
মনোরি
সায়েন্স ফিকশন ৩
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২০
ঘুম ভেঙে গেল। শরীরটা বেশ ভালোই লাগছে। মাথাটাও বেশ পরিষ্কার। খুব বেশি সময় মনে হয় ঘুমাইনি। চোখ মেললাম। ঘরে আলো জ্বলে উঠলো সঙ্গে সঙ্গেই। ইচ্ছে হলো, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। একটু মোড়ামুড়ি করতে ইচ্ছে হলো। আবার কেউ দেখে ফেলবে কিনা, সেটাও ভাবলাম এক মুহূর্ত।
যা খুশি হবে! আমার যা ভালো লাগে, তাই করবো। এবং তাই করলাম। এখন আরও ভালো লাগছে। মনটাও বেশ শান্ত। কী করবো এখন ভাবছি। মনে হচ্ছে, দুপুর একটা বা দুইটা বাজছে। একটা ঘড়ি দরকার। সময়টা দেখা হচ্ছে না। আর ঠিক তখনই ওয়ালে একটা ঘড়ি দেখতে পেলাম। হ্যাঁ, বেলা পৌনে দুটো বাজে।
কোথাও রেডিও বাজছে। মিষ্টি স্বরে রেডিওর আওয়াজ ভেসে আসছে। চোখ বন্ধ করে আওয়াজটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এত বাংলায় কথা হচ্ছে। আশ্চর্য! কৈশোরে চলে গেলাম। দুপুরে রেডিওতে তখনও ‘অনুরোধের আসর’ বা এই টাইপ কি অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল— অনেককেই শুনতে দেখতাম।
ঠিক সেই রকম অনুষ্ঠান মনে হচ্ছে! কিন্তু এই ওয়াশিংটন ডিসি হসপিটালে কে সেই দেড়শো বছর আগেকার তাও বাংলাদেশি রেডিওর প্রোগ্রাম শুনবে? গান শেষ হলো। কি গান ঠিক ধরতে পারলাম না। বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। কিসের বিজ্ঞাপন এটা? কিছুই তো পরিষ্কার হচ্ছে না। কান আরোও তীক্ষ্ণ করলাম। পরিষ্কারভাবে বিষয়টা বোঝা দরকার।
রেডিওটাকে আমার খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মনে হচ্ছে। এই বিশাল পৃথিবীতে আমার তো পরিচিত কেউ নেই। নট এ সিঙ্গেল পারসন। আমি একা। একা। কাউকে আমি চিনি না। কাউকে না। আমার কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু আমি আছি। ওহ গড, প্লিজ হেল্প মি!
বিছানা থেকে নিচে নামলাম। আমাকে দেখতে হবে, কে শুনছে সেই ছোটবেলায় আমার শোনা রেডিও। কেন আমাকে ১৯৮০ দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে! বাথরুমে গেলাম না। আমাকে খুঁজে বের করতে হবে, কে? কারা? বারান্দায় বের হলাম। রেডিওর আওয়াজটা আরও তীক্ষ্ণ, আরও পরিষ্কার। পনের মিনিটের নতুন মুক্তি পাওয়া বা পেতে যাচ্ছে এমন বাংলা সিনেমার একটা ‘এভার্ট’ প্রচার হতো তখন। সেই প্রোগ্রামটা শুরু হয়েছে। কি ছবি এটা?
এখনও কি তাহলে বাংলাদেশি সিনেমা মানুষ দেখে? আমি তো বাংলা সিনেমা পছন্দ করতাম না। হিন্দিও না। শুধুই ইংরেজি মুভি দেখতাম। অথচ আজ বাংলা সিনেমার জন্য আমি হন্যে হয়ে শব্দের দিকে ছুটছি? আমার বাংলা ভাষা। আমার দেশের প্রোগ্রাম! এতটা টানছে আমাকে? মনটা শান্তিতে ভরে উঠছে আমার।
আমার পাশের তৃতীয় রুমটার ভেতর থেকে রেডিওর আওয়াজ আসছে। একটা কেবিন। নাম্বার ৮০০৪। রোগীর নাম ইংলিশে লেখা ‘আলিয়াস জেভার’। আমি বাইরে দাঁড়ালাম। এমনভাবে দাঁড়ালাম যেন কেউ বুঝতে না পারে, আমি ঠিক কি করছি। এবার ভালোমতো শুনতে চেষ্টা করলাম। ওহ নো! এটাতো বাংলা ভাষা না। স্পানিশ। স্পানিশ ভাষায় উচ্চস্বরে টেলিভিশন চলছে।
হঠাৎই মনে পরে গেল, স্প্যানিশের সঙ্গে বাংলার উচ্চারণগত মিলের বিষয়টি। অনেকটা একই রকম এই দুটির ভাষার উচ্চারণ। তবুও মিনিট পাঁচেক দাঁড়ালাম। ভালো লাগলো। নিজের কৈশোর। আমার সেই কৈশোরের বন্ধুরা? আরশাদ, সোহেল, মাসুদ, অসীম। একে একে আরও অনেকের নাম এবং চেহারাগুলি আমার সামনে ভেসে উঠছে। কত কত আনন্দ সেই কৈশোরে আমার।
লাটিম খেলা। সাতচাড়া। দাাঁড়িয়া-বাধা। গোল্লাছুট। ডাঙ্গুলি। সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বানানো ‘তাস’ খেলা। কত আনন্দ। সেই আনন্দ আর ফিরে আসবে না। কোনোদিনও না। শীতের সময় আমার অতি প্রিয় খেলা ব্যাডমিন্টন। আমার বাড়ির সামনে সেই খেলার মাঠ। ছোট্ট ইছামতি নদীতে সাঁতার কাটা। নদী পার হয়ে ওপাড়ে চলে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। আমার চোখ ভিজে গেছে। হাতের কাছে টিস্যুও নেই।
একি! বাচ্চাদের মতো আমি কাঁদছি। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি আমি। নিজেকে সামলাতে পারছি না। একটু চিৎকার করে যদি কাঁদতে পারতাম? মাটিতে শুয়ে হাত-পা নাচিয়ে একটু চিৎকার করে কান্না। একটু চিৎকার করে কাঁদতে না পারার কষ্ট, সে যে কতটা কষ্টকর! বাইরে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে আমার টি-শার্টও ভিজে গেছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। খুব ভালো যে মনটা নিয়ে বারান্দা বের হলাম, সেই মনটা এতটা ভারি হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি।
খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। গাঢ় নীল আকাশ। দেখতে ভালো লাগছে। কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছি। দূরে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। গাড়ি ছুটছে দ্রুত গতিতে। চোখের পানি বন্ধ করতে পারছি না। থাক, দেখি না কতটা কাঁদতে পারি। হয়তো একটু হালকা লাগবে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন অত্যন্ত কোমল হাত আমার ঘাড়ের উপর রাখলো।
‘মি. ইভান, আপনি ঠিক আছেন? আমি আপনার নার্স সিসিলিয়া। কেমন আছেন আপনি? কাঁদছেন কেন? আমাকে কি কাইন্ডলি বলবেন কিছু? আমি শুধু আপনার নার্স-ই নই, আপনি যদি আমাকে আপনার সেরা বন্ধু ভাবেন তাতে আমি খুবই আনন্দ পাব।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে থামলো হোয়াইট মেয়েটি। মেয়েটির বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি হবার কথা নয়। স্লিম। দেখতে অতি রূপবতী। সবুজ এপ্রোন গায়ে। মেয়েটা আমারচে ইঞ্চিখানেক লম্বা হবে সম্ভবত। যদি তার পায়ে উচু হিল না থেকে থাকে।
আমার কান্না কখন থেমে গেল বুঝিনি। সিসিলিয়া খুব সুন্দর করে হাসছে। বলল, আমাকে কি বলা যাবে কেন কাঁদছিলেন? মেয়েটির আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম। ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। জবাব দিলাম, ‘শৈশবের কথা মনে হচ্ছিল খুব। হঠাৎ একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম। এই বিশাল পৃথিবীতে আমার আজ আর কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। আমি সম্পূর্ণ একা। আমার মা। আমার বোন। আমার কত শত শত বন্ধু। আমার ছোটবেলার খেলার সাথীরা। আমার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির বন্ধুরা। কেউ নেই। অথচ আমি রয়েছি। আমি একা। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না সিসিলিয়া। আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো? আবার নতুন করে শুরু করে কবে আমার আবার অসংখ্য বন্ধু হবে। খুব আপন করে কি কোনোদিন আর কাউকে পাব কোনো দিনও?’
সিসিলিয়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার অন্য পাশে চলে এলাম।
সিসিলিয়া বলল, আপনি যে জীবনটা নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছেন, সেই জীবন আবারও পূর্ণতা পাবে। আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট, আপনার সবকিছু ঠিক আগের মতোই রয়েছে। পৃথিবী অনেক বদলেছে এই একশো বছরে। আমরা নতুন মানুষ। আপনি পুরাতন। কিন্তু তাতে কি?
তাতে অনেক কিছু। এমন একটা দিন আমার সামনে এসে উপস্থিত হবে, এটা আমি কোনোদিনও ভাবিনি।
দেখুন মি. ইভান। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আমি আপনার যাবতীয় বায়োগ্রাফি দেখেছি। আপনার অতীতের অনেকটাই আমি জানি। ঠিক আপনার রোবট মনোরি যতটা জানে, ততটা আমি জানি না। আমি তো একজন মানুষ। তবে এডমিনিস্ট্রেশন আপনার বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক এবং আন্তরিক। তারা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে সার্বক্ষণিক আপনাকে সঙ্গ দেবার জন্য। আমি সানন্দে দায়িত্বটি বুঝে নিয়েছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আজ আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আপনাকে কিছু মূল্যবান কথা বলবেন।
আমার সত্যিই কিছু ভাল লাগছে না সিসিলিয়া। আমি কি করবো কিছুই জানি না।
মন খারাপ করবেন না। আপনাকে আজ বিকেলে অনেক কিছুই জানানো হবে। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। কেন এতটা ভেঙে পড়ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। চলবে