ভারতের কৃষক আন্দোলনের হাওয়া বাংলায় এলো না কেন?
বিবি সাজদাপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০২১
ভারতে চলমান কৃষক বিদ্রোহের হাওয়া বাংলায় লাগলো না কেন? বাংলাও তো লুটের শিকার। পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় প্রাণ ও মিল্কভিটার জন্য গড়ে উঠেছে অজস্র খামার। তারা দুধ না নিলে বেকায়দায় পড়ে কৃষকরা। এর কোনো সুরাহা হয়নি এখনও। উত্তরবঙ্গজুড়ে এবং পশ্চিমে যে সবজির চাষ তা মাঝে মাঝে ফ্রিতে দিলেও কেউ নেয় না। অথচ শহরে যা দাম! ডিম উৎপাদনকারী কৃষক ডিম ভেঙে রাস্তায় প্রতিবাদ করে। সবজি রাগ করে কৃষক ক্ষেত থেকে না তুলেই হালচাষ দেয়। রাস্তায় ঢেলে দেয়া হয় গ্যালন গ্যালন দুধ। এভাবেই আমার কৃষক প্রতিবাদ করে। একদম চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো।
এছাড়া বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিক নানাসময় কৃষকদের নিয়ে কথা বলেছেন। যেমন: শওকত আলী। (নাঢ়াই) কৃষক আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন। এছাড়াও আছে নীলদর্পন (নাটক) দীনবন্ধু মিত্রের। দু’বছর আগেও কৃষকের হাহাকার দেখার মতো ছিল না। ধান মণপ্রতি ৪৫০-৫০০ টাকা মাত্র। খরচই ওঠে না ওতে। অথচ মিলে করা চাল ৬০ টাকা কেজিপ্রতি। যেখানে বাংলার কৃষক এত বৈষম্যের শিকার সেখানে তো ভারতের সাথে তাল মিলিয়ে এদের ফুঁসে ওঠার কথা! কিন্তু কিছুই হলো না বাংলায়। কেন! কেন! কেন! বলবো সে কথা। এখন ইতিহাস বলি।
বাংলার কৃষক বিদ্রোহ (রংপুর-দিনাজপুর) নেতৃত্বে নূরুলদীন। প্রতিপক্ষ জমিদার দেবী সিং। শওকত আলী তা নিয়ে লিখলেন নাঢ়াই উপন্যাস। এটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামার মতো অতি উচ্চ ক্যাটাগরির উপন্যাস। বা বিদেশি লেখক তলস্তয়ের রিজারেকশন বা মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশো বছরের সমমানের দাবি রাখে। তেভাগা আন্দোলন। ৪৬-৪৭ সালের দিকে এ বিদ্রোহ ছিল বর্গাচাষিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। নেতৃত্বে ইলা মিত্র ও নূর জালালসহ কম্যুনিস্টরা।
দাওয়াল বিদ্রোহ। ধানকাটা শ্রমিকরা এ বিদ্রোহ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এর উল্লেখও আছে। নানকার বিদ্রোহ। বৃহত্তর সিলেট হয়েছিল। জমিদার ও ভূমিদাসদের মাঝে হয়। মেয়াদকাল ৩০ বছর। ১৯৫০ এ জমিদার প্রথার উচ্ছেদে এ দীর্ঘ আন্দোলনের অবসান হয়। এ বিষয় নিয়ে প্রচুর পালাগানও আছে। টঙ্ক বিদ্রোহ। কৃষির ফসলের উপর ট্যাক্স বসানোর বিরুদ্ধে। বৃহত্তর ময়মনসিং এলাকায়। নাচোল বিদ্রোহ। বৃহত্তর রাজশাহী এলাকায়। সাঁওতালরাও বিদ্রোহ করেছিল।
বেগার আন্দোলন। মানে পেটেভাতে। কোনো মজুরি জুটবে না। এ প্রথা আমিও দেখেছি ছোটবেলায়। কাগজ কলমে এ প্রথা রহিত হয় ১৯৭৬ সালে। কিন্তু এখনও চলছে। এছাড়া আরো ছোট ছোট বহু আন্দোলন হয়েছিল কৃষি ও কৃষকের জন্য। কিন্তু এখন কৃষকরা চুপ কেন বাংলায়? তাদের কি অভাব নেই, কোনো অভিযোগ নেই? তাদের কোনো পাওনা নেই রাষ্ট্রের কাছে?
আন্দোলন মূলত একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর সংগঠনের জন্য দরকার লিডারশিপ। একজন বা কয়েকজন মিলে আন্দোলন পরিচালনা করে এবং বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা জাতি তাতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে, সাফল্য বা ব্যর্থতা সেটা পরের ব্যাপার। প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই কৃষক শাখা আছে। আওয়ামী লীগের কৃষক শাখা এখন কথা বলবে না। কারণ তারা ডিলার ধারণার সাথে মিলে শোষণ করছে। সার-বীজ-যন্ত্রপাতি-কীটনাশক সব ক্ষেত্রে তারা ভাগ বাটোয়ারা করে লুটছে। সিকিভাগও দিচ্ছে না কৃষককে।
বিএনপির কোমর ভেঙে গেছে। কোনোমতে টিকে আছে। লম্বা একটা সময় রাজনৈতিক হেনস্তার মাঝে আছে তারা। বাকি থাকলো কারা? কম্যুনিস্টরা। গোড়া কম্যুনিস্টরা সরকারের নজরবন্দি। আকাইম্মারা সুযোগের অপেক্ষায় বা লেখালেখি বা হুদাই দিনগুজরান করছে। তাহলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আন্দোলনের ঢেউ আসবে কি করে? কোন পথে? কার মাধ্যমে? গরিব কৃষক জানে সে শোষণের শিকার, কে তার হাত ধরে আন্দোলনে শামিল করবে?
করোনা ক্রাইসিসের মাঝেই বাংলায় উপুর্যপরি এক মৌসুমেই কয়েকবার বন্যা হলো। ক্ষেতের ফসল তলিয়ে গেল। তবুও অদম্য কৃষক আবার ফসল লাগালো। যেহেতু এখন মৌসুমের সময়, সব কৃষকই ধান তুলেছে। কৃষির পিছলা ও খাড়া যোগান রেখার কারণে ও বন্যার কারণে এবার ভালো দাম পেয়েছে কৃষকরা। এপ্রিল-মে মাসের মতো দুধ ডিম সবজির বাজার তলানিতে নেই। নতুন কোনো কৃষি আইনও হয়নি এখন। কৃষকদের লিডারও নেই, পুরোপুরি অবিন্যস্ত তারা।
তাই আমি বলতে পারি, ভারতের কৃষক আন্দোলন বাংলায় আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মাসটা যদি এপ্রিল-মে হতো এবং বন্যাটা না হতো তবে আন্দোলন হতো অতি অবশ্যই ৯০%। লিডারশিপ তৈরি হতো তখন একদম তৃণমূল থেকে।
























