প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

‘ভাই শ্যাখাছিনার দ্যাশে কিছুই বিশ্বাস করন যায় না’

পর্ব ১৬

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১৬ পর্ব

২ মে ২০২১ রোববার
প্রতিদিনকার মতো আজও অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি, প্রতিদিনকার মতো রোদ, গরম, প্রতিদিনকার মতো তীব্র রিকশা সঙ্কট এবং প্রতিদিনকার মতো হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়।

প্রায় পায়ে ধরে একটা রিকশা জোগাড় করলাম। রিকশাওয়ালার নাম জালাল। মিশমিশে কালো গাত্রবর্ণ। রোদে ঘেমে চিকচিক করছে। কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের দাঁত হয় ঝকঝকে, কিন্তু জালাল মিয়া দেখলাম ব্যতিক্রম। তার দাঁত হলদেটে। ঠোঁটের উপর আবার গোঁফও আছে। তবে দাড়ি নেই। ক্লিন সেভড। বয়স সম্ভবত চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। বোঝা যায় না।

জালাল মিয়ার পক্ষ থেকে সাত সকালে এমন অভাবনীয় এক প্রশ্ন ধেয়ে আসবে, ভাবিনি। রিকশায় বসেছি মাত্র, আট দশ কদম মাত্র গড়িয়েছে চাকা, হঠাৎ জালাল মিয়া পেছন ফিরে তাকিয়ে সারি সারি হলুদ দাঁত মেলে হেসে বলল, শ্যাখাছিনার হরতাল শেষ হইব কবে, জানেন কিছু?

তার ইঙ্গিত যে বুঝিনি তা না। বললাম, হরতাল কই দেখলেন? সব তো ঠিকঠাক চলতেছে। এই যে আপনি গাড়ি চালাইতেছেন।
`আরে আমার গাড়ির কথা কই না তো। বাস বুস চলব না?`
`বাস চলা নিয়া আপনার টেনশন কেন? আপনি কি বাসের ড্রাইভার?`
`আরে ভাই খালি নিজের কথা ভাবলে হইব? পরিবার পরিজনের কথা ভাবতে হইব না? পরিবার তো থাকে দ্যাশে। বাস বুস না খুললে দ্যাশে যামু ক্যামনে? দুই দিন পর ঈদ।`
`ও আচ্ছা। এই জন্য টেনশন করতেছেন। টেনশন কইরেন না। শুনলাম ঈদের আগে নাকি বাস খুলবে।`
`ভাই শ্যাখাছিনার দ্যাশে কিছুই বিশ্বাস করন যায় না।` বলেই জালাল মিয়া হাসল। আমিও হাসলাম। যেহেতু হাসি সংক্রামক।

কিন্তু জালাল মিয়ার দুশ্চিন্তাটাও আমাকে সংক্রমিত করল। মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই যদি এভাবে লকডাউন চলতে থাকে তাহলে এই হাজার হাজার মানুষ কীভাবে ঈদ করতে গ্রামে যাবে? ঈদের সময় বাঙালি তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবে না, ভাবাই যায় না। তারা পায়ে হেঁটে হলেও গ্রামের বাড়িতে যাবেই।

ওদিকে শুনলাম বাস শ্রমিকরা নাকি আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তারা চায় ঈদের আগে বাস চলাচল শুরু হোক। অন্যদিকে বাস মালিকরা নাকি চেয়েছে প্রণোদনা। ব্যাপারটা এমন, সবাই তো চাইলেই পাচ্ছে। আমরাও চেয়ে দেখি না। যদি পাই, মন্দ কি!

এসব ভাবতে ভাবতে অফিসে ঢুকলাম। কাজ করলাম। আজ ছিল সেই অযথা, অপ্রয়োজনীয়, অহেতুক, বিরক্তিকর, অপমানজনক, কার্যকারণহীন প্রেজেন্টেশনের দিন। দিলাম। কেন দিলাম? যে কারণে কালের কণ্ঠের সাংবাদিকরা লেখে তারা কালের কণ্ঠের গর্বিত কর্মী, ঠিক একই...। থাক গে!

একরাশ বিরক্তি আর যন্ত্রণা নিয়ে অফিস থেকে বের হলাম। কিন্তু বাসায় যে এরচেয়েও যন্ত্রণা অপেক্ষা করছিল তা তখনো জানি না। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটু পর ইফতার হবে। বাসায় ঢুকে দেখি, ছোট দুই বোন মার মাথায় পানি ঢালছে।

কি আর করা! ওই সন্ধ্যাতেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ছুটলাম হাসপাতালে। বাকিটা লিখতে ইচ্ছে করছে না। চলবে