর্মমেঘা। আবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উল্লেখ করেছেন, ১. ‘ভূমি’ বা দশার নাম দুরারোহা, ২. বর্ধমানা, ৩. পুষ্পমন্তিতা, ৪. রুচিরা, ৫. চিত্তবিস্তরা, ৬. রূপবতী, ৭. দুর্জয়া, ৮. জন্মনিদেশ, ৯. যৌবরাজ্য, ১০. অভিষেক।

বোধিসত্ত্বদের ভূমিসমূহ অপরিমেয়, অনেক ও অনন্ত কল্প ব্যাপ্ত। সংপ্তি সংজ্ঞায় বোধিসত্ত্বদের সব সংসার বা প্রত্যেক জন্মকেই ভূমি বা পৃথিবীতুল্য বলে কল্পনা করা হয়। সেজন্য এর নাম ‘ভূমি’। প্রথম ভূমিতে স্থিত বোধিসত্ত্বের আচরণবিধি আটটি : ১. ত্যাগ বা দানশীলতা ২. করুণা ৩. অপরিখেদ, ৪. অমান বা অভিমানের অভাব, নম্রতা, ৫. সব শাস্ত্রের অধ্যয়ন, ৬. বিক্রম, ৭. লোকের অনুজ্ঞা বা অনুমতি গ্রহণ, ৮. ধৃতি অর্থাৎ ধৈর্য। ক্রমে নবম ভূমি অতিক্রম করে বোধিসত্ত্ব দশম ভূমিতে উত্তীর্ণ ও পূর্ণসম্পাদন করে মানব জন্ম আকাক্সা করেন এবং অপুনরাবর্তনের জন্য অর্থাৎ এই-ই শেষ জন্ম জেনে মাতৃগর্ভে অবতীর্ণ হন -(মহাবস্তু অবদান)।

নৈর্বাণিক মহাসত্ত্ব বোধিসত্ত্ব: বোধিসত্ত্ব, পালি বোধিসত্ত। বোধি বা জ্ঞান লাভে উন্মুখ সাধক, যিনি বুদ্ধত্ব অর্জনের আগের পর্যায়ে রয়েছেন। বুদ্ধের জীবন চরিত আশ্রয় করে বোধিসত্ত্ব তত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধের ৫৫০ বার জন্মগ্রহণের কাহিনীর শিাদর্শ বোধিসত্ত্ব জীবনবোধ। বোধিসত্ত্ব আধ্যাত্মিক মুক্তিকামী ব্যক্তি। ‘বোধি’ অর্থ জ্ঞান এবং ‘সত্ত্ব’ অর্থ প্রাণী বা জীব। এখানে বোধি বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝায় যার অনুশীলনে জীবের দুঃখনিবৃত্তি ঘটে। এ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয় এবং প্রতি জন্মেই অপরের দুঃখনিবৃত্তির জন্য কাজ করতে হয়। কথিত হয় যে, সিদ্ধার্থ গৌতম ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করে জগতের সকল জীবের মুক্তি কামনা করেন। এ পূর্বজন্মসমূহে তাঁকে বোধিসত্ত্ব বিশেষণে ভূষিত করা হয়। এভাবে বোধিসত্ত্ব হিসেবে সাধনা করে পয়ঁত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তাঁর বুদ্ধত্ব লাভের সময়টি বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। এ সময় তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে অতীত জীবনের সকল কথা স্মরণ করেন, যা জাতকের গল্প হিসেবে সংরতি হয়েছে। মহাযান বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্বের আদর্শকে সর্বোচ্চে স্থান দেয়া হয়েছে।

মহাযান বৌদ্ধদের মতাদর্শে বোধিসত্ত্ব কল্পনার মাধ্যমে বুদ্ধের জীবনে অলৌকিক মহিমা আরোপ করা হয়। বিভিন্ন জন্মে দশ পারমী পূরণের নৈপুণ্যের জন্য নাম হয় ‘দশভূমিশ্বর’। এসব সৎকর্ম ও সুকৃতির অধিকারী দেবকল্প পুরুষকে বৌদ্ধশাস্ত্রে বোধিসত্ত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাযান মতে, অর্হৎ বা শ্রাবকের চেয়ে বোধিসত্ত্ব শ্রেষ্ঠ। অর্হৎরা কেবল নিজের মুক্তির উপায় খোঁজেন, সকল সত্তার মুক্তি তাঁদের কাম্য নয়। হীনযান মতে, বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সিদ্ধার্থ রূপে জন্মগ্রহণের পূর্বপূর্ব জন্মে তিনি ছিলেন বোধিসত্ত্ব। মহাযানীরা বলেন, সিদ্ধার্থ পূর্বজন্মে সাধারণ মানুষের মতোই বোধিসত্ত্ব অর্জন করেন। সেজন্য অন্য সাধারণ মানুষও বোধিসত্ত্ব হতে পারেন এবং কালক্রমে বুদ্ধত্ব অর্জন করতে পারেন। মহাযান মতে সিদ্ধার্থ ছাড়াও আরো বহু বোধিসত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকৃত। এ বোধিসত্ত্বরা ব্যক্তিগত নির্বাণ মুক্তি আকাক্সা করেন না। শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’য় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি শ্রাবকত্ব অর্জনের পরামশ দেয় সে পাপমিত্র।

সদ্ধর্মপুণ্ডরিক, কারণ্ডব্যূহ এবং নিষ্পন্নযোগাবলি প্রভৃতি মহাযানশাস্ত্রে অগণিত বোধিসত্ত্বের মধ্যে সমন্তভদ্র, অক্ষয়মতি, তিগর্ভ, আকাশগর্ভ, রত্নপাণি, বজ্রগর্ভ, অবলোকিতেশ্বর, চন্দ্রপ্রভ, মৈত্রেয়, মঞ্জুশ্রী, ভদ্রপাল, বজ্রপাণি প্রভৃতি ২৫ জনকে নিয়ে বোধিসত্ত্বমণ্ডলের বিবরণ পাওয়া যায়। বোধিসত্ত্বদের বিশেষ বিশেষ মতা এবং মূর্তিরূপ কল্পনা করা হয়েছিল। বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি ও আেভ্য এই পাঁচজন ধ্যানী বুদ্ধ পঞ্চস্কন্ধের অধিষ্ঠাতা। ধ্যানীবুদ্ধ থেকে বুদ্ধশক্তি উৎপত্তি এবং বুদ্ধ শক্তি থেকে বোধিসত্ত্বদের উৎপত্তি। পাঁচ ধ্যানী বুদ্ধের শক্তি যথাক্রমে- লোচনা, বজ্রধাত্বীশ্বরী, পাশুরা, তারা ও মামকী। বোধিসত্ত্ব কোন না কোন ধ্যানী বুদ্ধকুলের অন্তর্গত।

মহাযানী বৌদ্ধরা নিজেদের বোধিসত্ত্ব বলে মনে করেন, তাই মহাযানকে বোধিসত্ত্বযানও বলা হয়। বোধিসত্ত্ব সকল জীবের জন্য অসীম করুণা ও মৈত্রী অনুভব করেন। তিনি দুঃখ জর্জরিত প্রাণীদের উদ্ধারে বিগলিতপ্রাণ। জগতের কল্যাণ সাধনেই বোধিসত্ত্বজীবনের সার্থকতা। বিশ্বের একটি প্রাণীও যদি দুঃখানুভব করে, অমুক্ত থাকে তবে তিনি নিজের মুক্তিকে তৃণবৎ ত্যাগ করেন। বোধিসত্ত্বের এ কল্যাণ চেতনাই বোধিচিত্ত। বোধিচিত্ত অর্জিত হলেই সর্বার্থ সিদ্ধ হয়, ভবসাগর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নির্বাণমার্গে উপনীত হওয়া যায়। জগতের সকল প্রাণীর জন্য বোধিসত্ত্ব এরূপ করুণা অনুভব করেন বলে তিনি পরমকরুণাময়। জন্মের ক্রমানুসারে বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন রূপে কল্পনা করা হয়। তাঁর প্রথম রূপ হচ্ছে অবলোকিতেশ্বর। অবলোকিতেশ্বর করুণার আধার। তারপর মঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্ব। তিনি প্রজ্ঞার আধার। অতঃপর বজ্রপাণি, বজ্রগর্ভ, জ্ঞানগর্ভ, রত্নগর্ভ, আকাশগর্ভ, সূর্যগর্ভ, মৈত্রেয় প্রভৃতি বোধিসত্ত্বের কল্পনা করা হয়। বোধিসত্ত্বের এরূপ রূপকল্পনা মূলত গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্মসমূহের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। বোধিসত্ত্বের এ ধারণা ভারতবর্ষ থেকে এশিয়ার সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ সকল অঞ্চলের মানুষ আজো বোধিসত্ত্বের আদর্শে উৎসর্গ করে চলেছেন।

আনুমানিক খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে রচিত ‘গুহ্যসমাজতন্ত্র’ কিংবা তারও পূর্বে রচিত ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে প্রথম বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর নাম পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে রচিত অনেক বৌদ্ধগ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের সন্ধান মেলে। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইৎ সিঙ প্রমুখের ভ্রমণবৃত্তান্তে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর নামোল্লেখ আছে। ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরিক’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, শাক্যমুণি বুদ্ধের সঙ্গে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও ‘নামসঙ্গীতি’ গ্রন্থে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীকে আদিবুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চীনা বৌদ্ধধর্মে প্রচলিত একটি কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, চীনের সাধারণ মানুষের মুক্তি ও তাদের সদ্ধর্ম শিক্সা দেওয়ার জন্য গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বয়ম্ভূপুরাণও বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীকে একজন মহান সাধক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এছাড়া এখানে আরও অনেক মনোমুগ্ধকর কাহিনী আছে। সেসব কাহিনীর ভিত্তিতে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীকে নেপালের সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্রষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারো কারো ধারণা, বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী একজন বৌদ্ধ ভিু হিসেবে নেপালে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। মঞ্জুশ্রীকে কৃসির দেবতা, আধ্যাত্মিক জগতের স্থপতি এবং বিজ্ঞানের দেবতাও মনে করা হয়। বছরের প্রথম দিনটি মঞ্জুশ্রীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বিধায় এদিন নেপালে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে তাঁর পূজা করা হয়।

চলবে