মনিরউদ্দীন ইউসুফের প্রবন্ধ ‘প্রকৃত ইসলামের খোঁজে’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১

মনিরউদ্দীন ইউসুফের আজ জন্মদিন। ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ মহকুমার তাড়াইলের জাওয়ার গ্রামে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘ছোটদের ইসলাম পরিচয়’ গ্রন্থের ভূমিকা-অংশটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আমাদের স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রাথমিকভাবে ছেলেদের ইসলাম সম্পর্কে যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা যথেষ্ট তো নয়ই, ত্রুটিহীনও নয়। ইসলাম সম্পর্কে এই ধরনের শিক্ষা ইংরাজ ও পশ্চিম ইয়োরোপের জাতিগুলোর ষড়যন্ত্রের ফল। খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে মুসলমান যখন একে একে রাজ্য হারাতে লাগল, তখন ইংরাজরা চাইলো যে, মুসলমানরা যেন আর আনুষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে এসে গবেষণার সাহায্যে কোনো ঐক্যবদ্ধ সমাজের দিকে চালিত হওয়ার সুযোগ না পায়।

ভারত উপমহাদেশসহ আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি প্রাচ্যের সব দেশেই মুসলমানদের অবস্থা তখন খারাপ। তারা পরাজিত, তারা হতাশ। তাদের সমাজে শিক্ষিত-সচেতন ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তিরা তখন দিশেহারা। অর্থ ও প্রতিপত্তির জোরে ইংরাজ ও ইসলাম বিরোধীরা মুসলমান সমাজকে কৌশলে এমন এক নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে এলো, যাদের আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছুই নেই। তারা বহুদিন ধরেই বিত্তবানদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদগুলোতে ইমামতি করে আসছে। ফলে হীনমন্যতা তাদের মজ্জাগত হয়ে আছে। মক্তবগুলোতেও ছেলেমেয়েদের ‘ধর্মীয় শিক্ষা’ তারাই দিয়ে আসছিল। ‘ধর্ম’ বলতে তারা পৌরোহিত্যমূলক আচার-আচরণকেই বুঝিয়েছেন। ‘দীনের’ অন্য ব্যবহার তারা জানতোই না।

মুসলমানগণ তাদের মর্যাদাবান স্বাভাবিক নেতাদের দুর্দিনে মসজিদের এইসব ইমাম ও মক্তবের শিক্ষকদেরকেই নিজেদের নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দিলো। আত্মমর্যাশূন্য, মেরুদণ্ডহীন এসব লোককে মুসলমানদের নেতা হিসেবে দেখে ইংরাজ ও তাদের তল্পীবাহকরা খুশি হলো। শুধু খুশি নয়, এ যে তাদেরই পরিকল্পিত নীলনক্সার ষড়যন্ত্রের ফল, তাও বুঝতে পারল।

উনিশ শতকে কলিকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করে মুসলমানদের প্রতি ইংরাজরা তাদের এক দায়িত্ব পালন করেছে বলে জাহির করলো। সেখানে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে সাতশো বছরের পুরনো বাগদাদের ‘দরসে মিজামিয়া’কেই মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করা হলো। এই পাঠ্যসূচিতে ইসলাম রাজ-বাদশাদের তৈরি এক আনুষ্ঠানিক ‘ধর্ম’ বলেই প্রচলিত থেকে গেল। কলিকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজ অনুগত প্রাচীনপন্থী শিক্ষকগণকেই নিয়োজিত করা হলো। প্রচার করা হলো, ইসলামি শরিয়তের বিধানদাতা এরাই। সরকারি প্রচারণার জোরে এভাবেই তারা সহজে খ্যাতিমান হয়ে উঠলেন।

উপমহাদেশে দেওবন্দ-মাদ্রাসার যে প্রসিদ্ধি ছিল, তার মূলে ছিল এর শিক্ষকবৃন্দ। এরা প্রায় সবাই ছিলেন ইংরাজ-বিরোধী। এই বেসরকারি মাদ্রাসার মুদাররিকগণ ছিলেন অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে। প্রাচীন নৈতিকতার দিক থেকে এরা ছিলেন খুবই চরিত্রবান। নৈতিকতার ভিত্তি ঠিক রাখার জন্য এদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল প্রায় কট্টর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের মতোই শক্ত ও কঠিন। কারণ, যে মধ্যযুগীয় আধাত্ম-সাধনা ও শিক্ষাদীক্ষাকে তারা আঁকড়ে ধরেছিলেন, তা ইসলামের আসল রূপ উদ্ধার বা আবিষ্কারের পথে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইংরাজরা অবশ্য গোঁড়ামির এমন ফলই আশা করেছিল। দেওবন্দের পাশ করা আলেমরা ছিলেন ধর্মসর্বস্ব সমাজেরই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। ইংরাজ আমলের শিষদিন পর্যন্ত দেওবন্দের ‘ধর্মীয়’ গোঁড়ামির এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল।

দেওবন্দের মাদ্রাসায়ও সেই মধ্যযুগীয় পাঠ্যক্রমই চালু ছিল। বাগদানের বাদশা মামুনের আমলে ‘দারুল হিকমা’র জ্ঞানার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও গবেষণার যে মনোভাব বিরাজমান ছিল, দেওবন্দে তার ছিটেফোঁটাও বর্তমান ছিল না। এ কারণেই সম্ভবত আধুনিক যুগের শিক্ষার সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্কই ছিল না এবং এ কারণেই সমাজের উচ্চ স্তরের শিক্ষার্থীরা তাদের ছেলেমেয়েরদেরকে দেওবন্দের বদ্ধ বাতাসের ধারেকাছে পাঠানোও নিরাপদ বলে মনে করতেন না। ইংরাজ বিরোধী সত্ত্বেও দেওবন্দের মধ্যযুগীয় ধর্মীয় মনোভাব প্রকারান্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইংরাজদের ষড়যন্ত্রেরই সহায়ক হয়েছিল।

তাই সারা উপমহাদেশে যেসব জ্ঞানকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, তা সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি, সেইগুলোতে সেই বাগদাদি রীতিই প্রচলিত ছিল, অর্থাৎ সেসব মাদ্রাসায় আনুষ্ঠানিক ‘ধর্ম’ই ছিল প্রধান। ফলে সারা উপমহাদেশের গ্রামে-গ্রামান্তরে অবস্থিত মাদ্রাসা-মক্তব ও মসজিদ এবং খানকাগুলোতে একই রকম ‘ধর্ম শিক্ষা’ দেয়া হতো। এবং মুসলমান ছেলেমেয়েরা সেই গোঁড়ামিপূর্ণ একরোখামিরই জাবর কাটতো সর্বত্র। কারণ মধ্যযুগীয় অন্ধ বিশ্বাসই ছিল তাদের মনোভাবের উৎস।

হিন্দু কলেজ নামে (পরবর্তী নাম প্রেসিডেন্সি কলেজ) কলিকাতায় হিন্দুদের জন্য যে বিদ্যালয় স্থাপিত হলো, তা হিন্দুদের সামনে ইংরাজি শিক্ষার দ্বার অবাধে খুলে দিয়েছিল। এবং সেইসঙ্গে হিন্দুদের প্রাচীন সাহিত্যের দ্ধারের জন্য ইংরাজরা তাদেরকে গবেষণামূলক পদ্ধতিরও উৎসাহের ফলরূপেই ধীরে ধীরে হিন্দুদের মধ্যে এক পুনরুজ্জীবনের সূচনা হয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল, রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকান্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বিদ্বজ্জনের হাতে হিন্দুদের নেতৃত্ব চলে এলো। বর্ণহিন্দুর সচেতন এই অংশটিই হলো তাদের নেতা। এরা ছিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষায় শিক্ষিত, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও সচেতন। সেই সচেতন হিন্দু নেতৃত্বে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ ও দেবমন্দিরগুলোকে মোটামুটি অক্ষুণ্ণ রেখে, আধুনিক জ্ঞান-চিন্তাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত গ্রহণ করেছিল।

অন্যপক্ষে, মুসলমানদের নেতৃত্ব নেমে গেল মাদ্রাসায় শিক্ষিত স্বল্পমেধার গোঁড়া ও মধ্যযুগীয় শিক্ষার তল্পীবাহক কতগুলো লোকের হাতে। এরাই ছিলেন প্রাচীনপন্থী, অসচেতন আলেম শ্রেণি। এদের কাছে ইসলাম একটি ‘ধর্ম’ ছাড়া কিছু নয়। এবং ইসলামি শরিয়তের কর্ণধারগণ এই ‘মর্মকথাই’ ইনিয়ে-বিনিয়ে মুসলমানদের কাছে বলে চললেন।

এই সময় বাংলাদেশে গঁড়িয়ে উঠল এক প্রকার দোভাষী পুথি। সাধারণ মানুষ সেইসব পুথি থেকেই ‘ইসলাম ধর্ম’ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় জ্ঞান লাভ করতো আর ঐতিহাসিক শিক্ষার বিষয়ে তদ্দ্বারা হয়ে পড়ল সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ও উদাসীন। তাই কারো কাছে ‘বিষাদ সিন্ধু’ই সত্য, কারো কাছে মিলাদ শরিফের ‘বেহেশত-দোজখের’ বানানো কাহিনিসর্বস্ব ইসলামই সঠিক। চিন্তা ও গবেষণার মনোভাব থেকে অনেক দূরে বলে মুসলমান এই দু’ধরনের গালগল্পের মধ্যেই প্রধানত ধর্মের বিষয়বস্তু আবদ্ধ বলে মনে করলো। ফলে অজ্ঞনতার সর্বনিম্ন স্তরেই পড়ে রইল মুসলমান।

তারপর প্রায় একশো বছর পরে যখন মুসলমান ইংরাজি শিখল তখন তাদের মধ্যে পুনরুজ্জীবন তো হলোই না, বরং তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে গেল। এমন কি, ইংরাজি পড়তে গিয়ে কেউ কেউ ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো। মৌলবাদীদের ‘ধর্ম’ টিকিয়ে রাখার আগ্রহে আবার কেউ কেউ গেল মসজিদের ইমামের কাছে। কেউ গেল খানকার পীরের কাছে এবং তাদেরকেই জনসাধারণ নিজেদের ‘হুজুর’ বলে গ্রহণ করলো। এই হুজুররা যা বোঝালেন, তারাও সে সবকেই ‘ইসলাম’ বলে গ্রহণ করলো।

তারা ইসলাম বলতে বোঝালেন, মধ্যযুগীয় অধ্যাত্মবিদ্যা। পাকিস্তান আমলেও তেমনই চলছিল বলেই শোষণের হাতিয়ার হলো ইসলামের নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘রাজাকার’ ও ‘আল বদর’দের বাড়াবাড়িকে ‘ইসলাম ধর্মেরই’ শিক্ষার ফল বলে অনেকে দেখতে ও দেখাতে চাইলো। যদিও ‘রাজাকার’ ও ‘আল বদর’দের দুষ্কর্ম সত্যিকার ইসলামের ধারেকাছেও ছিল না।

ইংরাজ প্রবর্তিত শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ‘ধর্ম’ পরিচয়ে পরিচিত ইসলামকে তাই, আমরা এখন আর জানারও প্রয়োজন বোধ করি না।

সুতরাং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা কি, আমাদের বিশ্বাস কি হবে, আমরা কি ভাবব, আমাদের জীবনের প্রস্তুতি কেমন হবে, দেশ-জাতি ও মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্বই বা কি- আজ পর্যন্ত কিছুই আমরা সঠিকভাবে জানাতে পারলাম না। বিজ্ঞানের প্রতি একটা অহেতুক ও মূঢ় বীতশ্রদ্ধা যে আমাদের মধ্যে অনঢ় হয়ে বসেছিল, দ্বিধার সঙ্গে এখনো তাকেই সত্য ও সঠিক বলে ভেবে চলেছি।

কিন্তু ইসলামকে যদি সঠিকভাবে জানতে পারতাম, তবে এখনো ইসলামই আমাদের পথ দেখাতে পারতো। ইয়োরোপ কিংবা কম্যুনিজমের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন আমাদের হতো না।

এসব কারণেই ইসলাম সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখনো যদি ইসলাম সম্পর্কে সেই সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে, তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা পূর্ণ আশাবাদীই হতে পারি।

বিজয়ী ইংরাজ মুসলমানকে অশিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাহীন করে রাখার যে ষড়যন্ত্র দুশো বছর আগে করেছিল, ভিন্ন পরিবেশ আত্মপরিচয়হীন মুসলমানদের মধ্যে এখনো তা বিদ্যমান রয়েছে। সেই পরিচয়হীনতা দূর করার জন্য এই গ্রন্থ, ছোটদের ইসলাম পরিচয়। আত্মপরিচয় থেকেই আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়। এবং তাদেরই হাত ধরাধরি করে চলে উৎসাহ। এই বইয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কাছে ইসলামের সত্যরূপ বা স্বরূপ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, যাতে শিক্ষার কুফলরূপে ইসলামকে সেকেলে ও অকেজো বলে দেখার অবসান হয়। বরং সারা দুনিয়া যে শান্তির অন্বেষায় রয়েছে, ইসলাম দুনিয়াকে তাই দিতে পারবে, একথা জোরের সঙ্গেই এখানে চলা হয়েছে।